×

জাতীয়

সেলিম প্রধানের টাকার পাহাড়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০১৯, ১০:৫৯ এএম

সেলিম প্রধানের টাকার পাহাড়
অনলাইনে ক্যাসিনো ব্যবসার মূল হোতা সেলিম প্রধান দেশে-বিদেশে টাকার পাহাড় গড়েছেন। অর্জিত টাকার বড় অংশ পাঠাতেন লন্ডনে। বিএনপির অনেক নেতার ঘনিষ্ঠ সেলিম লন্ডনে কার কাছে টাকা পাঠাতেন সে ব্যাপারে এখনো মুখ খোলেননি। এ ছাড়া টাকা পাঠাতেন থাইল্যান্ড, কোরিয়া ও জাপান। তার তিন স্ত্রীর একজন থাকেন থাইল্যান্ডে। সোমবার আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এ রকম আরো কিছু চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন সেলিম। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাবের ১৮ ঘণ্টার অভিযানে গুলশান-বনানীর দুই বাসায় পাওয়া গেছে নগদ ২৯ লাখ টাকা, ৮ কোটি টাকার চেক, ২৩টি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা, ১২টি পাসপোর্ট, দুটি হরিণের চামড়া ও ৪৮ বোতল বিদেশি মদ। এ ছাড়া মিলেছে অনলাইন ক্যাসিনোর জমা হওয়া টাকার একটি গেটওয়ের সন্ধান। যেখানে ৯ কোটি টাকা লেনদেনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় সেলিমের তিন সহযোগী আখতারুজ্জামান, মাসুম ও রোমানকে আটক করেছে র‌্যাব। তা ছাড়া সেলিম প্রধানের সব ব্যাংক হিসাব স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ঘটনায় গুলশান থানায় দুটি মামলা করেছে র‌্যাব। র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরোয়ার বলেন, সেলিম অনলাইন ক্যাসিনো জুয়ার সঙ্গে জড়িত। তিনি ক্যাসিনোর অর্জিত আয় বিদেশে পাচার করে আসছিলেন। হরিণের চামড়া রাখায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে তাকে ৬ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এই রায়ের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাতে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অন্যান্য অপরাধে তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। র‌্যাব-১-এর কমান্ডিং অফিসার (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম মঙ্গলবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, অনলাইনের ক্যাসিনো থেকে অর্জিত টাকার একটি অংশ লন্ডনে যেত। তবে লন্ডনে কার কাছে যেত, সেটি জানতে তদন্ত চলছে। গুলশানে ও বনানীতে সেলিমের অফিসে অভিযানের বিষয়ে র‌্যাব অধিনায়ক বলেন, র‌্যাব-১-এর একটি সাইবার মনিটরিং সেল রয়েছে। আমরা এর মাধ্যমেই জানতে পারি যে, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অনলাইনে ক্যাসিনো গেমিংয়ে জড়িত রয়েছে। এরপর তা নিয়ে আমরা অনেক দিন ধরেই কাজ করছিলাম। এর হোতাও আমাদের নজরদারিতেই ছিল। সোমবার জানতে পারি সেই মূল হোতা সেলিম প্রধান টিজে-৩২২ বিমানে বাংলাদেশ ছেড়ে থাইল্যান্ডে যাচ্ছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা শাহজালাল বিমানবন্দরে গিয়ে ফ্লাইট থেকে তাকে নামিয়ে আনতে সক্ষম হই। সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, আটক সেলিম প্রধান খুব চতুর। বিমান থামার সময়ই হয়তো তিনি বুঝতে পারেন তা কেন থামানো হলো? সে সময়ই তিনি ফ্লাইটের অন্য একজনের সঙ্গে আসন পরিবর্তন করেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। তাকে নিয়ে গুলশান-২ এ তার বাসা ও কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়। এ সময় তার কার্যালয় থেকে ৪৮টি বিদেশি মদের বোতল, বাংলাদেশি নগদ মোট ২৯ লাখ ৫ হাজার ৫০০ টাকা (গুলশান থেকে ৭ লাখ ৯৮ হাজার ও বনানী থেকে ২১ লাখ ২০ হাজার) উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়াও ২৩টি বিভিন্ন দেশের বৈদেশিক মুদ্রা যার আনুমানিক মূল্য ৭৭ লাখ ৬৩ হাজার ২৩ টাকা, মোট ১২টি পাসপোর্ট, ১৩টি ব্যাংকের মোট ৩২টি চেক বই, অনলাইন গেমিং সংরক্ষণের একটি বড় সার্ভার, চারটি ল্যাপটপ ও দুটি হরিণের চামড়া উদ্ধার করি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সেলিম প্রধান জানায়, তার জন্ম ১৯৭৩ সালে ঢাকায়। সে তার ভাইয়ের হাত ধরে ১৯৮৮ সালে জাপানে চলে যায়। সেখানে অন্যান্য জাপানির সঙ্গে গাড়ি ব্যবসায় নিয়োজিত হয়। পরবর্তীতে ওই জাপানিদের সঙ্গে সে থাইল্যান্ডে আসে এবং সেখানে শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে ব্যবসা শুরু করে। সেখানেই মি. দু নামে একজন কোরিয় নাগরিকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তিনি সেলিম প্রধানকে একটি কনস্ট্রাকশন ব্যবসার প্রলোভন দেখানোসহ বাংলাদেশে একটি অনলাইন ক্যাসিনো চালুর পরামর্শ দেন। এরপরই পি-২৪ ও টি-২১ নামে দুটি গেমিং সাইট খুলে অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালনা শুরু করে সে। আমরা তার সব নথিপত্র ও চুক্তিগুলো দেখেছি। যার মধ্যে ৫০-৫০ অংশীদার উল্লেখ রয়েছে। অনলাইন গেমিংটা কী? এ বিষয়ে এই র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারে সফটওয়্যার দিয়ে অনলাইনে ভার্চুয়াল ক্যাসিনো খেলা হতো। বি-২ সহ বিভিন্ন ধরনের খেলা ছিল। সেগুলো কীভাবে খেলা হবে বাংলা ভাষায় প্রপার ইনস্ট্রাকশন সহকারে বর্ণনা করা হয়েছে সফটওয়্যারে। খেলতে হলে তাদের সদস্য হতে হয়। একই সঙ্গে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই যে, প্রধান গ্রুপের যে ওয়েবসাইট সেখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে one of the first provider of b2b live casino solution in Bangladesh. এটাই প্রমাণ করে যে, সে বাংলাদেশে ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এই গেম খেলতে হলে আপনাকে একটা নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। এটি বিকাশের হতে পারে, নগদ হতে পারে বা অন্যান্য ভিসা কার্ডের হতে পারে, মাস্টার কার্ড হতে পারে। আপনি যে অ্যাকাউন্টটি খুলবেন সেই অ্যাকাউন্টে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা প্রদান করা সাপেক্ষে ওই গেমটি খেলতে পারবেন। যদি আপনি গেমটি জেতেন তাহলে ওই অ্যাকাউন্টে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা আসবে। এটি একটি গেটওয়ে, যার মাধ্যমে আপনার বা গ্রাহকের যে টাকা প্রদান করা হচ্ছে বিভিন্ন মোবাইলের মাধ্যমে সে টাকাগুলো এসে একত্রিত হচ্ছে এই গেটওয়েতে। পরবর্তী সময় এই গেটওয়ে থেকে তিনটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট আমরা পেয়েছি। সেখানে এই টাকাগুলো আসত এবং সপ্তাহে একদিন তারা সব টাকা ওই তিনটি ব্যাংকে পাঠাত। ব্যাংকগুলো হলো ব্যাংক অব সিলন, যমুনা ও কমার্শিয়াল ব্যাংক। গেটওয়ের যে কথা বলেছি, সব গ্রাহকের টাকা কিন্তু জমা হতো এতে। এই গেটওয়ে সমীক্ষা করে দেখা গেছে, এক মাসে একটি গেটওয়েতে জমা হয়েছে প্রায় ৯ কোটি টাকা। এটা মাসে বা বছরে হিসাব করলে দেখা যাবে কী পরিমাণ টাকা তারা আয় করত। যার বেশিরভাগ পাচার করেছেন তারা। আরো কিছু গেটওয়ে আসে, সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। র‌্যাব অধিনায়ক বলেন, সেলিম বর্তমানে কারাগারে থাকা ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের ক্লোজ ফ্রেন্ড (ঘনিষ্ঠ) ছিলেন। তিনি মামুনকে একটি বিএমডব্লিউ গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। মামুন কারাগারে যাওয়ার পর থেকে এগুলো ব্যবহার করছিলেন সেলিম প্রধানই। এ ছাড়া সেলিম বিভিন্ন সময় লন্ডনে টাকা পাঠিয়েছেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগে আমরা তাকে গ্রেপ্তার করেছি। লন্ডনে তিনি কাকে টাকা পাঠাতেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের অধিনায়ক বলেন, লন্ডনে কোথায় পাঠাতেন, তদন্ত করে জানাব। তিনি বলেন, আমরা তার সহযোগী আক্তারুজ্জামানকে বনানী থেকে গ্রেপ্তার করেছি। আক্তারুজ্জামান তার গেমিং সাইটটি চালাত ও টাকা সংগ্রহ করে অন্য ব্যাংকে জমা করত। এরপর কোরীয় নাগরিক এসে এই টাকাগুলো নিয়ে যেত। এটি সরাসরি মানি লন্ডারিং আইনের লঙ্ঘন। তাকে চারটি অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রথমত মানি লন্ডারিং, মাদকদ্রব্য, ফরেন কারেন্সি অ্যাক্ট এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের লঙ্ঘন। র‌্যাব সূত্র জানায়, অনলাইনে বিশ্বের সুপরিচিত ক্যাসিনোগুলোর সঙ্গে জুয়াড়িদের যুক্ত করার কাজ করতেন সেলিম। তিনি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ‘প্রধান গ্রুপ’-এর কর্ণধার। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং এন্ড পেপারস লিমিটেড, পি২৪ ল’ ফার্ম, এইউ এন্টারটেইনমেন্ট, পি২৪ গেমিং, প্রধান হাউস ও প্রধান ম্যাগাজিন। এর মধ্যে পি২৪ গেমিংয়ের মাধ্যমে তিনি জুয়াড়িদের ক্যাসিনোয় যুক্ত করতেন। সেলিমের কোম্পানির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, পি২৪ গেমিং শুরুতে বিনোদনমূলক সফটওয়্যার তৈরি ও প্রকাশ করত। এখন তারা এশিয়ায় দ্রুত বড় হতে থাকা ক্যাসিনো কারবারে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। এশিয়ার লাইভ ক্যাসিনো মার্কেটে প্রতিষ্ঠানটি যেন এক নম্ব^রে যেতে পারে, সেই চেষ্টা আছে তাদের। পি২৪-এর সঙ্গে বাংলাদেশে ১৫০টি অপারেটর এবং ক্যাসিনো যুক্ত আছে। অনলাইনে বিশ্বের সবচেয়ে প্রচলিত ক্যাসিনোর সঙ্গে যুক্ত করে দেয়ার ক্ষমতা আছে তাদের। জুয়াড়িদের মুঠোফোনে লাইভ ক্যাসিনোতে যুক্ত করে দেয়ার সুবিধা তারা এনেছে গত বছরের ৭ ডিসেম্বর। প্রধান গ্রুপের কোম্পানি জাপান বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং এন্ড পেপার্সের নাম রয়েছে ঢাকা চেম্বারের সদস্যদের তালিকায়। বেশ কয়েকটি স্পা ও বিউটি স্যালুন, এমনকি ল’ ফার্মও রয়েছে সেলিমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। জানা গেছে, সেলিম প্রধানের সঙ্গে আর্থিক খাতের অনেকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তার জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং এন্ড পেপারসে বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই ছাপা হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নথিপত্রও ছাপানো হয়। তার এই প্রতিষ্ঠান রূপালী ব্যাংকের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের একটি। ২০১৮ সালে ঋণটি পুনঃতফসিল করা হয়। সেলিমের কাছে ব্যাংকের পাওনা প্রায় ১০০ কোটি টাকা। একাধিক গোয়েন্দার তথ্য মতে, টেন্ডারবাজি ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র চোরাচালানের সঙ্গে সেলিম প্রধানের সম্পৃক্ততা রয়েছে। সেলিম বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App