×

মুক্তচিন্তা

আমাদের বিবেকেরও মৃত্যু ঘটেছে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০১৯, ০৮:৩২ পিএম

বিবেকের কথা ওদের কানে যাবে না। মনুষ্যত্বের কথা ওদের শুনিয়ে লাভ নেই। ওরা এখন ক্ষমতায় বিশ্বাসী, লোভে বিশ্বাসী, হিংস্রতায় বিশ্বাসী। তদন্ত, বিচার, শাস্তি- এই তিনের মধ্যে আটকিয়ে ফেলতে হবে অপরাধীদের। অপরাধ করে ছাড় পাওয়া যাবে না- এই যদি হয় রাষ্ট্রের সংকল্প, তবেই হয়তো আর একটি আবরার রক্ষা পেতে পারে ভবিষ্যৎ কোনো এক সময়ে। তবে এটুকু স্বীকার করে নিতে কোনো গ্লানি নেই যে, আবরারকে রাষ্ট্র রক্ষা করতে পারেনি। হল কর্তৃপক্ষ আবরারকে নিরাপত্তা দিতে পারেনি।

সমাজ যেন একটির পর একটি হত্যাকাণ্ড দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। বিশ্বজিৎকে ভুল করে মেরেছিল ওরা, আবরারকে ফেসবুকে একটি মতামত প্রকাশের জন্য মেরেছে ওরা। আবরার বাংলাদেশের স্বনামধন্য বুয়েট নামক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র। যারা তাকে পিটিয়ে মেরেছে, তারাও ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। তাদের হাতে এখন আর বই নেই, বইয়ের জায়গায় স্থান পেয়েছে ক্রিকেটের স্ট্যাম্প, লাঠি। সেই লাঠি আর স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে তারা মৃত্যু নিশ্চিত করেছে আবরারের। সমাজ বিশ্বজিৎ, তৌকির, সাগর-রুনি কিংবা অন্য কারো হত্যারই বিচার হতে দেখেনি। অপরাধী নিশ্চিতভাবে শাস্তি পায়নি। বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে ছাত্রদের হাতে মানুষ মারার অপরাধও বেশ হালকা ও গুরুত্বহীনরূপে ধরা দিচ্ছে। শিবিরের রগ কাটার কথা আমরা জানি। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অজুহাতে জঙ্গিদের হাতে ব্লগারদের মৃত্যুও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ভিন্ন বিশ্বাসের মানুষ বলে হলি আর্টিজানে আমরা দেখেছি জঙ্গিদের হত্যাকাণ্ড। সাগর-রুনি আমাদের সমাজেই খুন হয়েছিলেন। কিন্তু অপরাধী আজো ধরা পড়েনি, কেউ অপরাধের জন্য শাস্তিও পায়নি। নারায়ণগঞ্জে শিশু তৌকিরকে কে হত্যা করেছে, সবাই তা বুঝলেও আজো পুলিশ তা খুঁজে বের করতে পারেনি। রাজনীতির নামে কী হচ্ছে আমাদের সমাজে? সমাজের দাগি আসামিরা যা করতে পারে, জঙ্গি যা করতে পারে- তা কি ছাত্রলীগের ছেলেরা করতে পারে? তাই যদি না হবে, তবে কীভাবে বিশ্বজিতের মৃত্যু হয়, কীভাবে আবরারের মৃত্যু হয়। বিবেকের কথা ওদের কানে যাবে না। মনুষ্যত্বের কথা ওদের শুনিয়ে লাভ নেই। ওরা আর সেই জগতে বাস করে না। ওরা এখন ক্ষমতায় বিশ্বাসী, লোভে বিশ্বাসী, হিংস্রতায় বিশ্বাসী। রাজনীতির কোনো ভালো লক্ষণই আজ ওদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই। ওরা ছাত্ররাজনীতি করে যেখানে ছাত্রদের কোনো নামগন্ধও নেই। ছাত্ররাজনীতির নামে ব্যবসা করা, মাস্তানি করা, ভোগ-বৈভবে আকৃষ্ট হওয়া ওদের আজকের গন্তব্যস্থল। ওদের তাই ভালো ভালো কথা শুনিয়ে, নীতির কথা বলে, বিবেকের দোহাই দিয়ে