×

মুক্তচিন্তা

ক্যাসিনোবাজরা পেঁয়াজবাজারে?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০১৯, ১০:১৬ পিএম

পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ীদের বরাবরই কিছু বাজারি অপকৌশল রয়েছে। বাজার কারসাজির হোতারা ভিনগ্রহের নয়। বিচ্ছিন্নও নয়। বেশ যূথবদ্ধ। কৃত্রিম সংকট তৈরিতে দীর্ঘ অভিজ্ঞ। সিদ্ধহস্ত। সেই আলোকে তারা বিভিন্ন পণ্যের অস্বাভাবিক মজুদ গড়ে। দরকার মতো ক্রাইসিস তৈরি করে। ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে মাঝখানে কয়েকটি স্তরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ক্যাসিনোবাজদের মতো। বৈশিষ্ট্যগতভাবে ক্যাসিনো গোত্রেরই তারা। ভয়ঙ্করও।

সরকারকে স্বস্তিতে না রাখার দুষ্টচক্রের বিরতিহীন তৎপরতা এখন আর লুকানো-চাপানো নয়। একেবারে অজানা-অচেনা নয় তারা। বিশেষভাবে চিহ্নিতও কয়েকজন। এরা কোনো কিছুতে হাল না ছেড়ে ভর করছে একটার পর আরেকটাতে। ওই চরিত্রের কিছু অংশেরই এখন পদচারণা দেশের পেঁয়াজ রাজ্যে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও সরকারের একের পর এক যুগান্তকারী পদক্ষেপের চলতিপথে ধান, চাল, চামড়া এমনকি কয়লাও বাদ দেয় না এরা। ক্যাসিনোসহ চাঁদাবাজ, বখরাবাজ দমনের মাঝপথে এখন ভর করেছে পেঁয়াজবাজারে। সচরাচর ঈদ মৌসুমে পেঁয়াজের ঝাঁজে তেতে ওঠে একটি চক্র। সরকারের আগাম পদক্ষেপের কারণে গেল দুই ঈদের কোনোটাতেই পেরে ওঠেনি ওরা। তখন দম ধরেছে। হাল ছাড়েনি। সুযোগের অপেক্ষা করেছে। এখন কোনো উৎসব বা মৌসুম ছাড়াই নেমেছে কোমর বেঁধে। গত কদিনে জনগণের পকেট কেটে তারা শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সরকারের রোহিঙ্গা এবং ক্যাসিনো ইস্যুতে ব্যস্ততার সুযোগটি কড়ায়গণ্ডায় কাজে লাগিয়েছে। বিদ্যুতের গতিকে হার মানিয়ে আড়ত-গুদামগুলো করে ফেলেছে পেঁয়াজশূন্য। পেঁয়াজের জন্য আমরা বরাবরই প্রতিবেশী দেশ ভারতের ওপর কিছুটা নির্ভরশীল। এবার বৈরী আবহাওয়ার কারণে ভারতে পেঁয়াজের ফলন কম হয়েছে। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় চাহিদার তুলনায় কমেছে সরবরাহ। পাশাপাশি ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় নির্ধারিত সময়ের আগে পেঁয়াজ সংগ্রহ করায় উৎপাদিত পণ্যের মান তুলনামূলক কমে গেছে। সরবরাহ সংকটের জের ধরে ভারতের বাজারেই পেঁয়াজের দাম কিছুটা বাড়তি। সরবরাহ কমে যাওয়ায় দেশটির রপ্তানিকারকরা পেঁয়াজের রপ্তানিমূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। এ অবস্থা বিবেচনায় নিজস্ব চাহিদা নিশ্চিতে তারা পেঁয়াজ রপ্তানি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারতের এ সিদ্ধান্তের অসদ্ব্যবহারে একটুও দেরি করেনি বাংলাদেশের সিন্ডিকেটবাজরা। বাংলাদেশে পেঁয়াজের কেজি সেঞ্চুরি পার করে নিয়ে গেছে তারা। যদিও দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি নেই। এর বাইরে বাড়তি রয়েছে মিয়ানমারের পেঁয়াজ। গত ৭-৮ দিনে মিয়ানমার থেকে ৭০০ টন পেঁয়াজ এসেছে। পাইপ লাইনে আরো রয়েছে। মিয়ানমারের পেঁয়াজের দাম পড়েছে ৩৫ টাকা কেজি। সরকার প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ হিসেবে মিসর ও তুরস্ক