×

শিক্ষা

ভারপ্রাপ্ত ভারাক্রান্ত চবি প্রশাসন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০১৯, ১২:০৫ পিএম

ভারপ্রাপ্ত ভারাক্রান্ত চবি প্রশাসন
উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, প্রক্টর, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বপ্রাপ্ত ও ভারপ্রাপ্তদের নিয়ে চলছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে প্রশাসনিক ও একাডেমিক নানা কাজে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে দেশের অন্যতম বৃহৎ এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত বর্তমান উপউপাচার্য ড. শিরীণ আখতারকে উপাচার্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাও প্রায় সাড়ে ৩ মাস হয়ে গেছে। এদিকে উপাচার্যের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে এখনো স্থায়ীভাবে কাউকে নিয়োগ না দেয়ায় দুর্নীতিবাজ-স্বার্থান্বেষী চক্রটি তাদের বলয়ের ‘কাউকে’ নিয়োগ দেয়ার জন্য আবারো সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে জানা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুর্নীতি-টেন্ডার-নিয়োগ বাণিজ্য এবং ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ হত্যাকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়াসহ নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত সাবেক উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর মেয়াদ শেষ হয় গত ১৫ জুন। তার দুই দিন আগে নতুন উপাচার্য নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত উপউপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর তিন মাস পেরিয়ে গেলেও বাধাধরা নিয়ম-নীতির কারণে বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে। তবে এ সময়ে ড. শিরীণ আখতার সব দিক সামলিয়ে মোটামুটি ভালোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছেন বলে অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিমত। এদিকে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করছেন কে এম নুর আহমদ। এ ছাড়া ভারপ্রাপ্ত প্রক্টরের পদে রয়েছেন চারুকলা বিভাগের শিক্ষক প্রণব মিত্র। উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আমির মোহাম্মদ মুসাকে ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক পদেও রয়েছেন ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. আলতাফ উল আলম। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন কলেজ পরিদর্শক হিসেবে প্রায় ৩ বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক সালামত উল্লাহ ভুইয়া। অর্থাৎ উপাচার্যসহ চবির গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোই এখন দায়িত্বপ্রাপ্ত বা ভারপ্রাপ্তদের ভারে ভারাক্রান্ত। অন্যদিকে স্থায়ীভাবে উপাচার্যের দায়িত্বে ‘একজন নারী’ ও অপেক্ষাকৃত ক্লিন ইমেজের অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারকে নিয়োগ না দেয়ার জন্য নানামুখী অপতৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। ইতিপূর্বে যারা চবিতে টেন্ডার ও নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারা ড. শিরীণের পরিবর্তে অন্য কাউকে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। যাতে তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি ধামাচাপা দেয়া যায়। তবে সরকারি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে ড. শিরীণ আখতারের পক্ষে সবুজ সংকেত দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার প্রতি বেশ সন্তুষ্ট ও সহানুভূতিশীল বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, দুর্নীতিবাজ চক্রটি বিদায়ী ভিসি ড. ইফতেখারের মদতপুষ্ট ও নিয়োগ বাণিজ্যের মামলায় দুদকের সন্দেহভাজন ড. ফরিদ উদ্দিনকে উপাচার্যের পদে বসাতে চাইছে। কারণ অর্থনৈতিকভাবে এবং প্রশাসনের কয়েকটি জায়গায় সমাজবিজ্ঞান অনুষদের এই ডিনের বেশ প্রভাব রয়েছে। চবির শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে জনশ্রুতি আছে, সাবেক ভিসি ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর প্রশাসনের সব প্রকার দুর্নীতি এবং অনিয়মের পেছনে রয়েছেন প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন। এ ছাড়া উপাচার্য পদ বাগাতে লবিং চালাচ্ছেন ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু তাহের। তবে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে তার বিষয়ে ‘সবুজ সংকেত’ মেলেনি। উপাচার্য নিয়োগের ব্যাপারে ড. শিরীণ আখতারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করবে সরকার। সরকার যদি আমাকে যোগ্য মনে করে উপাচার্যের দায়িত্ব দেয়, তবে আমি তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত আছি। ইতোমধ্যে সব ধরনের দুর্নীতিকে দূরে ঠেলে আমি সততা-নিষ্ঠার সঙ্গেই