×

মুক্তচিন্তা

জাতি-ধর্মের সম্প্রীতির ভাবনা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০১৯, ০৯:২১ পিএম

বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতা সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় নানা চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। সেখানে সব ধর্মের মূল বাণী ও শিক্ষা নিয়ে যদি সবাই নিজ নিজ দেশ, জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্য বজায় রেখে চলে তাহলে উগ্র হঠকারী কিছু মানুষ খুব বেশিদিন অশান্তি সৃষ্টি করে টিকে থাকতে পারবে না। এখন বড়ই প্রয়োজন ধর্মের মূল বাণীকে নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যেই শুধু নয় অন্যদের মধ্যেও প্রবাহিত করা। জাতিগত বোধকে খণ্ডিত ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে কেউ যেন ধ্বংস করতে না পারে সে ব্যাপারে সচেতন হওয়া।

আজ বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচাইতে বড় উৎসব দুর্গাপূজার বিজয়া দশমী। শত শত বছর ধরে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সমাজের অশান্তি দূরীকরণ এবং শান্তি স্থাপনের প্রার্থনা নিয়ে দুর্গাপূজার ৫ দিনের অনুষ্ঠানাদি পালন করে থাকেন। এ উপলক্ষে তাদের পূজামণ্ডপ তৈরির প্রস্তুতি থাকে দীর্ঘদিনের। এতে আর্থিকভাবে সচ্ছলরা সবচাইতে বেশি অবদান রাখার চেষ্টা করেন। তাদের এই অবদানের ফলে শুধু অনগ্রসর সনাতন জনগোষ্ঠী নয়, বৃহত্তর বাঙালি সমাজের অন্য ধর্মাবলম্বীরাও পূজা অনুষ্ঠানের নানা আয়োজনে আমন্ত্রিত বা স্বেচ্ছায় অংশ নেয়ার সুযোগ লাভ করে থাকেন। সে কারণে দুর্গোৎসব এখন শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না- এটি বৃহত্তর সমাজের জাতিধর্মনির্বিশেষে সবার মিলনমেলায় পরিণত হয়। সেখানে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি নানা ধরনের সাংস্কৃতিক, আলোচনা এবং মিলনমেলার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। ফলে অন্য ধর্মাবলম্বীদের পক্ষে এই আয়োজনে অংশ নিতে কোনো ধরনের ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় না। সে কারণে যুগ যুগ ধরে গ্রামীণ পরিবেশে যখন দুর্গোৎসব পালিত হতো তখন অন্য ধর্মাবলম্বীরাও প্রতিবেশী সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রসাদসহ নানা ভাব বিনিময়ে অংশ নিতেন। এর মাধ্যমে সামাজিক যে বন্ধন তা ধর্মীয় ক্ষেত্রেও নির্বিঘ্নে প্রবাহিত হতো। এখন গ্রামাঞ্চলে পূজামণ্ডপের সংখ্যা আগের তুলনায় হয়তো কিছুটা কম পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু শহর-উপশহরগুলোতে দুর্গাপূজার আয়োজন এখন খুবই জাঁকজকমপূর্ণভাবে হয়ে থাকে। এর কারণ হচ্ছে গ্রামীণ সমাজের চাইতে নাগরিক সমাজ এখন অনেক বেশি শক্তিশালী এবং আর্থিকভাবে সচ্ছল। সে কারণে কোথাও কোথাও পূজামণ্ডপের আয়োজন এখন নানা ধরনের থিম (বিষয়) অবলম্বনে করা হয়ে থাকে। এতে নানা ধরনের প্রত্যাশা মানুষের মধ্যে জেগে ওঠার বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে। এই আয়োজনগুলো অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যেও নানা ধরনের সম্প্রীতি ও মিলনের অভিন্নতাকে বুঝতে সাহায্য করছে। সাধারণভাবে বছরব্যাপী যোগাযোগের বিচ্ছিন্নতা এই সময়ে অনেকটাই যেন কাটিয়ে ওঠার সুযোগ পায়। শুধু বাংলাদেশ ভূখণ্ডে নয়, পশ্চিমবাংলা, বিহারসহ বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব সনাতন ধর্মাবলম্বী বসবাস করছেন তারাও প্রায় একইভাবে দুর্গোৎসবকে একই সময়ে পালন করে থাকেন। সেখানেও অন্য ধর্মাবলম্বী এবং জাতিগত পরিচয়ের মানুষদের ব্যাপক সমাগম ঘটে। বলা চলে সেখানে দুর্গোৎসব এখন বছরের সবচাইতে জমজমাট উৎসবে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে প্রাণের ছোঁয়া অনেকটাই যেন উপচে পড়ছে। বেশিরভাগ মানুষই কেনাকাটা, নানা আয়োজন এবং সমাবেশের মাধ্যমে পূজার দিনগুলো কাটিয়ে দেয়। সারা বছর মানুষের জীবনে কর্মব্যস্ততা এতটাই বেড়ে গেছে যে, সচরাচর আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর আয়োজন খুঁজে পায় না। কিন্তু দুর্গোৎসবে সেটির যেন বাঁধভাঙা জোয়ার ছোটে। মানুষ অকৃপণভরে আনন্দ করে, অর্থ খরচ করে, নিজেদের অনেকটাই পাঁচদিন বিলিয়ে দেয় আনন্দের মধ্যে। এই ধারা বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও অনেকটাই ধারণ করে আছেন। সামাজিক ও আর্থিক নানা প্রতিকূলতা শর্তেও এখানেও মানুষ একইভাবে দুর্গোৎসবকে নিজেদের মধ্যে এবং জাতিগত ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ভাগাভাগি করে পালনের চেষ্টা করে থাকেন। গত কয়েকদিন আমরা দুর্গাপূজার