×

মুক্তচিন্তা

ভারতবিরোধিতার জিগির: লাভ-ক্ষতি কার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০১৯, ০৮:৩৪ পিএম

প্রতিটি নির্বাচনের আগে এবং সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা ভারত সফরে গেলে বাংলাদেশে ভারতবিরোধিতার জিগির তোলা হয়। এর ফলে বৃহত্তর জনগণের মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্কের সমস্যার সমাধান ও সম্পর্কের উন্নয়নের মাধ্যমে দুই দেশের সমৃদ্ধি ঘটানোর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধির চাইতে ভারতবিরোধিতার উগ্র হঠকারী ও সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি জীবন্ত রাখার চেষ্টা মহলবিশেষ করে যাচ্ছে। আমাদের উচিত হবে সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বজায় রেখে নিজেদের ন্যায্য পাওনা আদায় করে নেয়া।

কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করে এসেছেন। এই সফরে ভারতের সঙ্গে কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ ছাড়া ৩টি স্থাপনারও উদ্বোধন হয়েছে। আর এই সফরকে কেন্দ্র করে যথারীতি দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অঙ্গনে ভারতবিরোধিতার জিগির পরিলক্ষিত হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে দেশের গ্যাস দেয়া হয়েছে, ফেনী নদীর পানি ভারতকে দেয়া হয়েছে, তিস্তার পানি আনা যায়নি ইত্যাদি নিয়ে এতসব প্রচার-প্রচারণা চলছে যে যারাই এসব মিডিয়ায় ঢুঁ মারছেন তাদের বিভ্রান্ত না হয়ে কোনো উপায় নেই। ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোতে এ ক’দিনের টকশোতে কিছুসংখ্যক আলোচকই এই সুরে কথা বলেছেন। ফলে টেলিভিশনের দর্শক-শ্রোতারা বিভ্রান্ত হয়েছেন, অনেকে জানতে চেয়েছেন শেখ হাসিনা এবার কেন ভারতকে গ্যাস এবং ফেনী নদীর পানি দিয়ে এলেন? কেউ কেউ অতীতের চাইতে এবার শেখ হাসিনা ভারতকে বেশি দিয়ে এসেছেন বলেও মন্তব্য করেছেন। সবচাইতে বিস্ময়কর মন্তব্য শুনতে হয়েছে বামপন্থি রাজনৈতিক দল এবং অতিক্ষুদ্র ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের মুখ থেকে; যারা এই চুক্তি বাতিল করতেই হবে এমন দাবিও উচ্চারণ করেছেন। বিএনপি নেতারা একই ভাষায় ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির সমালোচনার পাশাপাশি তাদের ভাষায় শেখ হাসিনার নতজানু ভারত তোষণনীতিরও কঠোর সমালোচনা করেছেন। এসব সমালোচনার ভাষা এতটা তীর্যক এবং অশালীনতার পর্যায়ে নেমে আসে যা রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক শিষ্টাচারে পরিমাপ করা যায় না। সাধারণত শেখ হাসিনা ভারত সফরে গেলেই বিএনপিসহ দক্ষিণপন্থায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলো এবং আমাদের কয়েকটি অতিক্ষুদ্র বাম রাজনৈতিক দল ভারতবিরোধিতার জিগির এমনভাবেই তোলার প্রমাণ বারবার রেখে আসছে। কিন্তু অন্য কোনো দেশে প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে বা পরে কোনো শব্দ উচ্চারিত হতে খুব একটা শোনা যায় না। ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে পৃথিবীজুড়ে সব দেশেরই সমস্যা রয়েছে, এসব সমস্যার সমাধান কূটনৈতিকভাবেই সম্পন্ন করার রীতি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিচুক্তি সম্পাদন করেন। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর সীমানা চুক্তিসহ বেশকিছু অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান উভয় দেশের সরকারপ্রধানের সদিচ্ছার মাধ্যমে সম্পন্ন করতে পেরেছেন। কিন্তু যতবারই তিনি ভারত সফরে গিয়েছিলেন ততবারই ভারতের বিরুদ্ধে এক ধরনের জিগির এবং আওয়ামী লীগের দেশ বিক্রির তত্ত্ব, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি অভিযোগ শুনে আসতে হয়েছে। আমরা সেসব কথা শুনেছি- আবার গঙ্গার পানি পেয়েছি, ৭০ বছরের ছিটমহল সমস্যার সমাধান পেয়েছি, ব্যবসা-বাণিজ্যে আমাদের অবস্থান ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি করতে পেরেছি। এই অভিজ্ঞতা থাকার পরও এবারো গ্যাস এবং পানি ভারতকে দিয়ে ফেলার অভিযোগের কথা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে দেখেছি। অনেক বড় বড় রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, ছাত্রনেতাকে ভারতের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের দাবিতে এমনভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে মিডিয়ায় দেখেছি যা শুনে ও দেখে মনে হলো চুক্তি বাতিল না হলে বাংলাদেশ ভারতের কাছে শেষ হয়ে যাবে- যা প্রতিহত করতে তারা শেষ রক্তবিন্দু দিতে মাঠে নামবে। এসব সমালোচনা যদি তথ্যভিত্তিক হতো তাহলে অবশ্যই শোনার গুরুত্ব বহন করত। তবে তথ্যভিত্তিক আলোচনার জন্য বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানচর্চা অবশ্যই থাকতে হয়। আমাদের বিশেষজ্ঞদের মতামত না নিয়ে প্রায় সব ইলেকট্রনিক মিডিয়া যাদের অংশগ্রহণে টকশোতে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ করে দেয় তারা আসলেই এ বিষয়ে কতটা আলোকিত করার যোগ্যতা রাখেন সেটিই মৌলিক প্রশ্ন। উন্নত কোনো দেশে কোনো গণমাধ্যমই বিশেষজ্ঞদের মতামত ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মতামতকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে না। কিন্তু আমাদের এখানে সে ধরনের ধারণার চর্চা সাধারণত হতে দেখা যায় না, যদিও কালেভদ্রে কিছু কিছু ব্যতিক্রম দৃশ্যমান হয়। অবিশেষজ্ঞদের মতামত দেয়ার প্রাবল্য থেকে বিভ্রান্তির ছড়াছড়ি কত বেশি হতে পারে সেটি শুধু প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে কেন্দ্র করেই নয়, অন্যান্য অনেক বিষয়েও পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর ফলে জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে সাধারণ মানুষের জানা, বোঝা এবং ধারণার স্পষ্টিকরণে বিভ্রান্তির সৃষ্টি অনেক বেশি হয়- সেটিই আমরা লক্ষ করে আসছি। এ ধরনের বিভ্রান্তি মানুষের মধ্যে নানা ধরনের উত্তেজনা ও ক্ষোভেরও সৃষ্টি করে যার যথাযথ কারণ তাদেরও হয়তো জানা নেই। এমন না জানার কারণেই অনেকে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে তাদের ভুল প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে দিয়ে থাকে। মুহূর্তের মধ্যেই সেটি অন্যদের মাঝে সংক্রমিত হতে থাকে, সেই সংক্রমণ থেকে নেতিবাচক যে মনোভাব তৈরি হয় সেটি মোটেও সমস্যার সমাধানে সহায়ক হতে পারে না বরং আরো বেশি জটিল করে তোলে। বিশেষত ভারতের সঙ্গে যখন আমাদের সরকার কোনো বিষয় নিয়ে চুক্তি সম্পাদন করে থাকে তখন এর ভেতরের তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কে না জেনে সামাজিক, গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরূপ মন্তব্য ছুড়ে দেয়া হয় সেটি আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মনোজগতে প্রতিবেশী ভারত সম্পর্কে যে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করে সেটি যুক্তির ধারেকাছেও না গিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের জন্ম দেয়, বিস্ফোরণের অপেক্ষায় থাকে। এই বাস্তবতাটি পাকিস্তানকাল থেকেই আমরা বহন করে আসছি। আমরা ভেবেছিলাম ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর এমন অন্ধ ভারতবিরোধিতার মানসিকতা থেকে আমরা মুক্ত হবো, কেননা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান যে কোনো বিবেকবান মানুষই স্বীকার করবে এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ রাখবে। এর মানে এই নয় যে ভারতের কোনো অন্যায় দাবি আমাদের মেনে নিতে হবে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এমনটি খুব একটা মেনে নেয়া হয় না, তাই কেউ অযাচিতভাবে হস্তক্ষেপ করে প্রতিবেশী হিসেবে বন্ধুত্বের দাবি করে না। পাকিস্তান এবং ভারতের বিষয়টি একেবারে ভিন্ন, কিন্তু বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ক মহান মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে শুরু হয়েছে যেখানে পারস্পরিক বিশ্বাস এবং আস্থার ভিত্তি অনেক বেশি ঐতিহাসিক অবস্থান থেকে তৈরি হওয়া। সে কারণেই স্বাধীনতার পরপরই