×

জাতীয়

বেরিয়ে আসছে যুবলীগ প্রধান ওমর ফারুকের থলের বিড়াল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০১৯, ১০:২৫ এএম

 আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে ঘিরে আলোচনা সমালোচনার শেষ নেই। ঐতিহ্যবাহী এই যুব সংগঠনের চেয়ারম্যান হওয়ার পর ধরাকে সরাজ্ঞান করেন তিনি। তার অহঙ্কার ও দাম্ভিকতায় দলের দুর্দিনের নেতাকর্মীরা সবসময় থাকতেন তটস্থ। বিশেষ পরিবারের জামাতা হওয়ায় সবাই তাকে করতেন সমীহ। এমনকি আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা ও যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ ছিলেন ‘অসহায়’। তার দাপটে অনেক অপকর্মের প্রত্যক্ষ সাক্ষীরাও ছিলেন নীরব। আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযানের ঘোষণা দেয়ার পর থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।

ওমর ফারুকের অপকীর্তি নিয়ে অনেকে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন এমন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বলছেন, ক্যাসিনো, জুয়া, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রকদের গডফাদার ওমর ফারুক ‘দুষ্টের শিরোমণি’। তার মদদে রাজধানীসহ সারাদেশে যুবলীগের কতিপয় নেতাকর্মী বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। যুবলীগের ওয়ার্ড থেকে উপজেলা, জেলা এমনকি কেন্দ্র পর্যন্ত ‘পদবাণিজ্যের’ মাধ্যমে তিনি আয় করেন কোটি কোটি টাকা। এরপর ক্যাসিনো ব্যবসা, ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি সবখান থেকেই তিনি ভাগ নিতেন। ব্যাংক হিসাব তলব ও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আসার পর সবার ধারণা এবার ওমর ফারুক চৌধুরীর পালা।

ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ৫ নম্বর সড়কের ১৫/এ নম্ব^র বাড়ির তৃতীয় তলায় যুব জাগরণ বা যুব গবেষণা কেন্দ্রের কার্যালয়ে প্রায় দিন দুপুরের পর সময় কাটাতেন ওমর ফারুক চৌধুরী। সেখানে এখন বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা। ধানমন্ডির ৮/এ, সড়কের ৭৪ নম্ব^র ইস্টার্ন হেরিটেজ বাড়িতে নেই ওমর ফারুক চৌধুরী। তিনি কোথায়নিশ্চিত তথ্য নেই কারো কাছেই।

র‌্যাব-পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে, ক্যাসিনোকাণ্ডের হোতা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া, যুগ্ম সম্পাদক ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজি এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ, গণপূর্তের ঠিকাদার জি কে শামীম সরাসরি ওমর ফারুকের প্রশ্রয়ে ধরাকে সরাজ্ঞান করে ঢাকায় রাজত্ব করে আসছিলেন। বিনিময়ে ওমর ফারুক মাসে কয়েক কোটি টাকা মাসোহারা পেতেন। তার দুই ছেলের বিয়েতে যুবলীগ নেতা স¤্রাট উপহার দিয়েছেন দুই কোটি টাকার মূল্যের দুটি বিলাস বহুল গাড়ি। আওয়ামী লীগের একজন যুগ্ম সম্পাদক এবং ঢাকার একজন সংসদ সদস্য ছিলেন তার অপকর্মের ছায়াসঙ্গী।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আনিসুর রহমান, ৫ নম্ব^র ওয়ার্ডের মো. আশ্রাফুজ্জামান, ১৩ নম্ব^র ওয়ার্ডের মোস্তফা জামান (পপি), ২০ নম্ব^র ওয়ার্ডের ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ রতন, ২২ নম্ব^র ওয়ার্ডের মো. তরিকুল ইসলাম সজীব, ৩০ নম্ব^র ওয়ার্ডের মো. হাসান পিল্লু ও ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের ময়নুল হক মঞ্জু; ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৭ নম্ব^র ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোবাশ্বের হোসেন চৌধুরী, ২৭ নম্ব^র ওয়ার্ডের ফরিদুর রহমান খান ওরফে ইরান ও ৩৩ নম্ব^র ওয়ার্ডের তারেকুজ্জামান রাজিবকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ওঠা বিতর্ককে পুঁজি করে টাকা হাতিয়েছেন ওমর ফারুক। যুবলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের বিচারের নামে তিনি খুলে বসেন ট্রাইব্যুনাল, নিজেই যার প্রধান! মূলত অভিযোগ নিষ্পত্তির নামে তিনি হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা।

