×

জাতীয়

দুবাই বসেই ঢাকার অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০১৯, ০১:৩০ পিএম

দুবাই বসেই ঢাকার অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ

জিসান

ক্যাসিনোকাণ্ডে আলোচিত ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাইয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের রেড নোটিসধারী এ শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ডেরার ফ্ল্যাট থেকে আটক করে দুবাই পুলিশ তার নেটওয়ার্ক ও বিনিয়োগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। ঢাকা থেকে পালিয়ে তিনি নাম পাল্টে নিয়েছিলেন ভারতীয় পাসপোর্ট। হাতে ছিল ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দেশ ডমিনিকান রিপাবলিকের পাসপোর্টও।

দুবাইয়ে বসে ছোট ভাই শামীম ও কয়েকজন ক্যাডার নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতেন ঢাকার ঠিকাদারি, ক্যাসিনো ব্যবসা ও অপরাধ জগৎ। পাশাপাশি সেখানে জমিয়ে তোলেন গাড়ি ও হোটেল ব্যবসা। ঢাকার ক্যাসিনোর নিয়ন্ত্রক অনেক যুবলীগ নেতার ঘনিষ্ঠ, দুই পুলিশ কর্মকর্তা খুনসহ বহু অপকর্মের হোতা জিসানকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার চেষ্টা শুরু করেছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স।

এদিকে দুবাই পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে ছাড়াতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে তার সহযোগীরা। দুবাইয়ে থাকা আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী টিএনটি নাদিম এতে সহযোগিতা করছে তাকে। এরই মধ্যে সে এরাবিয়ান সিআইডির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে। টিএনটি নাদিম ছাড়াও হত্যা মামলার আসামি শাকিলসহ বেশ কয়েকজন চেষ্টা করছে জিসানকে পুলিশের হাত থেকে ছাড়াতে। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো) মহিউল ইসলাম এ প্রসঙ্গে জানান, জিসানকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে দুই মাস আগে থেকে ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো দুবাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে।

গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবি থেকে জিসানের সাম্প্রতিক ছবি ও তথ্য পাঠানোর পর তারা (দুবাই এনসিবি) জিসানকে শনাক্তের কাজ শুরু করে। এরপর দুবাই এনসিবি ঢাকাকে জানায়, তারা জিসানকে নজরদারির মধ্যে রেখেছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য এনসিবি দুবাই জিসানের সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য চায় ও ঢাকাকে জানানো হয়, জিসান ভিন্ন নাম ব্যবহার করে দুবাইতে আছে। একই সঙ্গে অন্য দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করছে।

এ তথ্য জানার পর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মাধ্যমে সেগুলো যাচাই করা শুরু হয়। এআইজি মহিউল ইসলাম বলেন, আমরা জানতে পারি জিসান বর্তমানে ‘আলী আকবর’ নামে দুবাইয়ে আছে ও তার পাসপোর্টটি ভারতের। এই পাসপোর্ট যাচাইয়ের কাজ শুরু করার পর এনসিবি দুবাই ফের জানায়, জিসানের কাছে ডমিনিকান রিপাবলিকের পাসপোর্টও রয়েছে। পরবর্তীতে ডমিনিকান রিপাবলিকের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি। তারা জানায়, আমরা এ নামে কোনো পাসপোর্ট দেখছি না। এরই মধ্যে জিসানের ব্যাপারে ইন্টারপোলের রেড এলার্ট নোটিসটি আপডেট করা হয়।

এআইজি মহিউল ইসলাম আরো বলেন, বিভিন্নভাবে যাচাইয়ের কাজ চলার সময় জিসানের ব্যাপারে থাকা রেড অ্যালার্টটি আপডেট করতে বলা হলে ইন্টারপোলের মাধ্যমে সেটা আপডেট করি। আপডেটে আরো কিছু মামলা যুক্ত করা হয়। এরমধ্যে এনসিবি দুবাই জিসানের আপডেট সম্পর্কে জানতে চায়। আমরা তখন ডিবির সঙ্গে বৈঠক করি। ডিবি আমাদের জানায়, সে এখনো সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তার ভাইও সেখানে বসে অপরাধ করছে। এরপর ডিবি কয়েকটি নম্বর দেয়। এনসিবি দুবাই সেগুলো ট্র্যাক করে।

