×

মুক্তচিন্তা

দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শক্ত অবস্থানে প্রধানমন্ত্রী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০১৯, ০৯:৪৬ পিএম

দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সফল করতে হলে এখন আরো কিছু দৃশ্যমান উদ্যোগ প্রধানমন্ত্রীকে নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর পাশে থাকা দুয়েকজন বাতিল আমলা বা দুয়েকজন আখের গোছানো আকাশচারী ব্যবসায়ীকে মাটির পৃথিবীতে নামালে কোনো ক্ষতি হবে না। মানুষের মনে বিরূপতা তৈরি হচ্ছে। এরাই তো আসলে ‘উইপোকা’। উইপোকা তাড়ালে সাধারণ মানুষ খুশি হবে। কর্মক্ষম, স্বচ্ছ, অবিতর্কিত ব্যক্তিদের দিয়ে একটি স্মার্ট টিম গঠন করে প্রধানমন্ত্রীকে এগিয়ে যেতে হবে।

ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট গ্রেপ্তার হবেন কিনা তা নিয়ে সব মহলেই যখন সংশয়-সন্দেহ দেখা যাচ্ছিল, ঠিক তখনই সম্রাট কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার হন। ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের শুরুতে যুবলীগের কয়েকজন গ্রেপ্তারের পরই সম্রাটের নাম আলোচনায় আসে। তবে যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্পর্কে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বক্তব্য দান এবং বিপুলসংখ্যক সমর্থক নিয়ে কাকরাইলে নিজের অফিসে সম্রাটের অবস্থান দেখে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছিল যুবলীগ বুঝি দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে চ্যালেঞ্জ করেছে। সম্রাটের নাম ক্যাসিনো-কাণ্ডে ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও তাকে গ্রেপ্তারে গড়িমসি দেখে এমন সংশয় দানা বাঁধে যে, শেষ পর্যন্ত না বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো হয়ে যায়! তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিভিন্ন কৌশলী বক্তব্য থেকে এটা মনে হয় যে, সম্রাটের রেহাই পাওয়ার সম্ভাবনা কম। সম্রাটের অবস্থান নিয়ে গণমাধ্যমে নানা ধরনের অনুমাননির্ভর রিপোর্ট ছাপা হতে থাকে। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, কিন্তু কৌশলগত কারণে তা প্রকাশ করা হচ্ছে না, তিনি দেশত্যাগ করেছেন বলেও গুজব ছড়ায়। তিনি ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন- এমন গুজবও ছড়িয়েছে। আবার তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে আছেন বলেও খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। সবশেষে গত শনিবার দিবাগত রাতে তিনি গ্রেপ্তার হন। তিনি দেশত্যাগের উদ্দেশ্যে কুমিল্লা গিয়েছিলেন বলে বলা হচ্ছে। প্রশ্ন আসছে, তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি এড়িয়ে কুমিল্লা গেলেন কীভাবে? তবে তাকে গ্রেপ্তারের খবরে অনেকেই স্বস্তি বোধ করেন। তাকে গ্রেপ্তারের পর সন্দেহবাতিকগ্রস্তদের সন্দেহ কতটা দূর হলো সেটা বলার সময় এখনো হয়নি। এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে সম্রাট সরকারি দলের অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন নেতা। তিনি যুবলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে ঢাকা শহরের শাসক দলের রাজনীতির একজন অন্যতম নেতা হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করেছিলেন। আওয়ামী লীগের স্থায়ী কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য, যুবলীগের