×

মুক্তচিন্তা

ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নয়- গুণগত পরিবর্তনেই সমস্যার সমাধান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০১৯, ১০:২৭ পিএম

ছাত্ররাজনীতির অপকৌশল এবং ক্ষমতা উপভোগের অপব্যবহারে আবরারের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু ছাত্ররাজনীতি বন্ধের চেয়ে এর গুণগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সুস্থ জাতি ও মানবিক প্রজন্ম তৈরির লক্ষ্যে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের দাবি উঠলে এবং বুয়েটের মতো সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার চর্চা শুরু হলে আমাদের সামগ্রিক রাজনীতিও পরিশুদ্ধ হতে পারত। আবরার হত্যাকণ্ডে বিমর্ষ জাতির আবেগাশ্রু ও সমর্থন কাজে লাগিয়ে ছাত্ররাজনীতিকে সুস্থধারায় ফিরিয়ে আনার একটি সুযোগ আমরা হাতছাড়া করে ফেললাম হয়তো।

গভীর এক শোকের স্তব্ধতা নেমে এসেছিল বাংলাদেশে। সমগ্র বাংলাদেশ শোকে, বিহ্বলতায়, বেদনায় হতবাক ও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। আমরা মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলাম বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবরে। কেউ মেনে নিতে পারেনি আবরার ফাহাদের মৃত্যু- যা আসলে মৃত্যু নয় স্পষ্টত ‘হত্যাকাণ্ড’। এমন তরুণের এরূপ মৃত্যু আমাদের স্তব্ধ করে দিয়েছিল। এ ধরনের মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড মেনে নেয়া যায় না।

মেধাবী অথচ ক্ষমতার মদমত্তে অন্ধ একদল বিভ্রান্ত তরুণ কী ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার সঙ্গে তাদেরই সহপাঠী, তাদেরই অনুজ কিংবা বন্ধুপ্রতিম এবং প্রায় সমবয়সী আরেক মেধাবীকে রাতভর পিটিয়ে হত্যা করেছে, তা ভাবলেও বিষাদের অন্ধকারে ছাপিয়ে যায় আমাদের মন ও চিন্তার সমগ্র পটভূমি! গ্রেপ্তার হওয়া এসব ভয়ঙ্কর তরুণ পুলিশি রিমান্ডে আবরার হত্যার যে ধরনের তথ্য দিচ্ছে তাতে যে কেউ বিস্মিত না হয়ে পারেন না। গত সপ্তাহের পুরোটা সময়জুড়ে আমরা এদের নিষ্ঠুরতার চিত্র দেখছি। ‘র‌্যাগ’ নামের এসব নির্মম গল্পের কোনো শেষ নেই। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবাসিক হলগুলোতে শত শত শিক্ষার্থীর বিচিত্র শাস্তির নাম হলো র‌্যাগ। এ অশ্রু একদিন শুকিয়ে যায় বটে, কিন্তু যারা র‌্যাগের ‘শিকার’ তাদের মনের ভেতর বয়ে চলে অন্তহীন বিকট নির্মমতার দুঃসহ এক স্রোতস্বিনী। বুয়েটেই কেবল নয়- এরূপ গল্প বাংলাদেশের প্রায় সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতেই ঘটে। বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করা নবাগত শিক্ষার্থীদের ‘চরম’ ও ‘তিক্ত’ অভিজ্ঞতায় ‘বড় ভাইদের’ কাছ থেকে ‘ম্যানারিজম’ বা নৈতিক শিক্ষার নামে র‌্যাগের শিকার হতে হয়। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতেও যে র‌্যাগ নামক নিষ্ঠুর গল্পের প্রচলন ছিল তা আবরারের মৃত্যুর পর অনেকের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসছে। আর প্রমাণিত হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হল-প্রশাসন আসলে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ ছাড়া কিছুই না। এখানে কেবল কাগজপত্রে নানা বিষয়ে স্বাক্ষরের জন্য প্রভোস্ট কিংবা নামেমাত্র বহুসংখ্যক আবাসিক শিক্ষক থাকেন বটে কিন্তু দৃশ্যের অন্তরালে সকল কর্ম সাধিত হয় ‘সিনিয়র’ ভাই অথবা সরকারি ছাত্র সংগঠনের ‘নেতা’দের মাধ্যমে।