সম্প্রতি তার দুজন সহযোগী ঢাকায় ধরা পড়ে। এসব তথ্যও আমরা দুবাইকে জানাই। সর্বশেষ বুধবার রাতে দুবাইয়ে জিসানকে গ্রেপ্তারের পর এনসিবি দুবাই ঢাকাকে জানায়। পরদিন বৃহস্পতিবার যাচাই করে জিসানের গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। মহিউল ইসলাম বলেন, দুবাই এনসিবি জিসানকে গ্রেপ্তারের পর আমাদের জানিয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে আইপি ফোনে যোগাযোগ করি এবং যাচাই করে নিশ্চিত হই গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিই জিসান। বৃহস্পতিবার আমরা নিশ্চিতভাবে জানলাম জিসান গ্রেপ্তার হয়েছে। তাকে গ্রেপ্তার করার পর দুবাইয়ে জুডিশিয়াল কাস্টডিতে নেয়া হয়েছে।

এদিকে জিসানকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচার কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে মহিউল ইসলাম বলেন, গ্রেপ্তারের পর আমাদের কাছে অনেক ডকুমেন্ট চেয়ে চেকলিস্ট পাঠিয়েছে দুবাই। মামলা সংক্রান্ত পেপারগুলো ডিবি আমাদের দেবে। এরপর মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে লিগ্যাল অ্যাগ্রিমেন্ট করার চেষ্টা করা হবে। আমরা আশা করি তাকে শিগগিরই দেশে এনে বিচার কাজ শুরু করতে পারব। দীর্ঘদিন জিসানের পেছনে লেগে থাকার কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে।

বাংলাদেশ পুলিশের এআইজি (মিডিয়া এন্ড পিআর) মো. সোহেল রানা বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে এনসিবি শাখার উদ্যোগে ও এনসিবি (ইন্টারপোল) দুবাইয়ের সহযোগিতায় শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এনসিবি দুবাই ৩ অক্টোবর বিষয়টি আমাদের নিশ্চিত করেছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে তাকে দ্রুত বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হবে।

সম্প্রতি ক্যাসিনোকাণ্ডে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, গণপূর্তে ঠিকাদারির নাটেরগুরু জি কে শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার পর জিসানের নাম নতুন করে আলোচনায় আসে। শামীম ও খালেদকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করে জিসানের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তখনই ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে নতুন নামে জিসানের দুবাইয়ে অবস্থানের বিষয়ে নিশ্চিত হন তারা। তদন্তে ঢাকার ক্যাসিনো ও ঠিকাদারি কাজে জিসান ও ক্যাডারদের আধিপত্যের তথ্য পেয়েছে পুলিশ।

আধিপত্য নিয়ে জিসানের সঙ্গে খালেদের বিরোধ দেখা দিলে দুবাইয়ে একাধিক বৈঠক হয়। সেখানে জিসান, খালেদ ছাড়াও জিকে শামীম ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী স¤্রাট ছিলেন। বৈঠকে বিরোধ মিটলেও পরে আবার তা চাঙ্গা হয়। তখন জিসান তার ক্যাডারদের কাছে দুটি একে-২২ রাইফেল চালান পাঠান জি কে শামীমকে হত্যার জন্য। দুবাইয়ে জিসানকে আটকে ঢাকায় একে-২২ রাইফেলসহ আটককৃত দুই ব্যক্তির দেয়া তথ্য সহায়ক হিসাবে কাজ করেছে বলে জানা গেছে।

ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের সূত্র মতে, বুধবার দিবাগত মধ্যরাতে জিসানকে গ্রেপ্তারের পর বৃহস্পতিবার দিনভর নাদিম-শাকিলরা বিভিন্ন জায়গায় লবিং শুরু করে। এরাবিয়ান সিআইডির সঙ্গে অনেক আগে থেকেই ভালো সম্পর্ক থাকায় তাদের মাধ্যমেই জিসানকে ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। এ জন্য জিসানের ছোট ভাই শামীম মালয়েশিয়া থেকে ৩ অক্টোবর বিকেলে দুবাইয়ে পৌঁছে। গত সপ্তাহেই শামীম দুবাই থেকে মালয়েশিয়ায় এসেছিল। ভাইয়ের গ্রেপ্তারের খবর জানতে পেরে আবার ছুটে গেছে সে। বৃহস্পতিবার দুবাইয়ের স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় নাদিম, শামীম ও শাকিল বৈঠক করে।