ভারতের সেনাবাহিনী অতি অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করেছে, দুদেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির দলিল রচিত হয়েছে, কূটনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য সহযোগিতা ইত্যাদি নতুন করে গড়ে উঠেছে, পারস্পরিক সহযোগিতা ও শ্রদ্ধার মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। তারপরও স্বাধীনতা-উত্তর কিছু কিছু মহল ভারত সম্পর্কে পাকিস্তানকালের মনোবৃত্তির প্রচার-প্রচারণার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা করেছে, তবে এগুলোর কোনোটিই তথ্যভিত্তিক ছিল না, সবই মেঠো বক্তৃতায় কোনো কোনো নেতা উচ্চারণ করেছেন। সেটিই বৃহত্তর সমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল, সন্দেহ-অবিশ্বাসের ছায়া ফেলেছিল প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে। এটি ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে রাজনীতি এবং সমাজ জীবনে বল্গাহীনভাবে প্রসারিত হয়েছে। এর ফলে উভয় দেশের মধ্যে সমস্যার স্তূপ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। সে সময় ফারাক্কার সমস্যা নিয়ে রাজনীতির ব্যানারে লংমার্চ করা হয়েছে, কিন্তু গঙ্গার পানির হিস্যা আদায়ে কূটনৈতিকভাবে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পাশাপাশি রাষ্ট্র-রাজনীতিতে তখন পাকিস্তানি ভাবাদর্শ পুনরুজ্জীবিত হয়। পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেক দেশের সঙ্গে কূটনীতি বাড়ানো হলেও ভারতের সঙ্গে তা সীমিত পর্যায়ে রাখা হয়েছিল। যার সুবিধা ভোগ করেছিল সে সময় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত গোষ্ঠী, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত কোনো সমস্যা নিয়ে লোক দেখানো কথাবার্তা ছাড়া সে সময় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দেয়া-নেয়ার কূটনীতি পরিচালিত হয়নি। ফলে উভয় দেশের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে, জনগণের মধ্যেও অনাস্থার তথা বৈরী মনোবৃত্তি লালিত-পালিত হয়েছে। এখান থেকেই ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আস্থা-অনাস্থার সংকটটি জনমনে স্বাভাবিক কিছু প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে। সে কারণে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ২৫ বছরের চুক্তির দলিলকে একটি পক্ষ প্রকাশ্যে গোলামির দলিল বলে আখ্যায়িত করেছিল, তাতে তাদের জনপ্রিয়তা ও ভোটপ্রাপ্তি বেড়েছে। তারাই পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ভারতের কাছে বিক্রি হয়ে যাবে, ধর্ম চলে যাবে ইত্যাদি অপপ্রচার নগ্নভাবে করেছে। প্রতিটি নির্বাচনের আগে এবং সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা ভারত সফরে গেলে বাংলাদেশে ভারতবিরোধিতার জিগির তোলা হয়। এর ফলে বৃহত্তর জনগণের মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্কের সমস্যার সমাধান ও সম্পর্কের উন্নয়নের মাধ্যমে দুই দেশের সমৃদ্ধি ঘটানোর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধির চাইতে ভারতবিরোধিতার উগ্র হঠকারী ও সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি জীবন্ত রাখার চেষ্টা মহলবিশেষ করে যাচ্ছে। কিন্তু এর ফলাফল আমাদের মতো দেশের জন্য কোনো অবস্থাতেই সুফল বয়ে আনবে না, অতীতেও আনেনি। তাই আমাদের উচিত হবে সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বজায় রেখে নিজেদের ন্যায্য পাওনা আদায় করে নেয়া, প্রতিবেশী দেশের স্বার্থের সঙ্গে সংঘাত নয়, সমৃদ্ধির সুযোগ খুঁজে নেয়া। এর জন্য আমাদের চাই বিশ্লেষণী জ্ঞান, যুক্তিবাদী সমাজ সচেতনতা, আধুনিক কূটনীতি ও রাজনীতির বিচার-বিশ্লেষণ। তাহলেই আমাদের কেউ পেছনে ফেলতে পারবে না। আমাদের রাজনীতিতে বর্তমানে যেসব কূপমণ্ডূকতা, সাম্প্রদায়িকতা, ভারতবিরোধিতার জিগির রয়েছে সেসব মোটেও কোনো আধুনিক অগ্রসর জাতিসত্তার পরিচয় বহন করে না।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App