×

জাতীয়

ক্যাসিনোর টাকা বিদেশে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০১৯, ১০:৪৮ এএম

ক্যাসিনোর টাকা বিদেশে

অ্যাকশনে দুদক

অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচার আইনে হতে পারে মামলা

এস এম মিজান : সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ক্যাসিনো। এই ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িত রাঘববোয়ালরা বিভিন্ন পন্থায় বিদেশে অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। এসব টাকা হুন্ডি অথবা ব্যাংকিং চ্যানেলে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে পাচার করেছেন বলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিআইএফইউ) অনুসন্ধানে প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। ফলে অর্থপাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় ফেঁসে যেতে পারেন যুবলীগের এক ডজন নেতাসহ অন্তত অর্ধশতাধিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তাদের বিরুদ্ধে হতে পারে মানি লন্ডারিং মামলা। জানা যায়, ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রাঘববোয়ালরা অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকায় লন্ডন, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ফ্ল্যাট কিনেছেন কিংবা সেখানকার ব্যাংকে জমা রেখেছেন। কেউবা পাচারকৃত অর্থ বিদেশে বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। এ ছাড়া বেশ কজন গডফাদার তাদের ক্যাসিনো বাণিজ্য নির্বিঘ্নে টিকিয়ে রাখতে বিদেশে অবস্থানরত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কাছে নিয়মিত টাকা পাঠিয়েছেন। সূত্র জানায়, প্রাথমিক তালিকার তথ্য অনুযায়ী, ক্যাসিনো গডফাদারদের পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ হাজার কোটি টাকা হবে। তবে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষে এ অর্থের সঠিক পরিমাণ জানা যাবে। ক্যাসিনো সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তার ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সদ্য বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের মালয়েশিয়ার আমপাং তেয়ারাকুণ্ডতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের সন্ধান মিলেছে। অনুসন্ধানকালে পুলিশের ইমিগ্রেশন উইং, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ, পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস, সেকেন্ড হোমের এজেন্ট, মালয়েশিয়ান হাইকমিশন অনুমোদিত বিভিন্ন ভিসা এজেন্ট থেকে পাওয়া তথ্য, পাসপোর্টের কপি, সেকেন্ড হোম প্রকল্পে অনুমোদনপ্রাপ্তদের অনুমোদনপত্রের কপি ও ব্যাংক হিসাব বিবরণী যাচাই-বাছাইয়ে সম্রাটের মালয়েশিয়ায় অর্থ পাচার ও ফ্ল্যাট থাকার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন ব্যাংকে সম্রাটের অ্যাকাউন্টে লেনদেনের সুনির্দিষ্ট তথ্যও আছে গোয়েন্দাদের হাতে। ফলে সম্রাটের বাড়ি-গাড়ির প্রতি নেশা নেই বলে তার দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন চৌধুরী যে দাবি করেছেন তা ভিত্তিহীন বলে মনে করছে বিভিন্ন মহল। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও র‌্যাব ইন্টেলিজেন্সের একাধিক সূত্র জানায়, রাজধানীর ফকিরাপুলের ইয়ংমেন্স ক্লাবের সভাপতি, গ্রেপ্তারকৃত যুবলীগ নেতা (সদ্য বহিষ্কৃত) খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি, কৃষকলীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ এবং মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক (বিসিবি) লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার ক্যাসিনোর অর্থ বিদেশে পাচার সংক্রান্ত ব্যাপক তথ্য দিয়েছেন। এর মধ্যে লোকমান অস্ট্রেলিয়ায় কমনওয়েলথ ও এএনজেড ব্যাংকে ৪১ কোটি টাকা জমা রাখার কথা র‌্যাবের কাছে স্বীকার করেছেন। খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া বিদেশে ক্যাসিনোর অর্থ পাচারের কথা স্বীকার করলেও মোট টাকার পরিমাণ জানাননি। তবে গোয়েন্দাদের ধারণা, তার পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার কম নয়। অন্যদিকে সহোদর দুই ভাই গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রূপন ভূঁইয়া বিদেশে অন্তত দেড়শ কোটি টাকা পাচার করেছেন বলে গোয়েন্দারা তথ্য প্রমাণ পেয়েছেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজানেরও বিদেশে রয়েছে কোটি কেটি টাকার সম্পত্তি। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে মিজানের আলিশান দুটি বাড়ি ও দামি গাড়ি থাকার সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ছাড়া ভিক্টোরিয়া ক্লাবের সভাপতি কাজল ও সাধারণ সম্পাদক তুহিন, সৈনিক ক্লাবের ক্যাসিনোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যুবলীগ নেতা জসিম উদ্দিন ও এ টি এম গোলাম কিবরিয়া, যুবলীগ নেতা আরমান, তছলিম ও খোরশেদসহ আরো দেড় ডজন ক্যাসিনো গডফাদারের নাম দুদকের তালিকায় রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, যেসব গডফাদারের বিরুদ্ধে ক্যাসিনোর অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে, এদের মধ্যে অন্তত ১৫ জন শুদ্ধি অভিযানের আগেই বিদেশে ছিলেন। অভিযানের পর আরো অন্তত ১০ জন দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। বাকিরা দেশেই কোথাও ঘাপটি মেরে আছেন। এ বিষয়ে সম্প্রতি দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, কিছু ব্যক্তির অবৈধ জুয়া ও ক্যাসিনো ব্যবসার মাধ্যমে আয় করা অর্থপাচার ও জ্ঞাত আয় বহিভর্‚ত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছি। ক্যাসিনোকাণ্ডে কারা কারা জড়িত সে নামগুলো তদন্তের স্বার্থে এখনই প্রকাশ করতে চাই না। অনুসন্ধান শেষে মামলা হবে। সেই মামলার তদন্তের প্রয়োজনে সিঙ্গাপুর যেতে হলেও দুদক যাবে। প্রসঙ্গত, গত ৩০ সেপ্টেম্বর কমিশনের এক জরুরি বৈঠকে অবৈধ ক্যাসিনোর মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অন্তত ২৫ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন অনুসন্ধানের দায়িত্ব পালন করছেন।