দায়িত্বপালন করছি। এদিকে ভোরের কাগজের অনুসন্ধানে ড. ফরিদ উদ্দিনের বেশ কিছু অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। চবির গবেষণা সেল ও প্রকাশনা দপ্তরের পরিচালক হিসেবে প্রফেসর ফরিদ উদ্দিনের মেয়াদ শেষ হয় গত ৯ সেপ্টেম্বর। এর আগের সপ্তাহে (৪ ও ৯ সেপ্টেম্বর) দুটি সভার মাধ্যমে তড়িঘড়ি করে ১৪টি প্রকল্প অনুমোদনসহ গবেষণা সেলের প্রায় ৩০ লাখ টাকা বিলি করেছেন তিনি। আর ওই ১৪টি প্রকল্পের মধ্যে বেশির ভাগ দেয়া হয়েছে প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন ও সাবেক ভিসি ড. ইফতেখারের অনুগত শিক্ষকদের। বিশেষ করে রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মাহফুজ পারভেজসহ কয়েকজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে প্রকল্প দেয়ায় প্রফেসর ফরিদ উদ্দিনের জামায়াত-তোষণ নীতি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। কেননা মাহফুজ পারভেজ কট্টর জামায়াতী শিক্ষক হিসেবে পরিচিত এবং ছাত্রজীবনে তিনি জামায়াত-শিবিরপন্থি একটি দৈনিকের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ছিলেন। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স কমিটিতে পাস হওয়া নিয়ম অনুযায়ী পরিচালক এবং কমিটি সদস্যরা এক বছরে অনধিক দুটি সভায় যোগদানের ভাতা নিতে পারবেন। অথচ প্রফেসর ফরিদ উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিটি নিয়মানুযায়ী ৪ বছরে ৮টি সিটিং ভাতার পরিবর্তে ২৫টি সিটিং ভাতা গ্রহণ করেন। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের ২৩ মার্চ অনুষ্ঠিত ৪৩০তম সিন্ডিকেট সভায় ‘অনৈতিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনবহির্ভূত কাজ’ করা, বিভাগের একাডেমিক ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলা নষ্ট করা এবং ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা পরিপন্থী ও পরীক্ষা সংক্রান্ত বিধি লঙ্ঘন করার দায়ে প্রফেসর ফরিদ উদ্দিনকে সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম থেকে ৫ বছরের জন্য বহিষ্কারের পাশাপাশি বিভাগের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এরকম একজন নিন্দিত, শাস্তিপ্রাপ্ত এবং অনৈতিক লোক কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার জন্য দৌড়-ঝাপ করেন, তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সিনিয়র এবং অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। ভোরের কাগজের হাতে থাকা চবির বিভিন্ন দাপ্তরিক কাগজপত্রে দেখা যায়, যে বই ও গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করে ড. ফরিদ উদ্দিন ২০০৬ সালের ১০ আগস্ট প্রফেসর পদে পদোন্নতি পেয়েছেন, সেখানেও নানা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। এ কারণে চবির নৃবিজ্ঞান বিভাগের সব সিনিয়র শিক্ষক (সাদাফ নুরে ইসলাম, ড. মুহাম্মদ আলা উদ্দিন, এন এম সাজ্জাদুল হক, আনোয়ার হোসেন এবং তানজিম আফরিন) মিলে ২০১১ সালের ২০ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রশাসন বরাবর একটি আবেদন করেছিলেন, যাতে ড. ফরিদ কোনো নির্বাচনী বোর্ডে বসতে না পারেন। নানা কারণে বিতর্কিত প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন কোন যোগ্যতায় ভিসি হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা রয়েছে। গত শনিবার বিকেলে বিভিন্ন দুর্নীতি সংক্রান্ত ব্যাপারে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদসহ অন্যান্য বিষয়ে প্রফেসর ফরিদের বক্তব্য জানতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি সিন্ডিকেট মিটিংয়ে রয়েছি.. মিটিং করছি..।’ এরপরই ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি। চবির সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন ও প্রবীণ অধ্যাপক ড. গাজী সালেহ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, নীতি-নৈতিকতাবিরোধী, বিতর্কিত, দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত এবং দুদকের তদন্তাধীন কোনো ব্যক্তিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ দেয়া সঠিক হবে বলে মনে করি না। প্রশাসনিকভাবে দৃঢ় অথচ গ্রহণযোগ্য, সেই সঙ্গে ভালো একাডেমিক যোগ্যতা রয়েছে এমন কোনো শিক্ষককেই এ ধরনের সম্মানিত পদে নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ফরিদ উদ্দিনের বিরুদ্ধে পরীক্ষায় জালিয়াতি, নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া সাবেক উপাচার্যের কাছের লোক হিসেবে বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। যার কারণে দুদকের কাঠগড়ায়ও দাঁড়াতে হয়েছে। এমন ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ পদে বসালে সুনাম ক্ষুণ্ণ হওয়ার পাশাপাশি, অনিয়মের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে চবি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App