সুপথে আনা যাবে না। তদন্ত, বিচার, শাস্তি- এই তিনের মধ্যে আটকিয়ে ফেলতে হবে অপরাধীদের। তবেই ওরা শাস্তির ভয়ে দমে থাকবে। অপরাধ করে ছাড় পাওয়া যাবে না- এই যদি হয় রাষ্ট্রের সংকল্প, তবেই হয়তো আর একটি আবরার রক্ষা পেতে পারে ভবিষ্যৎ কোনো এক সময়ে। তবে এটুকু স্বীকার করে নিতে কোনো গ্লানি নেই যে, আবরারকে রাষ্ট্র রক্ষা করতে পারেনি। হল কর্তৃপক্ষ আবরারকে নিরাপত্তা দিতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবরারের জীবন বাঁচাতে পারেনি। অপরাধীদের শাস্তি হলেও হতে পারে। আশাবাদী হওয়ার সুযোগ রয়েছে বাস্তবতার বিচারে। রাষ্ট্র যদি আজ উপলব্ধি করে যে, আবরারের মৃত্যুর ওপর শুধু কয়েকজন নষ্ট হয়ে যাওয়া ছাত্ররাজনীতির ছেলেদেরই দায় নয়, বরং রাষ্ট্রেরও দায় আছে, তবে রাষ্ট্র সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ছাত্ররাজনীতি কিংবা রাজনীতি বদনাম নিতে পারে, ভুল করতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র কেন ভুল করবে, রাষ্ট্র কেন এত বড় বদনামের কারণ হয়ে দাঁড়াবে? সমাজ কেন ঘুরে দাঁড়াবে না? রাষ্ট্র কেন ঘুরে দাঁড়াবে না? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেন রুখে দাঁড়াবে না? বাবা-মা তার সন্তানকে একটু একটু করে বড় করে। একসময় উচ্চশিক্ষার জন্য ছেড়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকে তার সন্তান। আশায় বুক বাঁধে তার বাব-মা; কবে বের হয়ে আসবে তার আদরের দুলালটি। মানুষের এই যে জীবন, তাতে বিশ্বাস করতে হয় সমাজকে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে, শিক্ষাব্যবস্থাকে। তাই তো আদরের দুলালকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেড়ে দিতে বাবা-মার বুক কাঁপে না। তাদের বিশ্বাস আছে- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের সন্তানকে শিক্ষা দেবে, নিরাপত্তা দেবে। কিন্তু আবরারের হত্যাকাণ্ড কি সেই বিশ্বাসে হতাশা জাগাবে না? আবরারকে কি তার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা দিতে পেরেছে? সমাজ কি তার নিরাপত্তা দিতে পেরেছে? রাষ্ট্র কি তাকে বাঁচতে সাহায্য করেছে? আবরারের মৃত্যু আমাদের অনেকগুলো প্রশ্ন করছে। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় কি আমাদের উচ্চশিক্ষা নিতে আসা ছাত্রছাত্রীদের জন্য নিরাপদ স্থান? নিরাপত্তা প্রদানে কি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো দায় নেই? আবরার, তোমার প্রতি একটি শব্দও বলার মতো মনোবল নেই আমাদের। আমরা পরাজিত তোমার কাছে। আমরা পরাজিত আজকের এই সময়ের কাছে। তুমি শুধু একা মরোনি, আমাদের বিবেকও মরেছে। আমরা মনুষ্যত্ব হারিয়েছি। মানুষ বলার মতো অবশিষ্ট কিছু আছে কিনা আমাদের মধ্যে সেই প্রশ্নই জাগছে আজ করুণ সুরে। তুমি তো অন্ধকারে যাওনি, আমাদের সমাজটাকে অন্ধকারে যেতে তুমি প্রত্যক্ষ করেছ। তোমার জীবন ত্যাগের জন্য যতটুকু মায়া হচ্ছে, তার থেকেও বেশি কষ্ট পাচ্ছি আমাদের সামাজিক মৃত্যু