×

মুক্তচিন্তা

ছাত্ররাজনীতির ধারাবাহিকতা: দূষণে তার গতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১০:৫৬ পিএম

যে রাজধানী ঢাকা এক সময় সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার জন্য সুখ্যাতি অর্জন করেছিল সেই ঢাকায় একুশ শতকে ক্যাসিনো অপসংস্কৃতির নৈশ অনাচারের কথা? কিন্তু ভাবা নয়, বাস্তবে এর নগ্নরূপ এমনই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে তারই দলের অঙ্গ সংগঠনের ছাত্র-যুব নেতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে-গ্রেপ্তার, রিমান্ড ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। যাই হোক অনেকের মনে স্বস্তি এবং প্রত্যাশা যে, এই কঠোর ব্যবস্থা অব্যাহত রেখে ছাত্র-যুব রাজনীতিকে যেন সুস্থ পথে গতি করা হয়।

গত কয়েক দিন যাবৎ দৈনিক পত্রিকাগুলোতে মোটাসোটা হরফে কয়েকটি নাম ঘিরে নানামাত্রিক সংবাদ এবং বিচার ব্যাখ্যামূলক নিবন্ধ। সর্বত্র এদের নিয়ে আলোচনা। শোভন-রাব্বানী, এরপর খালেদ। এখন কাকরাইলের সিংহাসনে আসীন সম্রাট। ইতোমধ্যে আরো গ্রেপ্তার, আরো জিজ্ঞাসাবাদ, আরো গ্রেপ্তারের সম্ভাবনায় সংশ্লিষ্ট মহলে আতঙ্ক। যেন মৌচাকে ঢিল।

ক্ষমতাসীন সরকার ও দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার হঠাৎ ঘোষণা এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক তৎপরতার কারণে এই তুলকালাম অবস্থা ছাত্র-যুব রাজনৈতিক অঙ্গনে। এর ছায়া পড়ছে মূল রাজনৈতিক সংগঠনেও। ছাত্র-যুব হয়ে বয়স্ক রাজনীতি পর্যন্ত শুদ্ধি অভিযানের ইচ্ছা প্রকাশ প্রধানমন্ত্রীর। স্বভাবতই সর্বত্র আতঙ্ক, থরথর কম্প। কারণ একটাই- কেউ ধোয়া তুলসী পাতা নন।

ঘটনা কিন্তু আজকের নয়, গতকাল পরশুরও নয়। বেশ দীর্ঘ সময় পূর্বেকার। মূলত চাঁদাবাজি, সেইসঙ্গে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নানামাত্রা সংবাদপত্রে খবর হয়েছে অনেক দিন থেকে। নিরীহ দর্জি ছোকরাকে কুপিয়ে মারা থেকে বহুমাত্রিক গুম, খুন, নির্যাতনের ইতিহাস তৈরি হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র যুবনেতাদের কল্যাণে। এই সন্ত্রাস অপরাধপ্রবণতা প্রতিরোধ ও দূর করার কোনো চেষ্টা এতদিন হয়নি। বিপুল পরিমাণ অর্থের অবৈধ সংগ্রহ ও সঞ্চয়, বিদেশে অর্থ পাচার, অর্থের-অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার ও অপচয় সব কিছু তৈরি করেছে ব্যাপক এক অপসংস্কৃতির ভুবন, তা কতটা পর্নো সংস্কৃতির দিকে ধাবমান তা অবশ্য অন্তত আমার জানা নেই। তবে ঘটনাপ্রবাহ যে সাংস্কৃতিক-সামাজিক দুঃসময় তৈরি করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

