×

সাময়িকী

বাংলা সাহিত্যের কলম্বাস

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০১৯, ০৭:৩৪ পিএম

বাংলা সাহিত্যের কলম্বাস

পুথি সংগ্রহের কালে তিনি অনেক বাধা, লাঞ্ছনার শিকার হন। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ভিখারির মতো দাঁড়িয়ে তিনি পুথি সংগ্রহ করতেন। হিন্দুরা তাঁকে পুথিগুলো ধরতে দিত না কারণ তারা এগুলো সরস্বতী পূজায় পূজা করত। তারা পুথির পাতা মেলে ধরত আর আবদুল করিম দূরে দাঁড়িয়ে তা থেকে নোট লিখে নিতেন। হিন্দুদের এমন আচরণে তিনি কিছুই মনে করতেন না।

ইতিহাস মানুষকে ভবিষ্যতের পথ দেখায়। মানুষ বর্তমানে দাঁড়িয়ে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে তার ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে। প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব ইতিহাস রয়েছে। তেমনি সাহিত্যক্ষেত্রেও রয়েছে সাহিত্যের ইতিহাস। বাংলা সাহিত্যেরও রয়েছে একটি সুবর্ণ ইতিহাস। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের পথচলা শুরু চর্যাপদের মাধ্যমে। এটি বাংলা সাহিত্যের আদিযুগের সৃষ্টি। মধ্যযুগে এসে বাংলা সাহিত্যের অনেক নিদর্শন পাওয়া যায়। তবে এসব নিদর্শনের অধিকাংশ স্রষ্টা হিন্দু কবিরা। ফলে দেখা গেল বাংলা সাহিত্য ইতিহাসের মধ্যযুগ পর্যন্ত কোনো মুসলিম কবির রচিত সাহিত্যকর্ম পাওয়া যায় না। সঙ্গত কারণে ধারণা সৃষ্টি হয় বাংলা সাহিত্যের আদি ও মধ্যযুগের সময়কালে মুসলমানদের কোনো অবদান নেই। ফলে মুসলমানদের মধ্যে হীনমন্যতার সৃষ্টি হয় নিজেদের অতীত সাহিত্য ইতিহাস নিয়ে। উনিশ শতকের সপ্তম দশকে অর্থাৎ ১৮৭১ সালের ১১ অক্টোবর পটিয়া উপজেলার সুচক্রদণ্ডী গ্রামের মুসলিম এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মুন্সী আবদুল করিম। পিতা মুন্সী নুরউদ্দীন (১৮৩৮-৭১) এবং মাতা মিসরীজান। আবদুল করিমের জন্মের তিন মাস পূর্বে পিতা মারা যান এবং সতের বছর বয়সে মাকে হারান। এরপর দাদা-দাদির হাতে তিনি বড় হন। চাচা আইনুদ্দীন তার নয় বছরের কন্যা বদীউন্নেসার সাথে এগার বছরের আবদুল করিমের বিয়ে দেন। ১৮৯৩ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জেলার অর্ধাংশে প্রথম মুসলিম ইংরেজি শিক্ষিতের অসামান্য গৌরব অর্জন করেন। অসুস্থতার জন্য উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে না পারলে তিনি চাকরিতে প্রবেশ করেন। কিন্তু জ্ঞান অর্জনের ক্ষুধা তাঁর কখনোই মিটেনি। তিনি নিয়মিত খবরের কাগজ সংগ্রহ করতেন। শৈশব থেকেই তাঁর পরিবারে পুঁথিপাঠের আসর বসত এবং এসব আসরে আবদুল করিম ছিলেন নিয়মিত শ্রোতা। ‘পিরিতি বলিয়া এ তিন আখর ভুবনে নিখিল কে’ এ লাইন শুনে পুঁথি সাহিত্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণ জন্মে। এবং সময়ের সাথে সাথে এ আকর্ষণ বাড়তে থাকে। এমনকি স্বগ্রামের সন্তান কালীশংকর চক্রবর্তীর সাপ্তাহিক ‘জ্যোতি’ পত্রিকায় পুঁথি সংগ্রহের বিজ্ঞাপন দিলে তিনি চাকরিচ্যুত হন। আনোয়ারার এক স্কুলে থাকাকালে তিনি এক গৃহস্থের গোয়াল ঘর থেকে আবিষ্কার করেন একটি পুঁথি। অনেক গবেষণার পর তিনি আবিষ্কার করলেন এটি আলাওল রচিত ‘পদ্মাবতী’। এই আবিষ্কার তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এই আবিষ্কার তাঁর জীবনের এক স্মরণীয় ঘটনা। সারাদিন স্কুলে শিক্ষকতা করে সকাল বিকাল তিনি