নানা আয়োজনের খবরাখবর গণমাধ্যমের কল্যাণে জেনেছি, অনেকেই সেগুলোতে অংশ নেয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এর ফলে কয়েকটি দিন আমাদের জীবনে এক ধরনের সম্প্রীতির ছোঁয়া লাগিয়ে দিতে পেরেছে। এই ছোঁয়া যত গভীরতর হবে তত জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আমাদের মধ্যে সচেতনতার আবহ তৈরি করবে। ঐতিহাসিকগতভাবে দেখলে আমরা কেউ ইসলাম ধর্মাবলম্বী আবার কেউ সনাতন কেউবা বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হলেও ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, বোধ ও চেতনাগতভাবে আমরা এক ও অভিন্ন বাঙালি। সে কারণেই ধর্মীয় বিশ্বাস আলাদা হলেও জাতিগত বোধ ও ঐতিহ্যে আমাদের রয়েছে সুদূর অতীতের অসংখ্য অনুভূতি ও বন্ধনপ্রীতি। সে কারণেই মুসলমানদের ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আয়োজিত পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে যেমনি অন্য ধর্মাবলম্বী প্রতিবেশীরা অংশ নিয়ে থাকেন তেমনি দুর্গাপূজাতেও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আয়োজনে অন্য ধর্মাবলম্বীরা অংশ নিতে উন্মুখ থাকেন। কিছু কিছু মানুষ হয়তো সাংস্কৃতিক বোধগুলোকে খুব একটা বুঝতে পারেন না, সেভাবে তারা চারপাশের সমাজ ও জগৎকে বোঝার চেষ্টাও করেন না। সে কারণে তারা অন্য ধর্মের আচার, আচরণ, বিশ্বাস ও বহিঃপ্রকাশের ভেতরের মমার্থ ভিন্নভাবে বিশ্বাস করেন। এটি আমাদের মতন পশ্চাৎপদ সমাজে থাকা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। তবে সব ধর্মেরই মূল বাণী হচ্ছে সৎভাবে জীবনযাপন করা, মানুষের উপকার করা, কোনোভাবেই অন্যায় অবিচারকে প্রশ্রয় না দেয়া। মুসলমানদের পবিত্র ঈদে এই কথাগুলোই বারবার উচ্চারিত হয়ে থাকে। একইভাবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজার পাঁচদিনের অনুষ্ঠানে পূজারিরা সেই কথাগুলোই প্রতিধ্বনি করে থাকেন। কারণ সব ধর্মের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষের কল্যাণ, মানুষের সুখ ও শান্তি, সমাজে কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে সেটির জন্য মানুষকে চিন্তাশীল করে তোলা। দুর্গোৎসবে নানা ধরনের আনন্দের বাজনা বাজলেও ভেতরের বন্দনা থাকে মানুষের মধ্যে যেন পশুত্ব বাস না করতে পারে, সেই পশুত্বের বিনাশ সাধন করতেই দেবীর মর্ত্যে আগমন ঘটে। তিনি তা সম্পাদন করে মানুষের জন্য শান্তির জগৎ রেখে দিব্যলোকে চলে যান আবার ফিরে আসার অপেক্ষায় ভক্তদের রেখে যান। দুর্গোৎসবের মধ্য দিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এই শিক্ষা নিয়েই পরিবারে, সমাজে ফিরে আসে। সমাজ বহু মত, বহু পথ, বহু বিশ্বাস ও বহু ধর্মের আচার-আচরণে গঠিত। এর প্রতিটি অংশই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাউকে পেছনে রেখে গোটা সমাজ এগোতে পারবে না। সে কারণেই প্রয়োজন সৌহার্দ্য এবং সম্প্রীতির। তাহলেই সমাজে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতা সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় নানা চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। সেখানে সব ধর্মের মূল বাণী ও শিক্ষা নিয়ে যদি সবাই নিজ নিজ দেশ, জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্য বজায় রেখে চলে তাহলে উগ্র হঠকারী কিছু মানুষ খুব বেশিদিন অশান্তি সৃষ্টি করে টিকে থাকতে পারবে না। সব ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদ, উগ্র ধর্মান্ধতা মানব কল্যাণের চাইতে মানুষের জীবন, সম্পদ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সে কারণে এখন বড়ই প্রয়োজন ধর্মের মূল বাণীকে নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যেই শুধু নয় অন্যদের মধ্যেও প্রবাহিত করা। জাতিগত বোধকে খণ্ডিত ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে কেউ যেন ধ্বংস করতে না পারে সে ব্যাপারে সচেতন হওয়া। যখনই যে সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব সমাগত হবে তার সঙ্গে যেন অন্যরাও যুক্ত হতে পারে সেই পরিবেশ যত বাড়বে তত মানুষের মধ্যে মানবিক গুণাবলি বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ পাবে। এখন দুর্গোৎসব শেষ পর্যায়ে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এ কয়েকদিনের আনন্দ উৎসবের পাশাপাশি আরাধনার মর্মবাণীকে ধারণ করে সামনের দিনগুলোতে এগিয়ে যাবেন সেটিই তাদের কামনার বিষয়। আমরাও চাই তাদের এই কামনা ও বাসনা গোটা বাংলাদেশ এবং প্রতিবেশী দেশের বাঙালিদের জীবনেও একইভাবে বহমান থাকবে।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App