তা না হলে কে ভাবতে পেরেছে যে ঊনসত্তর-একাত্তরের রক্তক্ষয়ী পথ পেরোনো স্বাধীন বাংলাদেশে এমন একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক দৃশ্যপট তৈরি হতে পারে চরম দুর্নীতি ও সন্ত্রাসীপনার মধ্য দিয়ে এবং এর কেন্দ্রবিন্দু ছাত্রলীগ-যুবলীগ রাজনীতি। অবিশ্বাস্য ঠেকে অবৈধ-অনৈতিক সব কর্মকাণ্ড। দেরিতে হলেও যে অভিযান শুরু করা হয়েছে সবাই চাইছে তা অব্যাহত থাকুক। সংশ্লিষ্ট কয়েকটি শিরোনাম ঘটনার তলদেশ জানার আগ্রহ তৈরি করে, কোনোটি আমাদের হতবাক করে ফেলে। অবাক হয়ে ভাবতে হয়, এমন ঘটনাও ঘটে? যেমন ২২/৯/২০১৯ তারিখে একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবর: ‘বৃদ্ধার গরু বিক্রি করে দিলেন কৃষকলীগ-যুবলীগ নেতা’। এটা নেহাত আটপৌরে অতি ছোট খবর, বৃদ্ধার প্রতি সহানুভূতিতেই এই সূচনা সংবাদ। আসল খবর তো রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম প্রভৃতি সমৃদ্ধ কেন্দ্রবিন্দুতে।

‘চার নেতার ছত্রছায়ায় রমরমা ক্যাসিনো’ শীর্ষক শিরোনামে বলা হয়েছে ‘ঢাকার স্পোর্টস ক্লাবগুলো ঘিরে কয়েক দশক ধরে রমরমা জুয়ার আসর বসানো হচ্ছে। বছর চারেক আগে এই জুয়ার আসরগুলোতে ক্যাসিনোতে উন্নীতকরণ শুরু হয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় ক্যাসিনোর বিস্তার ঘটে।’

আমরা বিশদ বিবরণে যাচ্ছি না। কিন্তু নানা সংবাদের নিরিখে এটা স্পষ্ট যে, ক্যাসিনো ব্যবসা কি পুলিশের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া চলতে পারে? তাই অভিযানের মুখে সংবাদ শিরোনাম : ‘ক্যাসিনো সাম্রাজ্যে ধস/প্রশ্নের মুখে পুলিশ’। এর সঙ্গে ছোট হরফে সংবাদ ‘৩ যুবলীগ নেতার শতকোটি টাকার সম্পদ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে। কিং মাস্টার সম্রাটসহ এ চক্রের অস্ত্রধারী ক্যাডারবাহিনীর সদস্যরাও নজরদারিতে।’ শুধু নজরদারিতে? কেন? অতঃপর সংবাদ ‘ক্যাসিনোকাণ্ডে তোলপাড়’- যুবলীগ নেতা খালেদ ৭ দিনের রিমান্ডে।’ গ্রেপ্তার শামীম। ইতোমধ্যে বিস্ফোরক ঘটনা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কোটি টাকার ভাগাভাগি’। এ জাতীয় বহুবিধ দুর্নীতির খবরে সয়লাব দৈনিক পত্রিকার পাতাগুলো। সেইসঙ্গে উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে প্রকাশ পেয়েছে কোথাও ক্ষোভ, কোথাও বিচার ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ। এমনকি এমন মন্তব্যও : ‘শিকড় আরো গভীরে’।

আরো একটি খবর : ‘রেলওয়ের জমি দখল করে পাকা ভবন তুলেছেন আ.লীগ নেতারা।’ ঘটনা রাজশাহীতে। অর্থ একটাই। রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, উত্তরে বিভাগীয় শহর রাজশাহী থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্নীতির চারাগাছ অরণ্য তৈরির আভাস দিতে শুরু করেছে। স্বভাবতই বিচলিত প্রধানমন্ত্রী ও দলীয়প্রধানের ব্যবস্থা গ্রহণে এগিয়ে আসা। দলের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন : এ শুদ্ধি অভিযান মূল দলেও শুরু হবে।

দুই.

বছর কয় আগে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচিত এক আওয়ামী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে টিভিতে বলতে শুনেছিলাম : ‘ছাত্রলীগ আমাকে রাজনীতি শিখিয়েছে’। শুনে মনে পড়ে গেল তারও আগে পঞ্চাশের দশকের ছাত্ররাজনীতির কথা। অতীত মানেই ভালো, বর্তমান মন্দ- এ ধরনের আপ্তবাক্যে সায় না দিয়ে ইতিহাসের পাঠ নিতে গেলে ঠিকই দেখা যায় পঞ্চাশের যে ছাত্র আন্দোলন বিস্ফোরণ তৈরি করে, সেই একুশের ভাষা আন্দোলনে ছিল আদর্শের প্রাধান্য এবং তা দল-মত নির্বিশেষে। পরবর্তী পর্যায়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ছাত্রদের শিক্ষা আন্দোলন ইত্যাদি কোনোটিতেই ব্যক্তিগত লোভ-লাভের কোনো বিষয় ছিল না। ছাত্র নেতৃত্ব থেকে সাধারণ সংগ্রামী ছাত্রদেরও নিঃস্বার্থ প্রতিবাদী চরিত্র।