একদা শিক্ষাজীবন থেকে সেশনজট কমানোর লক্ষ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গণরুম সংস্কৃতি প্রবর্তিত হয়েছিল। সেই সংস্কৃতির ছোবলেই এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র হলে ছাত্র এবং ছাত্রী হলগুলোতে নবাগত ছাত্রীদের ওপর চলে অমানবিক র‌্যাগ- বড়ভাই-বড়আপুদের ‘নৈতিক শিক্ষা’দানের ভয়ঙ্কর প্রকল্প! এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই ‘স্নাত’ হতে হয়। এটি না হলে নাকি ‘ স্নাতক’ হওয়া যায় না! র‌্যাগ চর্চার মধ্য দিয়েই আস্তে আস্তে চুনোপুঁটি থেকে মাস্তানির চূড়ান্তে পৌঁছানোর গল্প শুরু হয় কোনো কোনো নেতার। সেই গল্পের শিকারে পরিণত হওয়া শেষ পরিণতির নাম মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ! আবরারের বিদেহী আত্মার কাছে এই সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কীভাবে কোন ভাষায় ক্ষমা প্রার্থনা করবে? কে জানে?

আবরার হত্যার পেছনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাসের কথা এখন পর্যন্ত ধারণা করা হচ্ছে। প্রকৃত কারণ হয়তোবা এর চেয়ে ভিন্ন কিছু নাও হতে পারে। ক্ষমতার দাপটের কাছে- বিশেষ করে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের ক্ষমতার দাপটের কাছে আবরার নিহত হয়েছে। স্বাধীন মতপ্রকাশ করলে দেশবিরোধী, জঙ্গি ইত্যাদি তকমা অজুহাত হিসেবে ক্ষমতাবানরা প্রয়োগ করেন বটে কিন্তু তা যে সর্বত্রই গ্রহণযোগ্য এমনটি ভাববার কারণ নেই। প্রধানমন্ত্রীর দ্ব্যর্থহীন বক্তব্যে আমরা তা বুঝেছি। সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারীদের আইনের প্রতি এরূপ শ্রদ্ধা দেখে পাতিনেতাদের টনক নড়বার কথা। কিন্তু বুয়েটে আমরা দেখলাম ভিন্ন চিত্র! ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে অত্যাচার ও হত্যার মতো অপরাধে যুক্ত হয়ে পড়েছে মেধাবীরা। সরকারি ছাত্র সংগঠনের নামে একদল বিভ্রান্ত তরুণ আবরারকে না ফেরার দেশে পাঠিয়ে দিয়ে আমাদের ভীষণ ভয়ঙ্কর এক বার্তায় বুঝিয়ে দিল যে, মেধাবী হলেও তাদের মধ্যে পৈশাচিক পাশবিকতা, হিংস্রতা আর পরোক্ষ হলেও ক্ষমতার এক প্রকার অন্ধ দাপট মানুষকে অমানুষে পরিণত করে তোলে। আবরার সেসব অমানুষের কাছে বলি হয়েছে। তরুণ বয়সে এমন বলি হয়েছে বলে আবরারের জন্য আমাদের অশ্রুরও শেষ নেই। আবরারের জন্য আমাদের শোকও তাই অন্তহীন, নিরন্তর। আবরারের পিতা-মাতার দীর্ঘ একুশ বছরের স্বপ্ন হঠাৎ করে একটি নিষ্ঠুর রাতে নির্মমভাবে কিছু ঘাতকের হাতে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে তা কেউ কখনো ভাবতেই পারেনি। তার পিতা-মাতার স্বপ্ন আজ বিপন্ন। শুধু স্বপ্ন বিপন্ন হয়েছে এ কথা বলা যাবে না। তাদের সমগ্র জীবন আজ বিপন্ন। পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহতম ভারী বস্তু। আবরারের পিতা এ ভার বইলেন কীভাবে জানি না! আমাদের বেঁচে থাকা কেমন অনিশ্চিত শঙ্কায় ভরা আবরার ফাহাদ হত্যাকা- তা মর্মে মর্মে বুঝিয়ে দিয়ে গেল!

