×

সাময়িকী

চাটগাঁ ভাষার গীতিশতক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০১৯, ০৬:৫১ পিএম

চাটগাঁ ভাষার গীতিশতক

‘নবীনচন্দ্র সেন মহাশয় তাঁহার কাব্যে চট্টগ্রামের প্রাদেশিক প্রয়োগ ব্যবহার না করিয়া নবদ্বীপের প্রাদেশিক প্রয়োগ ব্যবহার করিয়াছেন। তাহার বিপরীত করিবার স্বাধীনতা তাহার ছিল।

আঞ্চলিক ভাষার গীতিকারের কাজ শিল্প-শৈলীর প্রতি যথাসম্ভব বিশ্বস্ত থেকে লৌকিক সাহিত্য বা লোকমুখে প্রচলিত সাহিত্যের আদলে (গানের তাল-সুর-ছন্দ বজায় রেখে) হৃদয় সঞ্জাত অনুভূতি কাব্যে প্রকাশ। আকাশ-সংস্কৃতির সহজলভ্যতা, সেলুলয়েড সংস্কৃতির সর্বগ্রাসী থাবায় আমাদের যেন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা- শিশুরা হিন্দি-ইংরেজি কার্টুন দেখে, যুবক-যুবতিরা ব্যান্ড সঙ্গীতের বাজনা শুনে লাফায়, গৃহিণীরা ভারতীয় সিরিয়াল গোগ্রাসে গিলেন, গৃহস্থরা সব দেখেশুনে ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ বলে আরব্য রজনীর স্বপ্নে বুঁদ-বিভোর আর পুঁজিবাদী গৃহনির্মাতা-ব্যবসায়ীরা তাদের বিজ্ঞাপনে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের দেশাত্মবোধক গানের প্যারোডি প্রচার করেন নির্বিবাদে। বিপরীত স্রোতে ভাসা কিছু মানুষের কণ্ঠে হাজার বছর আগেও যেমন শোনা যেত : ‘আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী’ (চর্যা: ৪৯); তেমনি এখনও প্রায়শ তাদের ‘মনে পইড়া যায়- একদিন বাঙালি ছিলাম রে ...’ (কথা-সুর-সংগৃহীত, শিল্পী- কুমার বিশ্বজিৎ)। ওঁরা এখনও স্বদেশের ভাষা-সংস্কৃতি ও মাটি-মানুষের কথা ভাবেন। এমন পরিপ্রেক্ষিতে বিচার্য বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার ও সঙ্গীতশিল্পী নিতাই চন্দ্র রায় রচিত চাটগাঁ ভাষায় একশ চারটি চমৎকার আঞ্চলিক গান নিয়ে চৌষট্টি পৃষ্ঠার গ্রন্থ দইজ্জাত উইট্টে তুয়ান (২০১৯)। ‘নবীনচন্দ্র সেন মহাশয় তাঁহার কাব্যে চট্টগ্রামের প্রাদেশিক প্রয়োগ ব্যবহার না করিয়া নবদ্বীপের প্রাদেশিক প্রয়োগ ব্যবহার করিয়াছেন। তাহার বিপরীত করিবার স্বাধীনতা তাহার ছিল; কিন্তু নিশ্চই কাব্যের ক্ষতি আশঙ্কা করিয়া সেই স্বাধীনতা সুখ ভোগ করেন নাই।’ শত বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ কথা বলার পরও নিতাই চন্দ্র রায় কেন ওপথে পা বাড়ালেন তা আগে বলে নেওয়া চাই। বাংলা উপভাষাতত্ত্বের প্রবাদপুরুষ জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সনের (১৮৫১-১৯৪১) ভারতীয় ভাষাতাত্ত্বিক সমীক্ষাপত্র (ঞযব খরহমঁরংঃরপ ঝঁৎাবু ড়ভ ওহফরধ) প্রকাশের (১৯০৩) প্রায় সমকালেই