ক্যাসিনো কারবারে ৪৩ জনের তালিকা দুদকে

কাগজ প্রতিবেদক : অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৪৩ জনের তালিকা এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হাতে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে এ নামগুলো পেয়েছে দুদক। তালিকায় যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটসহ সংগঠনটির বিভিন্ন স্তরের জনাবিশেক নেতার নাম রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। এসব নেতার প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই বিদেশে অর্থপাচার ও নামে-বেনামে সম্পদের প্রমাণ হাতে পেয়েছে কমিশন। গতকাল সোমবার দুদক কার্যালয়ে কমিশনের সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত সাংবাদিকদের এ কথা জানান। গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে অননুমোদিত ক্যাসিনোতে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করছে র‌্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর থেকেই বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় শুরু করে দুদক। এর অংশ হিসেবে একটি গোয়েন্দা সংস্থা, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) ও র‌্যাবের গোয়েন্দা ইউনিটের কাছ থেকে তথ্য পেয়েছে দুদক। সেই সঙ্গে দুদকের নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিটও অনুসন্ধান চালিয়ে আসছিল। এ চার সংস্থার তথ্যের সমন্বয়ে দুদক ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার ও বেনামি সম্পদের প্রমাণ পেয়েছে। দুদক সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ার আমপাংয়ের তেয়ারাকুতে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের। সেই সঙ্গে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকেও তার অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টে নিয়মিত লেনদেনের প্রমাণও পেয়েছে দুদক। এ তালিকায় সম্রাটের পরেই রয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার যুগ্ম সম্পাদক ও বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ। অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার আগেই তিনি সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন। অভিযান শুরুর পর তিনি এখন পর্যন্ত দেশে ফেরেননি। এ অবস্থায় ডিএসসিসির সভায় যোগ না দেয়ার অভিযোগে তাকে কাউন্সিলর পদ থেকে বহিষ্কার করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। তালিকায় আরো রয়েছেন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি ও কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা সফিকুল আলম ফিরোজ, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বকুল, গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু ও সহ-সম্পাদক রুপন ভূঁইয়া। এদের বেশিরভাগই গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং যুবলীগের পদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। দুদক সূত্র জানায়, সম্রাটসহ ৪৩ জনের বিরুদ্ধেই বিদেশে অর্থ পাচারের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডে অভিযুক্তরা অর্থ পাচার করেছেন। এর পাশাপাশি এসব দেশে নামে ও বেনামে সম্পদও গড়েছেন। যার প্রমাণ এখন দুদকের হাতে। এ প্রসঙ্গে দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত গতকাল সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, জুয়া ও ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৪৩ জনের নাম প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নেয়া হচ্ছে তাদের অর্জিত সম্পদের বিবরণী। তারা যদি তাদের সম্পদ বিবরণী সঠিকভাবে জমা দিতে না পারেন, তাহলে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচার আইনে মামলা হতে পারে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App