আবরারের পিতা-মাতা, স্বজন, আত্মীয়দের শোকের গভীরতা আমরা স্পর্শ করতে পারব না কোনোদিন। তা স্পর্শ করতে না পারলেও আবরারের কথা ভেবে তার নিথর ও প্রাণহীন দেহটাকে সামনে নিয়ে আমরা আমাদের অবিরল অশ্রু বিসর্জন করে চলেছি। অশ্রু বিসর্জন করে চলেছি হয়তো বা আবরারের মাঝে নিজেদের সন্তানের ভবিতব্যের কথা ভেবেই। হয়তো বা স্বার্থপরের মতো এ ভাবনা আমাদের। হোক স্বার্থপরের মতো ভাবনা। তবু এ ভাবনার পুরোটাই কি অনর্থক? পুরোটাই কি অবাস্তব কল্পনা? এসব আশঙ্কার কি কোনোই ভিত্তি নেই? কিন্তু এর উল্টো দিকও আছে। তাই আজ আবরার হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার বুয়েট। শুধু বুয়েট নয়- সমগ্র বাংলাদেশের তারুণ্য আজ আবরারের পক্ষ নিয়েছে। অশুভ, অমানবিকতা, নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, দানবীয়তা ও পৈশাচিকতাকে পশ্চাতে ফেলে সমগ্র দেশের তরুণরা আজ শুভের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে, মানবিকতার পক্ষে এক মঙ্গল পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু এই মঙ্গল পতাকা বহনের দায় কঠিন। ইতোমধ্যে আমরা সেই গোলকধাঁধায় পড়েও গেছি অনুমান করি। কারণ আবরার হত্যাকারীদের শাস্তি বিধানের আন্দোলনের মধ্য থেকে শিক্ষাঙ্গনে তথা বুয়েটে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের দাবি উঠেছে। বুয়েটের উপাচার্য ‘নিজ ক্ষমতা’ বলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের এ দাবি মেনেও নিয়েছেন। তিনি সিন্ডিকেটের সভায় বিষয়টি উত্থাপন বা আলোচনা না করেই একক সিদ্ধান্তে আন্দোলনকারীদের দাবি কার্যকরের ঘোষণাও দিয়েছেন। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নীতিনির্ধারণী সভা হলো সিন্ডিকেট। আশা করি বুয়েটেও একটি সিন্ডিকেট আছে। আবরার হত্যার মতো একটি ভয়ঙ্কর ঘটনায় দেশবাসী বুয়েটে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অন্তত একটি ‘জরুরি সিন্ডিকেট সভা’ প্রত্যাশা করেছিল। আবরার হত্যা-উত্তর সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন ঘটনায় আমরা বিভিন্ন শিক্ষকের ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্ন বক্তব্য শুনেছি, কিন্তু বুয়েট সিন্ডিকেটের কোনো অস্তিত্ব টের পেলাম না। ফলে দাবি মানার ক্ষেত্রে সমস্ত সিদ্ধান্তই উপাচার্যের ‘নিজ ক্ষমতা’র বলে গৃহীত। সংকট উত্তরণে সকলের সম্মিলিত কিংবা আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়ে উঠতে পারল না।

যাই হোক, বুয়েটে রাজনীতি বন্ধের যে দাবি উঠে এসেছে এবং যা ইতোমধ্যে কার্যকর শুরু হয়ে গেছে তার যৌক্তিকতা নিয়েও আবার নানা মহলে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। রাজনীতিহীনতা শেষ পর্যন্ত আমাদের আরেক মহাসংকটের দিকে ঠেলে দেয় কিনা সেই আশঙ্কাও কম তীব্রতর হচ্ছে না। ছাত্ররাজনীতির অপকৌশল এবং ক্ষমতা উপভোগের অপব্যবহারে আবরারের মৃত্যু হয়েছে- এ কথা উল্লেখের অবকাশ রাখে না। কিন্তু ছাত্ররাজনীতি বন্ধের চেয়ে এর গুণগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সুস্থ জাতি ও মানবিক প্রজন্ম তৈরির লক্ষ্যে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের দাবি উঠলে এবং বুয়েটের মতো সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার চর্চা শুরু হলে আমাদের সামগ্রিক রাজনীতিও পরিশুদ্ধ হতে পারত। আবরার হত্যাকণ্ডে বিমর্ষ জাতির আবেগাশ্রু ও সমর্থন কাজে লাগিয়ে ছাত্ররাজনীতিকে সুস্থধারায় ফিরিয়ে আনার একটি সুযোগ আমরা হাতছাড়া করে ফেললাম হয়তো। আর তা শুরু হলো বুয়েটের ক্যাম্পাস থেকেই!

আহমেদ আমিনুল ইসলাম: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App