রিশা হত্যা মামলার রায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকুক

আগের সংবাদ

দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শক্ত অবস্থানে প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

উন্নয়নের গতি, দুর্নীতি ও বাস্তবতা

রহিম আব্দুর রহিম

সাংবাদিক ও নাট্যকার ও শিশু সংগঠক

প্রকাশিত: অক্টোবর ১১, ২০১৯ , ৯:৪৫ অপরাহ্ণ আপডেট: অক্টোবর ১১, ২০১৯ , ৯:৪৫ অপরাহ্ণ

বিচার-আচারের নামে নিরীহ মানুষদের কাছ থেকেও চাঁদাবাজিও কম করছে না। গ্রামের মেঠোপথ এখন পিচঢালা, অথচ এই উন্নয়নের অন্তরালে ঠিকাদাররা লাগামহীন দুর্নীতি করায় বছর পার না হতেই পাকা রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্ট ভেঙে যাচ্ছে, খসে পড়ছে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ইমারত।

আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে সারাদেশে আনাচে-কানাচে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা নিজেও এ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের জন্য সোচ্চার, তা তিনি স্পষ্ট করেছেন ৯ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, আবরার হত্যার বিচার হবেই। খবরে প্রকাশ, ছাত্রলীগের নামে নাকি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে উঠেছে নির্যাতন সেল। আশ্চার্য! ঐতিহ্যবাহী ছাত্রলীগে ছাত্র সমাজের কল্যাণ ছাড়া অন্য কিছু হওয়ার কথা নয়। কেন এমনটা হচ্ছে? লেখাটি যখন তৈরি করছিলাম, ঠিক তখনই বর্তমান সরকারের একজন নীরব শুভাকাক্সক্ষী ফোন করে জানতে চাইলেন, ‘আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী ১ হাজার ৫শ জনের একটি তালিকা নাকি প্রধানমন্ত্রীর হাতে?’ বললাম, প্রধানমন্ত্রীর হাতে কী আছে, না আছে, তা জানি না। তবে তিনি সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীদের সম্পর্কে জানেন এবং তাদের খোঁজখবর রাখেন। ফলে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা থাকতেই পারে।
আমি প্রশ্ন রাখি একা প্রধানমন্ত্রী কী করবেন? দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ের ওয়ার্ড থেকে শুরু করে ঘরে ঘরে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ দলের অঙ্গসংগঠনগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে সুবিধাবাদী-অপরাধীরা। যারা দলীয় ব্যানারে অবাধে বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হওয়ায় সরকারে ব্যাপক উন্নয়নে কলঙ্কলেপন হচ্ছে। পাঠকে ধৈর্যচ্যুতি না ঘটিয়ে মূল কথায় যাচ্ছি, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি ভাষণের শেষে কবি সুকান্তের কবিতার বাণী উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান; জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে চলে যেতে হবে আমাদের, চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি- নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ দেশের সর্বস্তরে যখন উন্নয়নের পরিকল্পিত প্যাকেজ চলমান, ঠিক ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর সুকান্তের কবিতা উচ্চারণের অন্তরালে যেমন দৃঢ় প্রতিজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ, তেমনি অসাধুদের প্রতি চরম হুঁশিয়ারি।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর দীর্ঘ ৬ বছর ভারতে অবস্থানের পর ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফেরেন এবং আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। সাগরসম চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী। সময়কাল প্রায় এক যুগ। শেখ হাসিনার মতে, ‘সংগঠন আমার পাশে, বাংলার জনগণ আমার পাশে, তাদের দোয়া-আশীর্বাদ এটাই আমার শক্তি।’ তার বিশ্বাস, ধারণা এবং চেতনাকে বাস্তবায়ন করতে গিয়েই তিনি প্রান্তিক জনগণের কাছে সেবা পৌঁছে দেয়ার যে মিশন চালিয়ে যাচ্ছেন তাতে ঘুণধরা, অসম্ভব!। নড়েচড়ে বসেছেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা কত বড় দেশপ্রেমিক, রাজনীতিবিদ, সাহসী এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনের পাল্লায় যখন তিনি পা রেখেছেন, ওই সময় এ কোন ধরনের নাটকীয় কলঙ্ক। এরপরও জাতি বিশ্বাস করে, বজ্রের মতো কঠিন-কঠোর ও ফুলের মতো কোমল শেখ হাসিনা তার মিশন থেকে পিছপা হতে পারেন না। গত ৩০ সেপ্টেম্বর নিউয়র্কে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘দুর্নীতিবিরোধী অভিযান হচ্ছে, ওয়ান-ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়। সেই কাজটি আমি নিজের ঘর থেকেই শুরু করেছি; এটি অব্যাহত থাকবে।
আমি বলতে চাচ্ছি, ওয়ান-ইলেভেন লাগবে না। কোনো অন্যায় হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা আমরাই নেব। এ ধরনের আঘাতের দরকার ছিল, ধরেছি যখন ভালোভাবেই ধরেছি। এটা শুধু কথার কথাই নয়। রূঢ় সত্য। শেখ হাসিনা এমন একজন রাজনীতিবিদ যাকে কে না যায় না। এর চাক্ষুষ দলিল দাঁড় করেছেন সাবেক সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ। তিনি তার এক পাণ্ডুলিপিতে উল্লেখ করেছেন। ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী সেনা গোয়েন্দাদের দল, একদিন আমার সঙ্গে বৈঠক করে। পুরো রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে তারা আমাকে জানায়, একমাত্র শেখ হাসিনা ছাড়া সব রাজনীতিবিদকে কেনা যায়।’ জাতির বৃহৎ অংশ এমনটাই বিশ্বাসও করে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এমন একটা অভিযান চালাবেন তা কেউ কল্পনাই করেনি। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক-জুয়া যখন গাঁও-গেরামে ঢুকে পড়েছে তখনি প্রধানমন্ত্রীর অভিযান। যা ভূয়সী প্রশংসনীয়।
প্রশ্ন, তিনি তার ঘরে থেকে শুদ্ধি অভিযানের যে প্রকল্প হাতে নিয়েছেন, সেই প্রকল্পে তৃণমূল পর্যায়ের অর্থাৎ ৬৪ জেলার সাধারণ ও পুলিশ প্রশাসনের ভেতর-বাইরে কেমন তা কি রয়েছে? বর্তমান সরকারের আমলে দলীয় ব্যানারে যে পরিমাণ অপকর্ম-দুর্নীতি হয়েছে, তার চেয়েও দ্বিগুণ দুর্নীতি লুটপাট হয়েছে, হচ্ছে প্রশাসনিক পর্যায়ে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ইউনিয়ন পর্যায়ের আতিপাতি নেতারাও থানা পুলিশের যোগসাজশে মাদক, জুয়ার স্বর্গরাজ্য কায়েম করেছে। শুধু তাই নয়, একই সঙ্গে বিচার-আচারের নামে নিরীহ মানুষদের কাছ থেকেও চাঁদাবাজিও কম করছে না। গ্রামের মেঠোপথ এখন পিচঢালা, অথচ এই উন্নয়নের অন্তরালে ঠিকাদাররা লাগামহীন দুর্নীতি করায় বছর পার না হতেই পাকা রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্ট ভেঙে যাচ্ছে, খসে পড়ছে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ইমারত। অসংখ্য দুর্জন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের স্টেট্রাসে উল্লেখ করেছেন, দেশের ৬৪ জেলার, ৬৪ জন জেল প্রশাসক, ৬৪ জন পুলিশ সুপার, ৩শ নির্বাচিত এমপি যদি ইচ্ছা করেন তবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একটি দেশের দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব। কিন্তু তা হচ্ছে না কেন? তবে কি পুরো দেশটা মামা-ভাগ্নের রাজ্যে পরিণত হচ্ছে?
