×

মুক্তচিন্তা

কলকাতার বাংলা সিনেমার বেহাল দশা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০১৯, ১০:২২ পিএম

সাম্প্রতিক বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কিন্তু এই পরিকাঠামোটাই দুর্বল। উত্তম কুমারের পরে বড় মাপের ম্যাটিনি আইডল আসেনি, ‘ভোজপুর’ গোত্রের কিছু হিরো-হিরোইন এসেছে। টালিগঞ্জে পেশাদারিত্বের ছোঁয়াটুকুও নেই। ব্যবসা করতে হলে বুকে সাহস লাগে। এপার বাংলা না ওপার বাংলা, কার হিরো সুযোগ পাবে সে বিচার করে লাভ নেই। আসল বিচার করবে দর্শক আর দর্শক মানেই বাজার। বেশি সিনেমা হলে বেশি হল হবে। হল মালিক নিজের গরজে বাংলা সিনেমা দেখাবে। লোকে কাজ পাবে।

পূজায় বাংলা সিনেমা দেখার ইচ্ছা জেগেছিল। সারা বছর নানা চক্কোরে থাকি। হলে যাওয়ার সময় পাই হয়তো তিন মাসে একবার। সব নতুন ছবি দেখা হয়ে ওঠে না। ইচ্ছে ছিল সব উসুল করে নেব।

পছন্দ বা সুযোগ যাই বলুন না কেন, হলে গিয়ে দেখার লিস্টে একটাই অপশন ছিল অরিন্দম শীলের তৈরি মহিলা গোয়েন্দা ‘মিতিন মাসি’। বাকিটার জন্য বাংলায় সব থেকে বড় প্রডাকশন হাউস এসভিএফের মালিকানায়, ‘হৈচৈ’ অ্যাপের সাবস্ক্রিপশন নিয়ে, অবাক! সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল সেন, তপন সিনহা, ঋতুপর্ণ এসব বাদ দিলে ডজনখানেক সৃজিত মুখার্জির আর্ট, বস্তাপচা ব্যোমকেশ, একটা ফেলুদা, গোটা তিনেক শবর, দুটি সোনাদা মোটামুটি এই হলো সাত রাজার ধন। শুধু এসভিএফের নিজের প্রডাকশন নয়- নন্দিতা-শিবপ্রসাদের উইন্ডোজের হামি, পোস্ত এসবও আছে। এ ছাড়া সত্যজিত-কথিত ‘কোডোপাইরিন’ মার্কা বেশ কিছু সিনেমা আছে, যা ভদ্রস্থ মুখে রোচে না। বাকি সব উত্তম-সুচিত্রা, ভানু-জহর যুগের।

‘হৈচৈ’ সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা সিনেমা দেখার সব থেকে ভালো অ্যাপ। খুঁজছিলাম গড়পড়তা দর্শকের পছন্দ- মন ভালো করা ফ্যামিলি ড্রামা, অ্যাডভেঞ্চার এসব। সব ঘেঁটেঘুঁটে দেখা গেল আমার না দেখার লিস্টে গোটা তিন-চারের বেশি এমন সিনেমা নেই। মানে, নিয়মিত বাংলা সিনেমা না দেখেও আমি তেমন কিছু মিস করিনি। এবং পশ্চিমবঙ্গের এটাই বাংলা সিনেমার সমস্যা।

সমস্যাটার গোড়া খুব গভীরে। সিনেমা তৈরির ব্যাপারটা ঠিক কবিতা, গান বা চিত্রকলার মতো নয়। ব্যয়সাধ্য, প্রযুক্তিনির্ভর। ফলে বাজার ছাড়া তার কোনো গতি নেই। আর বাজার তৈরি একটা প্রক্রিয়া, তাতে নানা উপাদান লাগে- সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন ফিন্যান্সিয়ার, যার কাঁধে ভর করে ডিরেক্টর সৃজনী প্রতিভা দেখাবেন। শুধু ডিরেক্টরের প্রতিভা থাকলেই হবে না। প্রতিভাবান নায়ক-নায়িকা থাকতে হবে। রাজনীতির মতো সিনেমাও ‘আইকন’ নির্ভর।

অমিতাভ, রাজেশ খান্না থেকে হাল আমলের শাহরুখ, সালমানরাই এ শিল্পের মুখ। নীতিকথা তো সবাই বোঝে, কিন্তু কৃষ্ণের মুখ নিঃসৃত না হলে কি মানত? কিন্তু কৃষ্ণ তো আর গাছ থেকে পড়বে না, তার জন্য একটা গোটা মহাভারত লাগবে। তাতে শিল্পের পরিকাঠামো অর্থাৎ টালিগঞ্জের কলাকুশলীদের রাজনৈতিক ‘কারটেল’, পেশাদারিত্ব বা তার অভাব, ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউশনের ব্যবস্থা বা অব্যবস্থা এ রকম আরো নানা জিনিস থাকবে। আর এসব মিলিয়ে ঠিক হবে গোটা টালিগঞ্জ পাড়া বছরে কত এবং কী ধরনের সিনেমা বানান। যে কোনো বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে একটা ‘ক্রিটিক্যাল ভলিউম’ লাগে, যার ভিত্তিতে বিশেষ চাহিদা তৈরি হয়। সেই চাহিদাই ঠিক করবে কোন ধরনের সিনেমায় কত পয়সা ঢাললে, লগ্নিকারী কত ফেরত পাবেন। ভোজপুরি ভাষায় কি কোনো ভালো সিনেমা হয় না বা হতে পারে না? কিন্তু ভোজপুরি সিনেমা বললেই আপনার যে মনে হয় লাল শার্ট, নীল জুতা পরে নায়ক-নায়িকা ‘আগইল-বা, ভাগইল-বা’ করছে সেটা ওই ক্রিটিক্যাল ভলিউমের কারণে।