পুঁথির খোঁজ করতেন। তিনি যখন সাহিত্যচর্চা শুরু করেন তখন মুসলমানদের সাহিত্যক্ষেত্রে অন্ধকার যুগ। মুসলমানরা দ্বিধান্বিত, অজ্ঞতা ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে পিষ্ট। তিনি অনুভব করলেন এই মৃতপ্রায় মুসলমানদের রক্ষার একমাত্র উপায় তাদের অতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার। আর এ লক্ষ্যেই চলতো তাঁর খোঁজাখুঁজি। এ প্রসঙ্গে ড. এনামুল হক বলেন, ‘শিক্ষক আবদুল করিম দুপুর বেলায় শিক্ষকতা করেন ও সকাল বিকালে মুসলমানের প্রাচীন পুঁথি খুঁজেন। এ যেন ক্ষেপার পরশ পাথর খোঁজা। এ খোঁজের অন্ত নেই।’ তখন বটতলায় ছাপা ‘পদ্মাবতী’র বিভিন্ন পুথি পাওয়া যেত। এসব পুথি পড়ে ধারণা করা হতো হয়ত আলাওল শ’খানেক বছর আগের কবি। কিন্তু পাণ্ডুলিপির বিবরণ থেকে আবদুল করিম আবিষ্কার করেন কয়েকশত বছর আগের কবি। এবং এ আবিষ্কারই বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের ইতিহাসকে আবার নতুন করে লিখতে বাধ্য করে। বাংলার প্রাচীন সাহিত্যে মুসলমানদেরও সমান অবদান রয়েছে তা তিনিই প্রমাণ করে দেন। এতে রক্ষা পায় মুসলমানদের মান। এরপর থেকে চলতে থাকে তাঁর পুথি সংগ্রহের অভিযান। এটি এক প্রকারের নেশার মতোই হয়ে গিয়েছিল। চট্টগ্রামের স্কুলসমূহের ইন্সপেক্টরের অফিসে কেরানি পদে চাকরি করা অবস্থায় তিনি পুথির পাণ্ডুলিপির বিনিময়ে বিভিন্ন কাজ করে দিতেন। এমন করে একক চেষ্টায় তিনি মুসলমানদের সহস্রাধিক প্রাচীন পুথি সংগ্রহ করেন। শুধু তাই নয়, তিনি মুসলমানদের পাশাপাশি অনেক হিন্দুর পুথিও সংগ্রহ করে উদারতার পরিচয় দেন। তিনি যেখানে যে পুথি পেয়েছেন সে পুথিই সংগ্রহ করেছেন পরম মমতায়। যক্ষের ধনের মতো সারাজীবন তিনি তা বুকে আগলে রেখেছেন। ১৬ মার্চ ১৯৫১ সালে চট্টগ্রাম সংস্কৃতি সম্মেলনে মূল সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘পুরাতন পুথি কঙ্কালেরই মত। কিন্তু আমি তাহার ভিতর যুগযুগান্তের রক্তধমন ও নিঃশ্বাসের প্রবাহধ্বনি শুনিয়াছি।’ এ পুথি সংগ্রহের কালে তিনি অনেক বাধা, লাঞ্ছনার শিকার হন। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ভিখারির মতো দাঁড়িয়ে তিনি পুথি সংগ্রহ করতেন। হিন্দুরা তাঁকে পুথিগুলো ধরতে দিত না কারণ তারা এগুলো সরস্বতী পূজায় পূজা করত। তারা পুথির পাতা মেলে ধরত আর আবদুল করিম দূরে দাঁড়িয়ে তা থেকে নোট লিখে নিতেন। হিন্দুদের এমন আচরণে তিনি কিছুই মনে করতেন না। বরং এতে তাঁর উৎসাহ আরো দ্বিগুণ বেড়ে যেত। ১৯১৪/১৫ সালে প্রদত্ত এক অভিভাষণে তিনি ৫৯২টি পুথি সংগ্রহের কথা উল্লেখ করেন এবং তিন শতাধিক কবির কথা উল্লেখ করেন। তিনি এমন সব কবি ও তাঁদের রচনার কথা উল্লেখ করেন যা তিনি আবিষ্কার না করলে হয়ত তাঁরা হারিয়ে যেত ইতিহাসের অতল গহ্বরে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবিরা হলেনÑ দ্বিজ রতিদেব, শঙ্কর দাস, ফকির চাঁদ, নিধিরাম আচার্য কবিরত্ন, শ্রীকর নন্দী, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, রামলোচন দাস, কবিরাজ ষষ্ঠীচরণ মজুমদার, সীতারাম, কালীচরণ ভট্ট, আলাওল, দৌলত উজীর, দৌলত কাজী, মুজাফর, সৈয়দ সুলতান, শাহ বদিউদ্দীন, চম্পাগাজী পণ্ডিত প্রমুখ কবি। এবং এসব কবির রচিত গ্রন্থাদি তিনি বিশুদ্ধ বাংলায় রচিত বলে অভিমত দেন। আরো বলেন, এসব কবির আবির্ভাব দু’শত থেকে সাড়ে চারশত বছর পূর্বে।