বৈঠকে জিসানকে ছাড়াতে যত টাকা দরকার হোক বা যত বড় লবিস্ট নিয়োগের প্রয়োজন হোক না কেন তা করতে নাদিমকে অনুরোধ করে শামীম। জিসানকে যাতে কোনোভাবেই বাংলাদেশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা না হয় সে জন্য বাংলাদেশেও যোগাযোগ করে তারা। প্রয়োজনে জার্মানি থেকেও সহায়তা নেয়ার কথা বলে নাদিম। পুলিশের কাছে যদি হস্তান্তর করতেই হয় তাহলে যেন জিসানকে ভারতে পাঠানো হয়। যুক্তি হিসেবে তাদের দাবি, যেহেতু জিসানের বাংলাদেশি কোনো পাসপোর্ট নেই তাই তাকে ভারতেই পাঠানো হোক। জিসানের কাছে ভারতীয় পাসপোর্ট রয়েছে। ভারতীয় পাসপোর্টে জিসানের নাম আলী আকবর চৌধুরী।

সূত্র মতে, বুধবার দুবাইয়ের স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় জিসান জার্মানি থেকে দুবাইয়ে আসেন। দুবাই ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরের ৩ নম্বর টার্মিনালের গেট দিয়ে বের হন জিসান। এ সময় বাইরে দাঁড়ানো ছিল টিএনটি নাদিম ও শাকিল। নিশান পেট্রোল গাড়িতে করে জিসানকে নিয়ে যায় তারা। জিসানের গাড়ির শো রুমের ম্যানেজার শাকিল। তার বাড়ি ঢাকার ওয়ারীতে। এক সময় ছাত্রলীগ করত সে। ওয়ারীর রাজিব হত্যা মামলার আসামি শাকিল। নাদিমের কাছের লোক হওয়ায় শাকিল দুবাইয়ে জিসানের গাড়ির শোরুম দেখা শোনার দায়িত্ব পায়। দুবাইয়ের ডেরাতে জিসানের গাড়ির শোরুম আর বুর্জ খলিফা টাওয়ারে স্বর্ণের দোকান রয়েছে। ডেরাতে মস্কো নামের একটি নাইট ক্লাবও পরিচালনা করে জিসান।

সূত্র আরো জানায়, বুধবার সন্ধ্যায় গাড়ির শোরুমে বসে টিএনটি নাদিম ও জিসান বৈঠক করেন। এরপর অনেক রাতে বাসায় ফেরেন তারা। দুবাইয়ের ডেরায় জিসানের অত্যাধুনিক ভিআইপি ফ্ল্যাট রয়েছে। সেই ফ্ল্যাট থেকেই জিসানকে গভীর রাতে দুবাই পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তবে তাকে কোথায় রাখা হয়েছে তা আপাতত কেউ জানে না। জিসান যখন জার্মানি থেকে ফ্লাইটে এসে দুবাই এয়ারপোর্টে নামেন তখন থেকেই ইমিগ্রেশন পুলিশ ফলো করতে থাকে তাকে।

প্রসঙ্গত, বনানী, গুলশান, বাড্ডা, মতিঝিলসহ রাজধানীর কয়েকটি এলাকার ত্রাস জিসান ১৯৭০ সালে ঢাকার খিলগাঁওয়ে জন্ম নেন।২০০৩ সালের ১৪ মে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবির দুই ইন্সপেক্টরকে সরাসরি হত্যা করে আলোচনায় আসেন জিসান। দীর্ঘ সময় আত্মগোপনে থেকে ২০০৫ সালে জিসান ভারতে চলে যান। সেখানে ২০০৯ সালে কলকাতা পুলিশের হাতে আটক হন। সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার পর কলকাতায় বসেই নিয়ন্ত্রণ করতেন ঢাকার চাঁদাবাজি।

জিসান ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে দুবাই যান বছর দুয়েক আগে। পরে সেখান থেকেই ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। সেখান থেকে ভারতের পাসপোর্ট ব্যবহার করে জার্মানিতে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পান। সেখান থেকে মূলত ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে বেড়াতেন জিসান। মালিবাগ, মগবাজার, খিলগাঁও এলাকার আলোচিত সন্ত্রাসী জিসানের বিরুদ্ধে ঢাকায় একাধিক হত্যা ও চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে। ২০০১ সালে সরকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশ করে। এ তালিকায় ওপরের দিকে ছিল জিসানের নাম।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App