থেকেও পেঁয়াজ আমদানির ব্যবস্থা রেখেছে। দেশ দুটি থেকে এলসি করা পেঁয়াজও দেশে পৌঁছাবে শিগগিরই। তা হলে সমস্যা কোথায়? কেন নাই-নাই হাহাকার? কারা এর হোতা? কোন মতলবে তারা রটাচ্ছে-ছড়াচ্ছে পেঁয়াজ সংকটের গুজব? গোটা ব্যাপারটাই পাকা হাতের কারসাজি। সিন্ডিকেটের সংঘবদ্ধ সমবায়ী তৎপরতার ফসল। ব্যবসায়ীরা কয়েক দফা হাত বদল করে গরম করে দিয়েছে পেঁয়াজের বাজার। সরকার এ চক্রের ব্যাপারে একেবারে অজ্ঞ বা কিছু জানে না- এমনটি মনে করা যায় না। সরকারের পক্ষ থেকে বাণিজ্য সচিবের মাধ্যমে সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে। পেঁয়াজের দাম নিয়ে কারসাজি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। পেঁয়াজের দাম নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে আশ্বস্তও করেছেন সচিব। তার ওপর টিসিবির মাধ্যমে ট্রাকে ট্রাকে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু হয়েছে। কিন্তু সরকারের হুঁশিয়ারি কি কেয়ার করছে কারসাজির আয়োজকরা? জনগণও কি হয়েছে আশ্বস্ত? হাল ছাড়ছে না পেঁয়াজ সিন্ডিকেট। বরং কৌশল পাল্টিয়ে আরো আগুয়ান তারা। গোটা পরিস্থিতি এখন হুমকি-ধমকির পর্যায়ে নেই। অথবা হুমকি কার্যকর করতে করতে যা লুটে নেয়ার সেটা হজমের বাকি থাকবে না। সিন্ডিকেট পাড়ি দিয়েছে অনেক পথ। তাদের কারসাজিতে পেঁয়াজের সঙ্গে ট্রাক-লরিও কমে গেছে। পেঁয়াজ-রসুনসহ যাবতীয় মসলার বৃহৎ মোকাম খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের গাড়ি প্রবেশ কমে গেছে। ঢাকার শ্যামবাজার-কারওয়ানবাজারের চিত্রও তাই। রহস্য পরিষ্কার। দেশে বাজার মনিটরিংয়ের কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় ব্যবসায়ীরা শুধু পেঁয়াজ নয়, সব পণ্যেরই ইচ্ছামতো দাম বাড়ান। গুদাম-আড়তে মজুদ বাড়ান। এর বাইরেও থাকে তাদের মজুদের বিশেষ এবং নিরাপদ আস্তানা। আবার পণ্যের ক্রয়মূল্যের সঙ্গে বিক্রয়মূল্যের পার্থক্য অনুসন্ধানের কর্তৃপক্ষীয় কোনো বালাই নেই। অন্যান্য মসলার চেয়ে পেঁয়াজ তুলনামূলক কিছুটা স্পর্শকাতর। এ পণ্যটির বিকল্পও নেই। পেঁয়াজ ছাড়া বাংলাদেশে ব্যঞ্জন- ভাবাই যায় না। তাই পেঁয়াজের দাম বাড়লে গণমাধ্যমে হৈচৈ বেশি হয়। সরকারকে নাস্তানাবুদ করতেও আইটেমটি হটকেকের মতো। পেঁয়াজের দাম বাড়লে শিরোনাম। কমলেও শিরোনাম। প্রতি বছর পেঁয়াজ কতবার যে সংবাদ শিরোনাম হয়, তার কোনো হিসাব নেই। পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ীদের বরাবরই কিছু বাজারি অপকৌশল রয়েছে। পাইকারি ও খুচরারা মিলেমিশেই ভোক্তাদের পকেট কাটছেন। পাইকারি ব্যবসায়ীরা দোষ চাপান খুচরা ব্যবসায়ীদের ওপর। আর খুচরা ব্যবসায়ীরা পাইকারি ব্যবসায়ীদের ওপর দায় চাপান। সম্মিলিতভাবেই তারা জনগণের নাভিশ্বাস তৈরি করেন। আর বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেন সরকারকে। তাদেরও রয়েছে গডফাদার। যদ্দূর জানা গেছে, পেঁয়াজ নিয়ে এ কারসাজির কিছু তথ্য রয়েছে সিআইডির কাছে। আমদানির রেকর্ড জানতে প্রথমে তারা বেনাপোল, হিলি, সোনামসজিদ ও ভোমরা বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়। গত এক বছরে তাদের বন্দরের মাধ্যমে কী পরিমাণ পেঁয়াজ কী