ভারতের মতো দেশে বাজার তৈরির ব্যাপারটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম সিনেমা শিল্প বলিউড আছে, যার প্রভাব এশিয়াজুড়ে বিস্তৃত। এত বড় প্রতিযোগিতা সামলে যে সব প্রাদেশিক সিনেমা শিল্প ভালোভাবে বেঁচে আছে যেমন তামিল কি কন্নড়- তারা নিশ্চয়ই একটা বিশেষ গুণমানের ছবি প্রচুর পরিমাণে বানাচ্ছে। সেখানে নিশ্চয়ই আইকন, ফিন্যান্স, পেশাদার পরিবেশ আছে। যদি না থাকে, হিন্দি ছবিই সেখানে ভবিষ্যতে বাজার দখল করবে। হল না দিলে, লোকে নেটে দেখবে। আমার বাংলা, সোনার বাংলা জাতীয় কথা বলে বাজারকে আটকানো যায় না। ইউরোপের সিনেমার বাজার, হলিউড গিলে ফেলেছে।

সাম্প্রতিক বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কিন্তু এই পরিকাঠামোটাই দুর্বল। উত্তম কুমারের পরে বড় মাপের ম্যাটিনি আইডল আসেনি, ‘ভোজপুর’ গোত্রের কিছু হিরো-হিরোইন এসেছে। টালিগঞ্জে পেশাদারিত্বের ছোঁয়াটুকুও নেই। রাজনৈতিক কারটেলের ফলে পশ্চিমবাংলায় শুটিং করা খরচ ও সময়সাপেক্ষ। মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, তামিলনাড়ু ইত্যাদি রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে হলের সংখ্যা ১০ শতাংশও নয়। বছরে প্রায় ১৫০ বাংলা সিনেমা হয় কিন্তু চারটি বড় হাউসের ব্যানারে বছরে গোটা ৫০ ছবি ছাড়া, ঠিকঠাক হল বা শো-টাইম পাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য।

সবটাই যে রাজনীতির কারণে হচ্ছে তা নয়। বাজার মনে করে, উত্তম-পরবর্তী বাংলা সিনেমা হল মালিককে পয়সা ফেরত দিতে পারে না। সুতরাং হল মালিকের উৎসাহ নেই। হল দিলেও, সে আগে প্রডিউসারের কাছে টাকা ‘ডিপোজিট’ চায়, যাতে দর্শক না এলে অন্তত খরচাটুকু উঠে যায়। যদি দর্শক আসে তাহলে প্রডিউসার টাকা ফেরত পাবে। মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে তবু টিকেট বিক্রির একটা স্বচ্ছ হিসাব থাকে, বাকিটার হিসাব দেবে ‘ইম্পা’- প্রডিউসার, ডিস্ট্রিবিউটার, হল মালিকদের সংগঠন। সে হিসাবে কত জল, কে মাপে?

হিন্দি ছবির ক্ষেত্রে কিন্তু এমন নয়। ডিস্ট্রিবিউটার পয়সা দিয়ে দেখানোর স্বত্ব কেনে। হল মালিক নিজের গরজে দেখায়, দর্শক না হলে রিস্ক তার। বাংলা সিনেমায় এই সুবিধা পায় শুধু বড় হাউসগুলো এবং সেটাতেও বাজারের কারণকে অস্বীকার করা যায় না। এসভিএফের মূল ব্যবসা হিন্দি ছবির ডিস্ট্রিবিউশন। সুতরাং বাজারের ওপর তার স্বাভাবিক কর্তৃত্ব আছে। উইন্ডোজও পরের পর, হিট ছবি দিয়ে বাজারে নাম করেছে। সুতরাং তাদের ছবি হল মালিক দেখায়।

তাহলে হিসাবটা কী দাঁড়াল? অবাঙালি বা তোতলা নায়কের বাংলা উচ্চারণ ধরে, মোটামুটি পঞ্চাশটার মতো ছবি রাজ্যে চলে। এর মধ্যে হয়তো গোটা বিশেক শহুরে দর্শকের দিকে তাকিয়ে। অর্থাৎ শহর ও শহরতলির জন্য মাসে দুটি কি তিনটি বাংলা ছবি মুক্তি পায়। সব ছবিই তো আর আমার পছন্দের হবে না! তাই তিন মাসে একবার দেখলেই হলো- বাকি চাহিদা মেটাবে হিন্দি, ইংরেজি সিনেমা। গ্রামাঞ্চলের হিসাব করলে, আরো গুলিয়ে যাবে। সেখানে বাংলা থাকে ‘মাচা’য়। হিন্দি ছবির কথা ছেড়ে দিন, ভোজপুরিও কনুই মারে। এমন ব্যবসায় গরিবের পয়সা-মারা চিটফান্ড কিংবা টালিগঞ্জের ভাষায় ‘মুরগি’ ছাড়া বাংলা সিনেমায় পয়সা লাগাবে?

