×

জাতীয়

অনিকের হিংস্রতায় হার মানে আবরার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০১৯, ১১:০৫ এএম

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে আসছে হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা। কে কীভাবে আবরারের ওপর বর্বরতা চালিয়েছে এবং মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরে ঘটনা কীভাবে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল তা এখন অনেকটাই পরিষ্কার। এমনকি ঘটনার দিন রাত সাড়ে ৮টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত আবরারের আর্তচিৎকার ও গোঙানির চিত্রও উঠে এসেছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে। তা এতটাই ভয়ানক ও লোমহর্ষক ছিল যে, নির্যাতন দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল উপস্থিত কয়েকজন আসামিও। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আবরার হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি বুয়েটের ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মনিরুজ্জামান মনির। এর আগে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন মেহেদী হাসান রবিন, ইফতি মোশাররফ সকাল, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, অনিক সরকার ও মুজাহিদুর রহমান। ওই ৬ আসামির জবানবন্দি অনুসারে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারবিরোধী পোস্ট দেয়ায় আগেই টার্গেট করা হয় আবরার ফাহাদকে। এরই সূত্র ধরে, ৪ অক্টোবর বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবিন শেরেবাংলা হল ছাত্রলীগের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে নির্দেশনা দেন ‘আবরার শিবির করে, তাকে ধরতে হবে।’ এরপর মেসেঞ্জার গ্রুপে সাড়া দেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা। আবরার তখন বাড়িতে থাকায় তিনি বলেন, ‘ওকে বাড়ি থেকে ফিরতে দেন।’ এর একদিন পর ৬ অক্টোবর বিকেলে গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া থেকে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ফেরেন আবরার। রাত ৮টা ১৩ মিনিটে দুটি মোবাইলফোন ও ল্যাপটপসহ আবরারকে ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে যান তানিম, সাদাত, সাইফুল ও অভি। রুমে প্রবেশ করার পর আবরারের দুটি মোবাইল হাতে নিয়ে চেক করেন মুজতবা রাফিদ ও খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম ওরফে তানভীর। ল্যাপটপ নিয়ে নেন মুনতাসির আল জেমি। এরপর শিবির সম্পর্কে জানতে চাইলে অস্বীকার করেন আবরার। আর এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শুরুতেই কয়েকটি চড়-থাপ্পর মারেন রবিন। এ সময় কক্ষে আসেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান এবং ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক মো. মেফতাহুল ইসলাম ওরফে জিয়ন। কারা কারা শিবির করে তা জানতে চেয়েই আবরারকে কয়েকটি চড় মারেন মেহেদী। তখন ইফতিও চড়-থাপ্পর মারতে থাকেন। একপর্যায়ে শামসুল আরেফিন ক্রিকেট স্টাম্প নিয়ে আসেন। কথা আদায়ের জন্য ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে আবরারের পায়ে পেটান তারা। এরপর দুই হাত টানটান করে স্টাম্প দিয়ে আবরারকে মারতে থাকেন অনিক। নির্মম এ নির্যাতনের শিকার হয়ে কাঁদতেও পারেননি আবরার। কারণ অন্যরা আবরারের মুখ চেপে ধরে রেখেছিলেন। এভাবে থেমে থেমে স্টাম্প দিয়ে পেটান ইফতি, মেফতাহুল জিয়নসহ অন্যরা। মারতে মারতে ইফতির হাতে থাকা স্টাম্পটি ভেঙে যায়। এরপর অনিক সরকার আরেকটি স্টাম্প নিয়ে আবরারের হাঁটু, পায়ের তালু এবং পা ও বাহুতে মারতে থাকেন। এ সময় ভয়ে আবরার কয়েকজনের নাম বলেন। তখন আবরারকে চড় মারেন মেফতাহুল এবং স্টাম্প দিয়ে হাঁটুতে বাড়ি দিতে থাকেন। রাত সাড়ে ১০টার দিকে আবরারকে কক্ষে রেখে ইফতি, জিয়নসহ অন্যরা ক্যান্টিনে খেতে যান। মিনিট বিশেক পর ফিরে এসে তারা দেখেন, আবরার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি মেঝেতে শুয়ে আছেন। মেঝে থেকে আবরারকে ধমকিয়ে টেনে-হিঁচড়ে দাঁড় করিয়ে গালে কয়েকটি চড় মারেন ইফতি। মুজাহিদ তখন কক্ষে থাকা প্লাস্টিকের মোটা দড়ি দিয়ে পেটাতে থাকেন আবরারকে। ইফতি আবার স্টাম্প হাতে নেন। এবার আবরারের হাঁটু ও পায়ে আঘাত করেন তিনি। তাবাখখারুল তখন চড়-থাপ্পর মারেন। রাত ১১টার দিকে অনিক সরকার ওই কক্ষে এসেই স্টাম্প দিয়ে একনাগাড়ে এলোপাতাড়ি পেটাতে থাকেন আবরারকে। টানা ১০০ বারেরও বেশি স্টাম্প দিয়ে আবরারকে আঘাত করেন অনিক। কিছুতেই থামানো যাচ্ছিল না তার হিংস্রতা। অনিকের হাত থেকে বাঁচার জন্য কয়েক দফা তার পা জড়িয়ে ধরেও লাভ হয়নি আবরারের। পরে শেষ ভরসা হিসেবে আর্তচিৎকার দিয়ে ওঠেন তিনি। ওই সময় কক্ষে উপস্থিত অন্য আসামিরা ভয় পেয়ে যান। কিন্তু অনিকের পেটানো আর থামে না। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আবরারকে পিটিয়ে রাত ১২টার দিকে কক্ষ থেকে বের হয়ে যান অনিক। তার অমানসিক মারের পরই শ্বাসকষ্টে নিস্তেজ হয়ে পড়েন আবরার। করতে থাকেন বমি। পরপর দুইবার বমি করার পর আর নিশ্বাস নিতে পারছিলেন না। মৃত্যুর অপেক্ষায় গোঙানির মতো শব্দ করছিলেন আবরার। অবস্থা বেগতিক দেখে আবরারের মাথার নিচে বালিশ দেন ইফতি। ফোন দেয়া হয় অনিককে। বেপরোয়া অনিক প্রতিউত্তরে বলেন, ‘কিচ্ছু হবে না। আবরারকে গোসল করিয়ে হাতে-পায়ে মলম লাগিয়ে দাও।’ কিন্তু ততক্ষণে আবরার মৃতপ্রায়। ফের বমি করেন আবরার। তখন আবরারকে দাঁড় করানোও যাচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে কয়েকজন ধরে তাকে ২০০৫ নম্বর কক্ষে নিয়ে শুইয়ে দেন। এ সময় সেখানে আসেন মেহেদী ও অনিক। তখন মেহেদী বলেন, ‘ও ঢং ধরেছে। ওর কিছু হয়নি। থেরাপি দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।’ এ সময় আরও মেরে তথ্য বের করতে বলেন অনিক। ঠিক ওই মুহূর্তে এসএমএস পাঠান অমিত। তিনিও একইভাবে আরো তথ্য বের করতে আবরারকে মারার বুদ্ধি দেন। কিন্তু আবরারের অবস্থা খুব খারাপ জানালে অমিত তাকে হল থেকে বের করে দিতে বলেন। মেহেদী তখন আবরারকে পুলিশের হাতে দেয়ার জন্য নিচে নামাতে বলেন। এ সময় মিজান পানি আনতে বললে পানি এনে আবরারকে খাওয়ানো হয়। তারপর আবরারকে ধরাধরি করে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যান তানিম, মেয়াজ ও জেমি। পেছনে মোরশেদ, মুজাহিদ, তোহা, বিল্লাহ, মাজেদও ছিলেন। তখন আবরার শেষ বারের মতো গোঙানির সুরে বলেন, ‘আমার খুব খারাপ লাগছে।’ ইসমাইল ও মনির তখন অ্যাম্বুলেন্সকে ফোন দেন। অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি হওয়ায় তামিম বাইক নিয়ে বুয়েট মেডিকেলের চিকিৎসককে নিয়ে আসেন। চিকিৎসক আসার পরপরই অ্যাম্বুলেন্স আসে। চিকিৎসক রাত ৩টার দিকে সিঁড়িতে আবরারকে দেখে বলেন, ‘ও মারা গেছে।’ পরে আবরারের লাশ রাখা হয় ক্যান্টিনে। রাত সাড়ে ৩টার দিকে বুয়েটের শেরেবাংলা হল থেকে আবরারের মরদেহ উদ্ধার করেন চকবাজার থানা পুলিশ। আবরার মারা যাওয়ার আগ মুহূর্তে শিবির বলে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশ ডাকা হলেও সে পরিকল্পনা আর বাস্তবায়ন হয়নি বলে জানান ওই ৬ আসামি। উল্লেখ্য, গত ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের দ্বিতীয় তলার ২০১১ নম্বর রুমে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বুয়েটের ১৭তম ব্যাচের ইলেকট্রিক এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র আবরার ফাহাদকে। এ ঘটনার পরদিন ১৯ জনকে আসামি করে চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত মোট ২০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। যাদের মধ্যে ১৯ জনকে ৫ দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। রিমান্ড চলাকালীন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন ৬ জন। এদের মধ্যে সবার আগে গত বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) স্বীকারোক্তি দিয়েছেন বুয়েট ছাত্রলীগের উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল। এর পরদিন শুক্রবার ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন এবং শনিবার তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার এবং রবিবার ছাত্রলীগের সদস্য মুজাহিদুর রহমান আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। গত সোমবার ৫ দিনের রিমান্ড শেষে হত্যার দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দেন আবরারকে ২০১১ নম্বর রুমে নিয়ে প্রথম চড়-থাপ্পর দেয়া বুয়েট ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন। সর্বশেষ গতকাল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন মনির।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App