দামে কারা আমদানি করেছে, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। সংস্থাটি প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে দেশের চারটি বন্দরের মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানির রেকর্ড ও দাম পর্যালোচনা করেছে। কেন আমদানি মূল্যের সঙ্গে খুচরা বাজারে দামের বিশাল ফারাক- এ ব্যাপারে যৌক্তিক কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। সিআইডির পাওয়া এসব তথ্য সম্পর্কে সরকারের শীর্ষমহল অবহিত নয়, তা মনে করা যায় না। এদিকে বাজার কারসাজির হোতারা ভিনগ্রহের নয়। বিচ্ছিন্নও নয়। বেশ যূথবদ্ধ। কৃত্রিম সংকট তৈরিতে দীর্ঘ অভিজ্ঞ। সিদ্ধহস্ত। সেই আলোকে তারা বিভিন্ন পণ্যের অস্বাভাবিক মজুদ গড়ে। দরকার মতো ক্রাইসিস তৈরি করে। ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে মাঝখানে কয়েকটি স্তরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ক্যাসিনোবাজদের মতো। বৈশিষ্ট্যগতভাবে ক্যাসিনো গোত্রেরই তারা। ভয়ঙ্করও। এক হিসাবে জানা গেছে, গত বছরের জুলাইতে ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজের দাম হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ১৬-১৮ টাকা। আগস্টে দাম হওয়ার কথা ছিল ১৭-১৮ টাকা। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ২৫-২৬ টাকা। সেপ্টেম্বরে ৩০-৩২ টাকা, অক্টোবরে ৩০-৩২ টাকা এবং নভেম্বরে ৫০ টাকা। ২৫ নভেম্বরের পর থেকে কিছু ক্ষেত্রে দাম হওয়ার কথা প্রতি কেজি ৮০ টাকা। তবে খুচরা বাজারে নভেম্বরে দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল প্রতি কেজি ৭৮-৮০, ভারতীয় পেঁয়াজ ৫৪-৫৮ টাকা। অক্টোবরে দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৭৫-৯৫ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৭০-৮০ টাকা। সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ আমদানি করা হয় আগস্টে। এরপর থেকে স্বাভাবিকভাবেই পেঁয়াজের দাম কমার কথা। কিন্তু হয়েছে উল্টোটা। আগস্টের পর দাম আরো বাড়তে থাকে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আগস্টে বেশি চালান আসার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে তা মজুদ করে ফেলেন ব্যবসায়ীরা। এরপর বাজারে এক ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বর্তমান অবস্থায় এনে ঠেকানো হয়েছে। জঙ্গি দমন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু, বিদ্যুতের লোডশেডিং ব্যাপকভাবে কমানো, অর্থনৈতিক উন্নয়নের নানা সূচকের ইতিবাচক অগ্রগতি, জিডিপির প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির মতো অবিশ্বাস্য পদক্ষেপগুলো বানচালের কোনো ষড়যন্ত্র নয় তো? সার্বক্ষণিক মনিটর এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি কঠোরভাবে দমনের কোনো বিকল্প নেই। নইলে এ চক্র আরো উৎসাহিত হবে। জোশ পাবে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের যৌক্তিক লাভ নিশ্চিত করার পাশাপাশি ভোক্তার অধিকার যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, ক্রেতারাও যেন প্রতারিত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App