অভিযোগ রয়েছে, ঢাকার পাশে সাভার উপজেলা ও আশুলিয়া থানা যুবলীগের পৃথক দুটি কমিটি দিয়েছেন কোটি টাকার বিনিময়। অথচ এই দুই কমিটির যারা নেতৃত্ব পেয়েছেন তাদের কেউই সংগঠনের ত্যাগী নেতাকর্মী নয়। স্ত্রী হত্যার অভিযোগে বহিষ্কার হয়েছেন উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক সেলিম মণ্ডল। আশুলিয়া থানার আহবায়ক কবির সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাসহ এন্তার অভিযোগ রয়েছে। টাকায় বনিবনা না হওয়ায় একযুগ আটকে আছে সাভার পৌর যুবলীগের কমিটি।

২০১২ সালে ষষ্ঠ কংগ্রেসে ওমর ফারুক চৌধুরী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ার পর পদভেদে ১০ লাখ থেকে শুরু করে ৬০-৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো বিক্রি হয়েছে অর্ধ কোটি টাকা করে। যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমানকে দিয়ে তিনি সব টাকা সংগ্রহ করতেন। অভিযানের মুখে সেই আনিসের এখন হদিস মিলছে না।

চট্টগ্রামে জাতীয় শ্রমিক লীগ নেতা ওমর ফারুক চৌধুরী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর দল বদল করে জাতীয় পার্টির অঙ্গসংগঠন যুব সংহতির চট্টগ্রাম উত্তর জেলা শাখার নেতৃত্বে আসেন। এরপর রাউজানে পৈতৃক জমিতে গড়ে তোলেন ‘রাও গার্মেন্টস’ নামে একটি পোশাক কারখানা। যুব সংহতির রাজনীতি করে অর্থনৈতিকভাবে ভালো অবস্থান তৈরি করেন ওমর ফারুক। এরশাদ সরকারের পতনের পর ফারুকের ব্যবসায় ধস নামতে শুরু করে। তিনি তখন রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান। ১৯৯২ সালে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। ১৯৯৭ সালে সোনালী ব্যাংকের চট্টগ্রামের কে সি দাস রোড শাখা থেকে রাও নিট অ্যাপারেলস ও রাও গার্মেন্টসের নামে ১১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ঋণ নেন ওমর ফারুক। তাতেও সাফল্য পাচ্ছিলেন না।

এর বাইরে আরো একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়ে যান। ওই অবস্থায় ঢাকায় চলে আসেন। ব্যাংকঋণ সময়মতো পরিশোধ না করায় সুদে-আসলে ৪৪ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। তবে যুবলীগ চেয়ারম্যান হওয়ায় তার সম্পত্তি নিলামে ওঠেনি। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ৫ নম্বর সড়কে যুব জাগরণের কার্যালয়ের দেয়ালে ফলকে ছয়টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম দেখা যায়। সেগুলো হচ্ছে- রাও গার্মেন্টস প্রাইভেট লিমিটেড, রাও নিট অ্যাপারেল প্রাইভেট লিমিটেড, রাও ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড, রাও কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, যমুনা ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড, লেক ভিউ প্রপার্টিজ লিমিটেড। নাম সর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ওমর ফারুক চৌধুরী।

সৌদি আরব যুবলীগের একটি সূত্র জানিয়েছে, হজ ও ওমরাহ করতে গিয়ে ওমর ফারুক প্রচুর স্বর্ণালঙ্কার কিনতেন। কিন্তু এসবের কথা তার স্ত্রীকে না জানাতে মক্কা ও মদিনা যুবলীগ নেতাদের বলতেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App