বাস্তবতা খুবই দুঃখজনক, তৃণমূল প্রশাসনিক কর্মকর্তারা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের চালাচ্ছেন, নির্দেশ দিচ্ছেন। পৃথিবীর কোনো সৎ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে রাজনীতি করে না। তবে রাজনৈতিক সরকারের একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে মাত্র। বর্তমান সরকারের আমলে যার ব্যত্যয় ঘটছে। এ লক্ষণ শুভ নয়। গত ২ অক্টোবর হোটেল সোনারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১-এ বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘অপকর্মে জড়িত থাকলে দল-পরিবার কাউকে ছাড় নয়।’ তার বক্তব্য থেকে বুঝতে বাকি থাকে না তিনি দেশটা দুর্নীতিমুক্ত করার সংগ্রামে উঠে-পড়ে লেগেছেন।
৩০ সেপ্টেম্বর জাতীয় একটি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি শিরোনাম ছিল, ‘ডিসি-ইউএনওর কর্মমূল্যায়ন হবে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।’ ভালো, তবে সে ক্ষেত্রে সিভিল ও পুলিশ প্রশাসন মিলেমিশেই দেশটাকে যদি রক্ষা করে তবে কোনো কথা নেই। ব্যত্যয় ঘটলেই জাতির কপালে দুর্গতি। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি প্রতিরোধে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছিলেন নির্বাচিত এমপিদের। এর মধ্যে থানায় মামলার ব্যাপারে তদবির না করা, ওসিদের পোস্টিংয়ে এমপিদের হস্তক্ষেপ না করা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টিআরসহ অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্প এমপিদের হাত থেকে না রাখা। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ-বাণিজ্য বন্ধে এমপিদের সভাপতি না রাখা। প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের কৌশল গ্রহণযোগ্য, তবে বাঁশের চেয়ে কঞ্চির দাপট বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এদের নিয়ন্ত্রণে জনপ্রতিনিধিদের খবরদারির প্রয়োজনও রয়েছে।
গণতান্ত্রিক দেশে প্রশাসনিক রাম-রাজত্ব দৃষ্টিকটু এবং অশোভন। তৃণমূলে খোঁজখবর নিলে দেখা যাবে একই স্থানে একই জায়গায় দীর্ঘদিন চাকরি করার সুবাধে সিন্ডিকেট দুর্নীতিতে প্রশাসনের চুনোপুঁটিরাও রাঘববোয়াল সেজেছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার জন্য ৪ হাজার ৬৮২ দিন জেল খেটেছেন। অথচ স্বাধীনতার পর তিনি বেঁচে ছিলেন ১ হাজার ৩১৪ দিন মাত্র। অথচ তিনি ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে। প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতিবিরোধী কঠোর অভিযান চলাকালে পত্রিকায় যখন আমরা দেখি, ‘ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে সাবেক তিন মন্ত্রী, এক সিটি মেয়র ও পাঁচ এমপি জড়িত, প্রধানন্ত্রীর নির্দেশনার অপেক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।’ বা ‘প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা চেষ্টা মামলার আসামি এখন আওয়ামী লীগ নেতা।’ অথবা ‘শেখ হাসিনাকে হত্যা মামলার আসামি মিজানের দেখা মিলল এক পুলিশ কর্মকর্তার অফিসে।’ এ ধরনের সংবাদ সরকারের নীরব ভক্তদের মাঝে যেমন আতঙ্ক-আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি শান্তি প্রতিষ্ঠায় ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূর এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে অবদানের জন্য টেগোর শান্তি পুরস্কার পাওয়ায় শেখ হাসিনার প্রতি কোটি মানুষের নির্বাক শ্রদ্ধা সচেতন মহলে অনুপ্রেরণা। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন হবে। সারাদেশে মুজিববর্ষ পালনের প্রস্তুতি চলছে। মুজিববর্ষ পালনের শুরুতে জাতির জনকের বিদেহী আত্মার শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতির প্রত্যাশা, দেশের সব অপকর্ম নিধনে প্রধানমন্ত্রীর সোচ্চার ভূমিকা আরো কঠিন ও কঠোর হোক। নিপাত যাক বাঁশের চেয়ে কঞ্চির দাপট।

রহিম আব্দুর রহিম : সাংবাদিক ও নাট্যকার ও শিশু সংগঠক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়