হওয়ার কারণে। যে দশটি ছেলে তোমাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে, তারা তোমার মতো এমন একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। তারা বাইরে থেকে আসেনি। তোমার সঙ্গেই তারা পড়াশুনা করে। তোমার মতো একইভাবে শিক্ষাগ্রহণ করছে তারাও। তাদেরও মা আছে, বাবা আছে। তাহলে তাদের এমন দশার জন্য দায়ী কে? তাদের বাবা-মা? তাদের রাজনীতি? তাদের বিশ্ববিদ্যালয়? তাদের ব্যক্তিনষ্টচারিতা? কাকে দায়ী করব? একটি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী তারাও। কিন্তু তাদের কাজটি অনেক ঘৃণিত অপরাধীদের মতো। শিক্ষা, বিবেক, মনুষ্যত্ব, মমত্ববোধ, ভ্রাতৃত্ববোধ সব তাদের মধ্যে থেকে উড়ে গেল কী করে? তারাই কি শুধু দায়ী? আমরা কি কেউ দায়ী নই? সমাজ কি দায়ী নয়? রাষ্ট্র কি দায়ী নয়? রাজনীতি কি দায়ী নয়? আইনশৃঙ্খলা, বিচার ব্যবস্থা কি মুখ লুকিয়ে দায় এড়াতে পারবে? আবরার কি ক্ষমা করবে আমাদের? আবরার হয়তো শেষ চিৎকার দিয়েছিল ‘মাগো’ বলে। সেই চিৎকার কি পৌঁছেছিল অন্য মায়েদের নষ্ট ছেলেদের কানে? সেই চিৎকার কি পৌঁছেছে আমাদের সমাজের মানুষের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে, রাজনীতির কাছে? কে জবাব দেবে এসব প্রশ্নের? কেউ কখনো জবাব দিচ্ছে না বলে আমরা পিছিয়ে পড়ছি, আমরা ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি অন্ধকারের অতলে। সেই অন্ধকারে কেউ আর নিরাপদ নেই আজ। আজ হয়তো আবরার মরেছে, কাল অন্য কেউ। নিরাপত্তাহীনতার চাদরে ঢাকা পড়ে গিয়েছে আমাদের সমাজ ইতোমধ্যে। সেখানে কেউই নিরাপদ নয়। নিরাপদ নয় শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সমাজ, রাষ্ট্র। কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছি আমরা। অচেনা হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। শিক্ষালয়ে শিক্ষার পরিবর্তে যেন অন্যকিছুর দর কষাকষি। শুধু শিক্ষালয়েই এমন দুর্দশা তা নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরেই আজ হতাশার হাতছানি। বাঁচতে হবে আমাদের এমন পরিস্থিতি থেকে; বাঁচাতে হবে আমাদের সমাজটাকে এমন সর্বনাশার পথ থেকে। দায় নিতে হবে আমাদের প্রত্যেককে। আবরার যেন আমাদের তেমন একটা ধাক্কাই দিতে পারে। আবরার যেন তার জীবন দিয়ে হাজার জীবনকে রক্ষা করতে পারে এমন একটি কামনা রইল আবরারের অতৃপ্ত জীবনের কাছে। তুমি এই নষ্ট সমাজটাকে এমন সজোরে ধাক্কা দাও- যেন জেগে ওঠে মানবিক সমাজ, জেগে ওঠে সবার মনুষ্যত্ব। আবরারই যেন হয় আমাদের নষ্ট সমাজ আর নষ্ট রাজনীতির শেষ বিসর্জন। আবরার, তুমি দূর থেকে দেখে নিও যদি আমরা বদলাতে পারি, শোধরাতে পারি আমাদের। অন্য কোনো মৃত্যুর সঙ্গে যেন বলতে না হয়- এ যেন ছিল আমাদের মানবতার মৃত্যু। তুমিই যেন শেষ মৃত্যু হও আমাদের আগামী দিনের মানবিক সমাজে। আর যদি তা না হয়, ক্ষমা করে দিও অক্ষম, অকৃতজ্ঞ, অমানবিক এ জাতিকে।

মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App