×

জাতীয়

দুষ্টচক্রের খপ্পরে ক্রীড়াঙ্গন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০১৯, ১০:০৫ এএম

দুষ্টচক্রের খপ্পরে ক্রীড়াঙ্গন
খেলাধুলা ছেড়ে ক্যাসিনোয় মজেছিল দেশের নামি-দামি ক্লাবগুলো। একটি দুষ্ট চক্রের খপ্পরে পড়ে ধ্বংসের পথে দেশের গোটা ক্রীড়াঙ্গন। ক্যাসিনো মাফিয়ারা ক্লাবে জুয়া ও মাদকের আসর বসিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে শত শত কোটি টাকা। এর একটি টাকাও ক্রীড়া উন্নয়নে ব্যয় হয়নি। সব ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে ক্লাব মালিক-পরিচালক এবং তাদের গডফাদার ও সহযোগীরা। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে চলমান শুদ্ধি অভিযানে ধরা পড়ছে ক্রীড়াঙ্গনের রাঘববোয়ালরাও। প্রভাবশালীদের গ্রেপ্তার করে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। সম্প্রতি ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়াকে কয়েক দফা রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধানকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। সেলিম প্রধান ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সহসভাপতি এবং লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার ক্যাশিয়ারও। প্রতি রাতে আরামবাগ ক্লাবে প্রায় কোটি টাকা ক্যাসিনো, মাদক ও অসামাজিক কার্যকলাপের মাধ্যমে হাতবদল হতো। আর এসব নিয়ন্ত্রণ করতেন স্থানীয় কাউন্সিলর ও যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম সম্পাদক কে এম মুমিনুল হক সাঈদ। শুধু ক্লাবের সভাপতির পদ দখল করেই ক্ষান্ত হননি সাঈদ, পাশের দিলকুশা ক্লাবটিও করায়ত্ত করেছেন। কোটি কোটি টাকা বিলিয়ে হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদেও নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। শুধু কাউন্সিলরদেরই নয়, যুবলীগের এক গডফাদারকেও মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছেন এই কাউন্সিলর। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে ভিক্টোরিয়া ক্লাবও। ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত এ ক্লাব কর্মকর্তাদের দাবি, র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের হুমকির মুখে ক্যাসিনোর জন্য ভাড়া দিতে হয়েছিল। প্রতিদিন ৪০ হাজার টাকা করে ভাড়া আসত ক্লাবে। অবশ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্যাসিনোমুক্ত করে ক্লাব দুটিতে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। ক্রীড়াঙ্গনে দুষ্টচক্রের প্রভাব প্রসঙ্গে নন্দিত ফুটবলার শেখ মোহাম্মদ আসলাম বলেন, ক্যাসিনো মাফিয়াদের খপ্পর থেকে ক্রীড়াঙ্গনকে মুক্ত করতে হলে ক্লাবগুলোকে রাজনীতিমুক্ত করতে হবে। ত্যাগী সংগঠকদের স্থান ছেড়ে দিতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্রীড়াঙ্গনকে রাজনীতিমুক্ত রাখার কথা বলেছেন। আবাহনী বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মেনে চলায় এখনো কলঙ্কমুক্ত রয়েছে। জাতীয় দলের সাবেক এ তারকা ফুটবলার আরো বলেন, ঘাপটি মেরে বসে থাকা দুষ্টচক্রের সদস্যরা সবসময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সুযোগ সন্ধানীদের কারণে আজ ক্রীড়াঙ্গন কলুষিত। দুষ্টচক্রকে যারা ক্রীড়াঙ্গনে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে তাদেরও বিচারের আওতায় আনা দরকার। ক্রিকেটবিশ্বে যে কয়টি ধনী ক্রিকেট বোর্ড রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, মাহবুব আনাম, হানিফ ভূঁইয়া, ইসমাইল হায়দার মল্লিক ও খালেদ মাহমুদ সুজনের কারণে বারবার প্রশ্নের মুখে পড়ছে বিসিবি। খোদ বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের ছত্রচ্ছায়ায় বেপরোয়া অপকর্মে লিপ্ত হন তার কাছের লোকেরাই। বিশ্বকাপের পর শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়ে কলম্বোর একটি ক্যাসিনোতে ক্যামেরাবন্দি হন কখনো ম্যানেজার আবার কখনো কোচের ভূমিকায় থাকা খালেদ মাহমুদ সুজন। সফরে গিয়ে একজন কোচ কীভাবে জুয়ার আড্ডায় যেতে পারেন, তার জবাব পাওয়া যায়নি। ওই ঘটনার পর বিসিবির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। সুজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলেছেন অনেকে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি। কারণ বিসিবি প্রধানের ঘনিষ্ঠ হিসেবেই ক্রিকেটাঙ্গনে পরিচিত সুজন। দৈনিক ৭০ হাজার টাকায় ক্যাসিনো চালানোর জন্য মোহামেডান ক্লাব ভাড়া দিয়ে ধরা খেয়েছেন লোকমান হোসেন। ক্যাসিনো চালিয়ে লোকমান হোসেনের অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ৪১ কোটি টাকা! যার প্রায় পুরোটাই বিদেশের ব্যাংকে রাখা। যে লোকমানের কারণে বিসিবির ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত সেই ক্যাসিনো লোকমান বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পাপন অবশ্য বলেছেন, লোকমানের ক্যাসিনো সম্পৃক্ততা তিনি জানতেনই না! তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হলে ছাড় দেয়া হবে না। অপরাধ প্রমাণিত হলে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নেবে বিসিবি। কয়েক বছর ধরে স্পন্সরসংক্রান্ত সব চুক্তিই বিসিবির প্রভাবশালী পরিচালকরা করেছেন। তাদেরই একজন লোকমান হোসেন ভূঁইয়া। কোনো এক রহস্যজনক কারণে বিসিবির গুরুত্বপূর্ণ কমিটিগুলোতে রাখা হয় তাকে। বিশেষ করে কেনাকাটাসংক্রান্ত কমিটিগুলোতেও। বর্তমান ফ্যাসিলিটিস বিভাগের চেয়ারম্যান তিনি। বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলেরও সদস্য। ক্যাসিনো আতঙ্কে গা ঢাকা দিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক ও ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান ইসমাইল হায়দার মল্লিক। বিসিবির যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাকে ছাড়া হয় না। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে বিসিবি পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া গ্রেপ্তার এবং আরেক পরিচালক মাহবুব আনামের কাছে দুর্নীতি দমন কমিশনের হিসাব চাওয়ার পর চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে বিসিবির বোর্ড কর্মকর্তাদের মধ্যে। যার প্রভাব পড়েছে বিসিবির কর্মকাণ্ডেও। আসন্ন বিপিএল আয়োজন নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। বিসিবির মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস বলেছেন, কোনো একজন পরিচালকের জন্য আটকে থাকবে না বিসিবি। সবকিছু নিয়ম মাফিক চলবে। পরবর্তী বোর্ড মিটিংয়ে লোকমানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ক্লাবগুলোয় ক্যাসিনো বাণিজ্য করে যারা দেশের খেলাধুলার সুনাম নষ্ট করেছেন, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল। তিনি বলেন, আমরা চাই না কিছু মানুষের জন্য ক্রীড়াঙ্গন কলুষিত হোক। যারা এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত তাদের বিচার হওয়া উচিত, বিচার হতেই হবে। আইন পরিবর্তন করে ক্লাবগুলোকে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসার কথাও ভাবছেন তিনি। জাতির পিতা এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যায় আত্মস্বীকৃত খুনি, ফ্রিডম পার্টির মেজর (বরখাস্ত) বজলুল হুদার শ্যালক হানিফ ভূঁইয়া মোহামেডান এবং বিসিবির পরিচালক। গ্যালারিতে প্রধানমন্ত্রীর পেছনে বসে খেলা উপভোগ করেছেন তিনি। এ ছবি ভাইরাল হলে সারাদেশে রব ওঠে দুষ্টচক্রের সদস্যরা ক্রীড়াঙ্গনে প্রবেশ করল কীভাবে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুদ্ধি অভিযানের নির্দেশ দেয়ায় ক্রীড়াঙ্গনে যে দুষ্টচক্রের উপস্থিত দিন দিনে প্রকট হচ্ছিল তা বেরিয়ে এসেছে। দুষ্টচক্রের নাগপাশ থেকে ক্রীড়াঙ্গনকে মুক্ত করা সম্পর্কে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকডধারী টেবিল টেনিস খেলোয়াড় ও ক্রীড়া সংগঠক জোবেরা রহমান লিনু বলেন, বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে এ থেকে উত্তরণ বেশ কঠিন। কারণ অধিকাংশ ফেডারেশনেই দুষ্টচক্রের সদস্যদের সংখ্যা বেশি। এদের কারণে যোগ্য সংগঠকরা বিভিন্ন ফেডারেশনে প্রবেশ করতে পারছিল না। শুদ্ধি অভিযানের ফলে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রকৃত চেহারা বেরিয়ে এসেছে, যা ভীষণ বিব্রতকর। এবার ক্লাবগুলোকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিতে হবে। উপর মহলের সাহায্যে দুষ্টচক্রের সদস্যদের হটিয়ে ফেডারেশনগুলো যদি প্রকৃত ক্রীড়া সংগঠকদের হাতে তুলে দেয়া য়ায় তা হলেই দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ফের সুদিন ফিরে আসবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App