ব্রিটিশ রাজশক্তি ভেদনীতি অবলম্বন করে (বাংলাভাষী সমাজে অনৈক্য সৃষ্টি করবার লক্ষ্যে) বাংলার উত্তর-পূর্ব-মধ্য-পশ্চিম অঞ্চলের চারটি কথ্য উপভাষায় প্রাথমিকের পাঠ্যবই প্রণয়নের অপপ্রয়াস চালায়। এর প্রতিবাদে ১৯০৪ সালে ১১ মার্চ জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশনে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় রবীন্দ্রনাথ বলেন : ‘যে উপলক্ষেই হৌক, দেশের উপভাষার অনৈক্যকে প্রণালীবদ্ধভাবে ক্রমশ পাকা করিয়া তুলিলে তাহাতে যে দেশের সাধারণ মঙ্গলের মূলে কুঠারাঘাত করা হয়, ... ’। তারও পাঁচ বছর আগে (১৮৯৮) প্রবন্ধে তিনি লিখেন : ‘বাংলা ভাষার সহিত আসামি ও উড়িষ্যার যে-প্রভেদ সে-প্রভেদসূত্রে পরস্পর ভিন্ন হইবার কোনো কারণ দেখা যায় না। উক্ত দুই ভাষা চট্টগ্রামের ভাষা অপেক্ষা বাংলা হইতে স্বতন্ত্র নহে’ (‘ভাষাবিচ্ছেদ’, শব্দতত্ত্ব, পৃ. ৪৭)। তবু ব্রিটিশ বিভাজন-নীতিতে আসাম রাজ্যে অসমীয়া ও উড়িষ্যা রাজ্যে ওড়িয়া আজ পৃথক ভাষা হলেও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা বাংলা ভাষার উপভাষা হিসেবেই সর্বজনস্বীকৃত। এর পরের বছরই (১৯০৫) প্রকাশিত হয়- রবীন্দ্রনাথের ভাষা আলোচনার সারৎসার উক্তি, ‘বাংলাদেশের ভিন্ন ভিন্ন অংশে যতগুলি উপভাষা প্রচলিত আছে তাহারই তুলনাগত ব্যাকরণই যথার্থ বাংলার বৈজ্ঞানিক ব্যাকরণ।’ (‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’, রবীন্দ্র-রচনাবলী একাদশ খণ্ড, পৃ. ৫৪৯)। ফলে প্রমিত বাংলা ভাষার বিকাশ ও সমৃদ্ধির স্বার্থেই বাংলার প্রত্যেক উপভাষা তথা আঞ্চলিক ভাষার চর্চা ও সংরক্ষণে নতুন প্রেরণা জাগে এবং স্বদেশী চেতনায় আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারে হীনমন্যতা দূর হয়। সৃজনশীল সাহিত্যের সমস্ত শাখার মতো গানেও ব্যবহৃত হয় আঞ্চলিক শব্দাবলী। চট্টগ্রামে জনপ্রিয়তা পায় : ‘মধু কই কই বিষ খাওয়াইলা ...’, ‘তোঁয়ারা কন কন যাবি আঁর সাম্পানে ...’ ইত্যাদি গানগুলো। কিন্তু গানগুলো যখন লেখার প্রয়োজন হলো তখন এলো বিতর্ক। অনেকেই লিখলেন : ‘মধু হই হই বিষ খাওয়াইলা ...’, ‘তোঁয়ারা হন্ হন্ যাবি আঁর সাম্পানে ...’ এতে মনে হয় চট্টগ্রামের ভাষায় বাংলা ভাষার ‘ক’>‘হ’ হয়ে যায়। কিন্তু ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যায় চট্টগ্রামে ‘ক’ এর সাথে ই/উ যুক্ত হলে ‘ক’ অবিকৃত থাকে, যেমন- কি, কুন্নি; কিন্তু ‘ক’ এর সাথে অ/আ যুক্ত হলে ‘ক’ উষ্মতা প্রাপ্ত হয় বটে কিন্তু তা মহাপ্রাণ ‘হ’ হয় না। আর তাই কথ্ > কহ্ ধাতুজাত ক্রিয়া কই কই (কহিয়া