সভাপতি এবং আরো কেন্দ্রীয় নেতা ও একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্ক অত্যন্ত মজবুত বলে শোনা যায়। খুঁটির জোর ছিল বলেই তার চালচলন ছিল সম্রাটের মতোই। তবে গ্রেপ্তার মানেই অনেক বড় কিছু নয়, এটা কোনো কিছুর শেষও নয়। বরং বলা যায়, এখনই শুরু হবে আসল লড়াই। তার বিরুদ্ধ অভিযোগগুলো প্রমাণ করতে হবে উপযুক্ত তথ্যাদির মাধ্যমে। অনুমানের ভিত্তিতে বা সন্দেহজনকভাবে একজন গ্রেপ্তার করা গেলেও বিচারে শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না। শাস্তির জন্য সাক্ষ্য-প্রমাণ লাগে। অভিযোগ প্রমাণ করার দায়িত্ব পুলিশের। সম্রাটকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। এখন তার অপরাধ প্রমাণ করার মাধ্যমে সক্ষমতার পরিচয় দিতে হবে। তবে মানুষের ধারণা, সম্রাটের শেষ পর্যন্ত বড় কিছু শাস্তি হবে না। নানা ধরনের নাটক এবং নাটকীয়তা চলতে থাকবে। তাকে ‘রক্ষা’ জন্য এত দিন যারা তার উপকারভোগী ছিলেন, তারা এগিয়ে আসবেন, নেপথ্যে কলকাঠি নাড়বেন তাকে ‘নির্দোষ’ প্রমাণের জন্য। গ্রেপ্তার হওয়ার পর হঠাৎ তার ‘অসুস্থ’ হয়ে হাসপাতালে ঠাঁই নেয়াকেও অনেকেই ইঙ্গিতপূর্ণ বলে মনে করছেন। মানুষের মনে সংশয় তৈরি হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার পরও কেউ কেউ রাজনৈতিক কানেকশনের কারণে রাষ্ট্রপতির মার্জনা লাভে সক্ষম হয়েছেন। সম্রাটের মতো প্রভাব-প্রতাপের একজন ‘নেতা’ শাস্তি পাবে নিজের দল যখন ক্ষমতায়, তখন এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক। আবার অতীতে যা যেমন হয়েছে, এখনো তা তেমনই হতে থাকবে, সেটাও না হতে পারে। আমরা চাইব, অপরাধ-দুর্নীতির শিকড় উপড়ে ফেলতে দেশে নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। যার প্রাথমিক ধাপ সম্রাটসহ কয়েকজনের গ্রেপ্তার। পুরো বিষয়টি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে হ্যান্ডল করতে হবে। তাড়াহুড়া করে কিংবা মানুষের মনোযোগ পাওয়ার জন্য এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যেটা হঠকারিতার পর্যায়ে যায় এবং মানুষের মধ্যে নতুন করে হতাশা তৈরির পরিস্থিতি দেখা দেয়। সম্রাটেই যেন সব শেষ না হয়। তার সহযোগী-পৃষ্ঠপোষকদেরও ধরতে হবে। কারা এই ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন তৈরি করল তা জাতিকে জানাতে হবে। বন্দুকযুদ্ধ, ক্রসফায়ারের মতো ঘটনা যেন কোনোভাবেই না ঘটে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে দল, আত্মীয়, পরিবার কিছুই দেখবেন না। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ভ্রান্ত প্রমাণের চেষ্টা যেন কেউ না করেন। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের কেউ যেন ভারে বা ধারে রেহাই না পায়। আবার একজন নির্দোষ মানুষও যেন অকারণে হয়রানির শিকার না হন। তবে ঝড় উঠলে কোন ঘর বা কোন গাছটা ভেঙে পড়বে সেটা আগাম বলা যায় না। এ কথাটাও সবার মনে রাখতে হবে যে, প্রধানমন্ত্রী একটি কঠিন লড়াইয়ে নেমেছেন। এই লড়াইয়ে সফল হতে হলে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন লাগবে। আর সেটা পেতে হলে ‘পাবলিক পারসেপনশন’ উপেক্ষা করা যাবে না। মানুষকে আস্থায় নিতে হবে, তাদের মধ্যে যে সন্দেহ-অবিশ্বাস দানা বেঁধেছে, তা দূর করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে, যা দেখে মানুষ খুশি হবে এবং তাদের মধ্যে একটা নতুন আশাবাদ তৈরি হয়। অনেকেই এটা মনে করেন যে, ‘ঘর থেকে শুদ্ধি অভিযান’ শুরু- এই কথাটা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হলেও প্রধানমন্ত্রীকে তার আশপাশে নজর দিতে হবে। মানুষ মনে করে প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে এমন কয়েকজন আছেন যারা তার জন্য এখন বোঝা হয়ে উঠেছেন। তাদের সঙ্গে মানুষের ভালো ধারণা নেই। তারা অনিয়ম আর দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। প্রধানমন্ত্রীর কয়েকজন উপদেষ্টাকে অবিলম্বে অব্যাহতি দেয়া দরকার বলে অনেকে মনে করেন। তারা অনেকদিন স্যান্ডুইচ-প্যাটিস খেয়েছেন। নানা কারণে নিন্দিত-বিতর্কিত মুখগুলোকে বাদ দিয়ে এখন কিছু নতুন মুখ সামনে আনলে জনগণ খুশি হবে। প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা ও উদ্দেশ্যের সততা প্রশ্ন বা সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকবে। তা ছাড়া এক মানুষকে বহুদিন এক জায়গায় দেখতেও ভালো লাগে না। প্রধানমন্ত্রী তার দলের অনেক বিশাল বিশাল নেতাদের বনসাই বানিয়েছেন। ডাকসাইটে মন্ত্রীদের বাদ দিয়েছেন। নতুনদের জন্য জায়গা করে দেয়ার এই ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্টরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মন খারাপ করলেও এটা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে প্রশংসিত হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ আছে তাদের ‘চাকরি’ অব্যাহত থাকলে মানুষের মনে বিরূপতা দেখা দিতে পারে। দেশের মানুষ শেখ হাসিনার পক্ষে আছেন বলেই সবসময় তার সব যুক্তি সবার কাছে গ্রহণীয় নাও হতে পারে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সফল করতে হলে এখন আরো কিছু দৃশ্যমান উদ্যোগ প্রধানমন্ত্রীকে নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর পাশে থাকা দুয়েকজন বাতিল আমলা বা দুয়েকজন আখের গোছানো আকাশচারী ব্যবসায়ীকে মাটির পৃথিবীতে নামালে কোনো ক্ষতি হবে না। এদের কারণে বরং শেখ হাসিনার পায়ের নিচের মাটি আলগা হচ্ছে। মানুষের মনে বিরূপতা তৈরি হচ্ছে। এরাই তো আসলে ‘উইপোকা’। উইপোকা তাড়ালে সাধারণ মানুষ খুশি হবে। প্রধানমন্ত্রীর হাত শক্তিশালী হবে, পায়ের নিচের মাটি মজবুত হবে। কর্মক্ষম, স্বচ্ছ, অবিতর্কিত ব্যক্তিদের দিয়ে একটি স্মার্ট টিম গঠন করে প্রধানমন্ত্রীকে এগিয়ে যেতে হবে। অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারা প্রধানমন্ত্রীর জন্য এই কাজটি করা কঠিনও নয়, অসম্ভবও নয়। তিনি পারবেন। তার ধমনীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত বহমান। স্রোতের বিপরীতে চলার সাহস তার আছে। তার যেহেতু ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই সেহেতু তিনিই পারবেন যে কোনো ঝুঁকি মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে। তিনি বলেছেন, যেখানে অন্যায়-অনিয়ম সেখানেই অভিযান চলবে। তার এই দৃঢ় মনোভাবের প্রতি দেশবাসীর শতভাগ সমর্থন আছে। তাকে নিঃসঙ্গ বা বিচ্ছিন্ন ভাবার কোনো কারণ নেই। মুষ্টিমেয় কয়েকজন দুর্বৃত্ত কখনই লাখো-কোটি সাধারণ মানুষের চেয়ে শক্তিশালী হতে পারে না। জনতার সমর্থন শেখ হাসিনার প্রতি আছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে সেটা আরো বেড়েছে। তার হারানোর কিছু নেই। পাওয়ার আছে জনগণের বুকভরা অসীম ভালোবাসা।

বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App