অনেকেই বলবেন হিন্দির বাজার বড় তাই বেশি সিনেমা বানাতে পারে। তথ্য কিন্তু তা বলছে না। তামিলনাড়ুর জনসংখ্যা সাত কোটির কম। সেন্সর বোর্ডের হিসাব বলছে ২০১৬-১৭ সালে মুম্বাইতে ৩০৬টি হিন্দি ছবি, আর চেন্নাইতে ২৭০টি তামিল সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। এদিকে ১০ কোটির পশ্চিমবঙ্গে ১৫৮টি বাংলা ছবি হয়েছে। যারা পান থেকে চুন খসলে হিন্দিকে নন্দ ঘোষ ভেবে গাল পাড়েন তাদের জানা দরকার, মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির নাকের তলায় থেকেও ১১৭টি মারাঠি ছবি হয়েছে।

অনেকে বলতে পারেন আগের থেকে বেশি বাংলা ছবি হচ্ছে। ঠিক ২০০৫ সালে টালিগঞ্জ পাড়া থেকে ৪০টি বাংলা ছবি সেন্সর সার্টিফিকেট পায়। ২০১০ সালে সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছিল ১০২। এখন ১৫০ ছাড়িয়েছে। কিন্তু অন্যরাও তো বসে নেই। ২০০৫-২০১৭-এর ভেতর তামিল সিনেমার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে, হিন্দি সিনেমা বেড়েছে ৫০ শতাংশ হারে। শুধু তো ছবি হলেই হলো না, এর গুণগত মানও দেখতে হবে। চটজলদি বিচারের একটাই উপায় ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডস যেখানে প্রাদেশিক ও হিন্দি সিনেমাকে একই গুণগত মানের ভিত্তিতে বিচার করা হয়। ২০০৮ থেকে ২০১৮, বিগত দশ বছরে বাংলা সেরা সিনেমার সম্মান পায়নি। এর মধ্যে মারাঠি ছবি দুবার ও অসমিয়া ছবি দুবার পুরস্কার পেয়েছে। বলাবাহুল্য, ঐতিহ্যের বিচারে মারাঠি বা অসমিয়া সিনেমা শিল্প বাংলার ধারেপাশেও আসেনি।

ভাষাগত বাজারের হিসাবেও বাংলার ধারেপাশে কেউ আছে কিনা সন্দেহ। দেশভাগের আগে ও পরে বহু মানুষ বাংলার বাইরে ডেরা বেঁধেছেন। কাজের প্রয়োজনে দিল্লি, মুম্বাই, ব্যাঙ্গালুরুর এসব তো আছেই, পশ্চিমবঙ্গের আশপাশে অনেক রাজ্যেই প্রচুর লোক বাংলা বোঝেন ও বাংলায় কথা বলেন। ঝাড়খন্ড, বিহার, আসাম, উড়িষ্যায় প্রচুর বাঙালি থাকেন। আসামের বরাক ভ্যালিতে প্রধান ভাষা বাংলা। সব থেকে বড় কথা ঘরের পাশেই ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ আর সেখানে ভারতীয় সিনেমার চাহিদা বিশাল। এত কিছু সত্ত্বেও বাংলা ছবি হালে পানি পায় না কেন জিজ্ঞেস করুন। বঞ্চনার গল্পে পালাতে পথ পাবেন না।

আসলে বাঙালি ব্যবসা ছেড়ে, শুধু অতীত গরিমায় বুঁদ হয়ে আছে। ব্যবসা করতে হলে বুকে সাহস লাগে। তিস্তার জল নিয়ে ফালতু ঝগড়া না করে, সেই সুযোগে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাজারকে জুড়ে দেয়ার প্ল্যান করতে হয়। গরমে তিস্তায় এমনিই জল থাকে না, যোগ-ভাগ করেও কারো কপালে বেশি কিছু জুটবে না। কিন্তু বাজার বড় হলে, বড় পুঁজি আসবে। বেশি সিনেমা হবে।

এপার বাংলা না ওপার বাংলা, কার হিরো সুযোগ পাবে সে বিচার করে লাভ নেই। আসল বিচার করবে দর্শক আর দর্শক মানেই বাজার। বেশি সিনেমা হলে বেশি হল হবে। হল মালিক নিজের গরজে বাংলা সিনেমা দেখাবে। লোকে কাজ পাবে। সবার লাভ।

প্রতিম বসু: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App