তিনি আঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখান, এই বাংলার আবহাওয়া ছিল সম্প্রীতির, তিনি ৪৪ জনের অধিক কবির পরিচয় করিয়ে দেন যাঁরা বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করেন। তিনি আলাওলকে মধ্যযুগের রবীন্দ্রনাথ বলে আখ্যায়িত করেন। এ থেকে সহজেই বুঝা যায় কী এক অমূল্য আবিষ্কার আবদুল করিমের হাত ধরে এসেছে। তাঁর অসাধারণ আবিষ্কার এবং এগুলোর সম্পাদনার জন্য চট্টল ধর্মমণ্ডলী ১৯০৯ সালে তাঁকে ‘সাহিত্যবিশারদ’ এবং নদিয়া সাহিত্য সভা ১৯২০ সালে ‘সাহিত্য সাগর’ উপাধি দেয়। বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের অভিভাষণ সমগ্র’ গ্রন্থের সম্পাদক ইসরাইল খান সম্পাদকীয়তে লেখেন, “অষুধ খেয়ে রোগ মুক্তি ঘটলে যেমন তার গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়Ñ তেমনি আবদুল করিমের ‘কেজো সাহিত্যে’র অবদানও জাতির জ্ঞানবানেরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবেন।” বাংলার মুসলমানরা যখন তাদের মাতৃভাষা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত তখনও তিনি ইতিহাসের আলোকে মুসলমানদের বুঝালেন বাংলা ভাষাই বাংলার মুসলমানদের একমাত্র মাতৃভাষা এবং এ ভাষা ছাড়া মুসলমানদের উন্নতি অসম্ভব। তাঁর এ আবিষ্কার এবং বিবিধ বিষয়ের ছয় শতাধিক প্রবন্ধ বাঙালি মুসলমানদের মনে বাঙালিসত্তার উন্মেষ ঘটায়। আসহাব উদ্দীন আহমদ তাঁর ‘আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ’ নামক নিবন্ধে তাঁকে এই অতীত আবিষ্কারের জন্যে কলম্বাসের সাথে তুলনা করেন। সত্যিই তিনি আমাদের বাংলা সাহিত্যের কলম্বাস। তিনি নিরলস চেষ্টায় একের পর এক পুথির মাধ্যমে আবিষ্কার করে আনলেন বাংলা সাহিত্যের অজানা সব ইতিহাস। কোনো এক মনীষী বলেছিলেন, ‘সাহিত্যবিশারদের সাহায্য ছাড়া বাংলা সাহিত্যের প্রকৃত ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়।’ কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই মনীষীকে নিয়ে এখনো পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য গবেষণা হয়নি। তাঁকে নিয়ে এখনো বৃহৎ ও মহৎ গবেষণা হতে পারে। আর এসব গবেষণা আধুনিক প্রজন্মকে সাহিত্যবিশারদ সম্পর্কে জানতে সহায়তা করবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App