কহিয়া) এবং হই হই ( হৈ হৈ ধ্বনি) চট্টগ্রামেও পৃথক অর্থবহ। প্রমিত বাংলায় আমরা যেমন ‘পরীক্ষা’ লিখে ‘পোরিক্খা’ উচ্চারণ করি ঠিক তেমনি চট্টগ্রামের ভাষাকে বাংলার উপভাষা মেনে নিয়ে বাংলা বানানেই লেখার পক্ষে আমরা, পড়বার বা গাইবার সময়ে চট্টগ্রামের বৈশিষ্ট্য প্রয়োগ করলেই হলো। এতে চট্টগ্রামের বাইরেও যে কোনো বাঙালির কাছে গানটির গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। তবে ভিন্ন মত থাকতেই পারে। অন্যদিকে সমগ্র চট্টগ্রাম অঞ্চলেও একই ভাষা ব্যবহৃত হয় না ‘দরিয়া’কে কেউ ‘দৈজ্জা’/ ‘দইজ্জা’, আবার কেউ ‘দৈর্গা’/ ‘দইরগা’ বলেন। কেননা, ‘উপভাষাতত্ত্বীয় নিয়মানুযায়ী এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের দূরত্ব পঁচিশ মাইলের বেশি হলে দুই অঞ্চলের ভাষাভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য দেখা দিতে থাকে’। তবে বোধগম্যতার দিক দিয়ে উভয়ই একই উপভাষা। শিল্পী নিতাই চন্দ্র রায় কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে বাস করলেও চট্টগ্রামী উপভাষার কেন্দ্রীয় অঞ্চলের শব্দ ও উচ্চারণেরই সফল প্রয়োগের প্রয়াস চালিয়েছেন তাঁর গানে। নিতাই চন্দ্র রায়ের অনেক গানেও যে সে ভাবাদর্শের দেখা মেলে- তা অনেকেরই মনে হবে। বাউল নিতাই ভবিষ্যতে তাঁর সাধনার বিস্তার ঘটিয়ে বাংলা লোকগানের সাধকদের একজন হবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। বৈদিক সাহিত্যে ঈশ্বর ত্রিগুণাতীত হলেও তাঁর সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষ সত্ত্ব-রজঃ-তমঃ গুণের অধীন। তমসান্ধ মানুষের সাত্ত্বিক হবার সাধনাই মনুষ্যত্বের সাধনা। বৈদিক ধর্মের মূল কথাও অনেকটা তাই। আর আধুনিক দর্শনের ভাষায় বলা যায় : প্রতিটি মানুষের মধ্যেই তিনটি ‘শু’ থাকে- যিশু, শিশু ও পশু। মানুষ পশুর মতোই জন্ম নেয়, পশু বা জীবের মতোই তার জৈবিক চাহিদা; দানবের মতো তার সহজাত দাম্ভিকতা। তবু সব প্রয়োজন-অহংকার অবহেলা একসময় একান্ত শিশুসুলভ মন নিয়ে যেন সে রবি ঠাকুরের মতো গেয়ে ওঠে : ‘আমরা সবাই রাজা / আমাদের এই রাজার রাজত্বে’। এভাবে সে শিশু হয়ে যিশু বা মহৎ মানব হবার পথে রওনা হয়। নিতাই চন্দ্র রায় পেশায় প্রশাসনের কর্মকর্তা আর নেশায় লোকভাষা-সংস্কৃতির শিল্পী। তাঁর আঞ্চলিক গান কিংবা লোকসঙ্গীত যা-ই বলি- সঙ্গীতসুধা হয়ে সঙ্গীতপ্রিয় মানুষের শ্রবণ তৃপ্ত করবে, সর্বোপরি চাটগাঁবাসীর কাছে এ সঙ্গীতগুলো আদর-কদর অর্জন করবে বলে আমাদের মনে হয়।

ড. শ্যামল কান্তি দত্ত

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App