×

জাতীয়

পাথর তুলেই শত কোটি টাকা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০১৯, ১২:০৪ পিএম

পাথর তুলেই শত কোটি টাকা
আদালতের রায়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ‘বোমা মেশিন’ দিয়ে সিলেটের বিভিন্ন পাথর কোয়ারিতে পাথর উত্তোলনের মাধ্যমে চলছে পরিবেশ ধ্বংসের মহোৎসব। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব দেখিয়ে রাঘববোয়ালরা পাথরখেকোদের প্রশ্রয় দেয়ার বিনিময়ে প্রতি মাসে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। বিনিময়ে দলের নামে চলে লুটতরাজ। বড় নেতাদের প্রশ্রয় থাকায় স্থানীয় প্রশাসন কিংবা সাধারণ মানুষ ভয়ে প্রতিবাদ করে না। তবে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সরাসরি নির্দেশনায় চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চলমান অভিযানের পরিধি আরো বাড়বে এবং এবার কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। এ অবস্থায় পাথর উত্তোলনের নামে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে অবৈধভাবে সরকারি সম্পদ লুট করে রাতারাতি কয়েকশ কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া রাঘববোয়ালদের আইনের আওতায় আনার দাবি উঠেছে সচেতন মহল থেকে। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ, গোয়াইনঘাটেন জাফলং ও বিছানাকান্দি, জৈন্তাপুরের শ্রীপুর ও কানাইঘাটের লোভাছড়ায় ৫টি পাথর কোয়ারি রয়েছে। কোটি কোটি টাকা লগ্নী করা এসব কোয়ারিতে কাজ করেন হাজার হাজার শ্রমিক। একসময় বৈধভাবে খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে লিজ নিতেন ইজারাদাররা। লিজের শর্ত মেনে পাথর তুলতেন শ্রমিকরা। আইনি জটিলতায় লিজ বন্ধ হলেও থেমে থাকেনি পাথর উত্তোলন। পরিবেশ বিধ্বংসী বোমা মেশিনে অপরিকল্পিত পাথর উত্তোলনের কারণে কোয়ারিগুলো আজ ধ্বংসের ধারপ্রান্তে। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের সময় টিলা ধসে কিংবা মাটি চাপায় প্রায়ই ঘটছে প্রাণহানি। গত তিন বছরে পাথর কোয়ারিতে কাজ করার সময় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৭০ জন শ্রমিক। এভাবে শ্রমিকদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়ে যারা রাতারাতি ধনকুবের বনে যাচ্ছেন, তারা সবসময়ই রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেননা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত রাঘববোয়ালদের বেশিরভাগই স্থানীয় উপজেলা কিংবা ইউনিয়ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা। এ ছাড়া খোলস পাল্টে সরকারি দলের সঙ্গে সক্ষ্যতা গড়ে বিএনপি-জামায়াতের স্থানীয় কিছু নেতাও যুক্ত রয়েছেন এর সঙ্গে। ফলে কোনোভাবেই অবৈধ পাথর উত্তোলন ও প্রাণহানি রোধ করতে পারছে না প্রশাসন। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো আইনি ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। তা ছাড়া পাথর তোলার এই অবৈধ ব্যবসা চালু রাখতে পরিবেশ অধিদপ্তর আর পুলিশকে প্রতি মাসে বড় অঙ্কের চাঁদা দেয়ার অভিযোগও রয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়কারী এডভোকেট শাহ শাহেদা আখতার ভোরের কাগজকে বলেন, সিলেটের বিভিন্ন কোয়ারিতে বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনের ওপর উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এরপরও সংশ্লিষ্টরা এটা মানছে না। শাহেদ আখতার অভিযোগ করে বলেন, টাস্কফোর্সের অভিযানে অনেক সময় বোমা মেশিন পোড়ানো হচ্ছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যোগসাজশ এবং এ ব্যাপারে কিছু রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতার কারণে তা বন্ধ করা যাচ্ছে না। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ দেশের বৃহত্তম পাথর কোয়ারি। ‘বোমা মেশিন’ দিয়ে ভোলাগঞ্জের কোয়ারিতে পাথর উত্তোলনের মাধ্যমে চলছে পরিবেশ ধ্বংসের মহোৎসব। রোপওয়ের সংরক্ষিত এলাকায় প্রশাসনের নাকের ডগায় শতাধিক বোমা মেশিন কিভাবে চলছে তা নিয়ে বিস্ময়ের শেষ নেই স্থানীয়দের। সরেজমিনে দেখা গেছে, ভোলাগঞ্জ রোপওয়ের সংরক্ষিত এলাকা, ধলাই ব্রিজ সংলগ্ন ভোলাগঞ্জ গুচ্ছগ্রাম, লিলাই বাজার এমনকি কালাইরাগ গ্রাম এলাকায় শতাধিক বোমা মেশিন স্থাপন করে অবাধে চলছে পাথর উত্তোলন। লাগাতার পাথর উত্তোলনের ফলে ধলাই ব্রিজ, কলাবাড়ী, কালীবাড়ি, ভোলাগঞ্জ আদর্শ গ্রাম, ভোলাগঞ্জ রোপওয়ের সংরক্ষিত এলাকা, শাহ আরেফিন টিলা, মুক্তিযোদ্ধা আদর্শ গ্রাম, কালাইরাগ, দয়ারবাজার ও নতুন বাজার হুমকির মুখে পড়েছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারিতে একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে যুবলীগ নেতা ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান শামীম আহমেদের। দুই বছর আগে শামীমসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে পরিবেশ ধ্বংস ও সরকারি সম্পদ লুটের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেয় জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে অবৈধ কর্মকাণ্ডের হোতা হিসেবে শামীমকে দায়ী করা হয়। এছাড়া তার ভাই বিল্লাল হোসেন দুই ছেলে কেফায়েত ও মঈনউল্লাহকে নিয়ে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদন দাখিলের পর পরিবেশ আইনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে পরিবেশ অধিদফতর। তারপরও বন্ধ হয়নি বোমা মেশিনে পাথর উত্তোলন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুরুর দিকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত না থাকলেও ‘অবৈধ টাকার জোরে’ আওয়ামী লীগ নেতা বনে যান শামীম আহমেদ। বিগত উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তার নির্দেশেই চলে ভোলাগঞ্জের পাথর রাজ্য। প্রশাসনের নাকের ডগায় অবৈধ যন্ত্রদানব বসিয়ে পাথর উত্তোলন করে শামীম বাহিনী। বিনিময়ে প্রতিদিন অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি জাফলংও পাথরখেকোদের গ্রাসে এখন ধ্বংসস্ত‚প। স্থানীয়রা এর জন্য দায়ী করেন জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলীকে। পাথর উত্তোলন নির্বিঘ্ন করার বিনিময়ে প্রতিদিন বোমা মেশিনের মালিকদের কাছ থেকে তিনি হাতিয়ে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। এভাবেই গত আট বছরে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন লিয়াকত আলী। যদিও ২০০৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থিতার সময় তিনি যে হলফনামা জমা দেন, তাতে তার সম্পদের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ টাকার নিচে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর আগেই অবশ্য পাথর কোয়ারিতে আধিপত্য হারিয়েছেন এ আওয়ামী লীগ নেতা। এ কারণে বছরখানেক ধরে জাফলংয়ে বোমা মেশিন বন্ধ। তবে কোয়ারির বাইরে কিছু এলাকায় এখনো কৌশলে পাথর উত্তোলন চলছে। একসময়ের জামায়াত নেতা ছাতকের আলাউদ্দিন, জামাই সুমনসহ স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার সেল্টারে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে চলছে বোমা মেশিনে পাথর উত্তোলন। গোয়াইনঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিশ্বজিত কুমার পাল ভোরের কাগজের সঙ্গে আলাপকালে পাথরখেকোদের থাবায় জাফলং ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত হয়েছে বলে স্বীকার করেন। তবে তার দাবি, পরিস্থিতি অনেক পাল্টেছে। এখন আর আগের মতো বোমা মেশিনের ব্যবহার হচ্ছে না। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, পাথরখেকোরা সব সময়ই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকছে। কোনো নেতা তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন, এটা সবারই জানা। এসব কারণে ওই নেতাদের লজ্জা না হলেও নাগরিক হিসেবে আমাদের লজ্জা লাগে। চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি আশা করেন। উল্লেখ্য, বোমা মেশিন হচ্ছে ইঞ্জিন চালিত এক ধরনের মেশিন। মেশিনটির ইঞ্জিনের সঙ্গে একটি শেইভ (স্থানীয় ভাষায়) ও পাইপ লাগানো থাকে। ইঞ্জিন চালনার শেইভটি মাটির ৪০ থেকে ১৫০ ফুট গভীরে চলে যায় এবং পাইপের মাধ্যমে পাথর উপরে উঠে আসে। এ মেশিনের মাধ্যমে পাথর উত্তোলন মোটেই পরিবেশ বান্ধব নয় বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App