একই ধারা ষাটের দশকের ছাত্র-যুব আন্দোলনে। পঞ্চাশে যদি আদর্শিক বিচারে প্রগতিবাদীদের প্রাধান্য থাকে, ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদীদের প্রাধান্য, কারো মতে, দুই ধারা সমানতালে ঐক্যবদ্ধভাবে চলেছে। ছাত্রলীগ, বিভাজিত ছাত্র ইউনিয়ন এবং অনুরূপ ছাত্র গ্রুপ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বা আত্মদানে একসঙ্গে হেঁটেছে, সাময়িক হলেও। উল্লিখিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এই ছাত্রলীগের কথাই বলেছিলেন।

আজকের ছাত্রলীগ-যুবলীগের বাণিজ্যিক চরিত্র তাদের চিন্তায় ছিল না। আদর্শগত লক্ষ্য অর্জনই ছিল একমাত্র বিষয় এবং সেখানে বাধা-বিপদ-বিপত্তি কম ছিল না, কারাবাস-নির্যাতন তো ছিলই। স্বভাবতই ছাত্র আন্দোলন গণআন্দোলনে পরিণত হয়েছিল, যেমন পঞ্চাশে তেমনি ষাটের দশকে। একাত্তরে তরুণ গেরিলা যোদ্ধাদের অবদান তো ইতিহাস তৈরি করেছে।

ছাত্র-যুব রাজনীতির এই আদর্শিক ইতিহাস স্বাধীন বাংলাদেশে এক পর্যায়ে এসে কেন এবং কীভাবে দূষিত ও কলুষিত হয়ে দাঁড়ায় সে বিচার-বিশ্লেষণ কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেকের আলোচনায় বিষয়টি উঠে এসেছে যে, এ অঘটনের পেছনে জাতীয় রাজনীতির ভূমিকা বা দায়দায়িত্ব যথেষ্ট। তারা ছাত্র-যুব রাজনীতিকে অঙ্গসংগঠন হিসেবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন, কমিটি গঠন থেকে শুরু করে কার্যক্রম পরিচালনায়।

এ ক্ষেত্রে উদাসীনতা তাদের বিপথগামী হওয়ার জন্য বড় কারণ। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কারণ একাধিকজনের লেখায় লক্ষ করেছি। তা হলো সাধারণভাবে রাজনীতির ক্ষেত্রে আদর্শ ও ন্যায়নীতিকে যথাযথভাবে ধারণ করার ক্ষেত্রেও অবহেলা। আদর্শের পরিবর্তে অর্থনৈতিক প্রাপ্তির দিকে, জীবনে খ্যাতি বা প্রতিষ্ঠার দিকে অধিকতর মনোযোগ। সেইসঙ্গে ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণ।

বেশ কিছুদিন আগে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি একটি মূল্যবান কথা বলেছিলেন, ‘সংসদে এখন বৃহৎ ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য।’ অর্থাৎ রাজনীতিতে আদর্শের স্থান দখল করেছে বাণিজ্য বা প্রাপ্তিযোগ, এক কথায় অর্থবিত্ত সম্পদ বৈভব। এটা তো রাজনীতির মূল কথা নয়, রাজনীতির আদর্শ বা লক্ষ্যও নয়। কিন্তু দল নির্বিশেষে এটাই সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজনীতির এই অবাঞ্ছিত ধারা যদি ছাত্র বা যুব রাজনীতিতে প্রভাবিত করে থাকে তাহলে এর পরিণাম সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য শুভ বা মঙ্গলদায়ক হতে পারে না। অর্থ সংস্কৃতির প্রভাবে ছাত্ররাজনীতি, যুব রাজনীতি দূষিত হতে বাধ্য। এ দিকে কেউ নজর দেননি। ফলে আজকের এই নৈরাজ্যিক অবস্থা।

একটি খবরে দেখা যাচ্ছে ‘টাকার কুমির জি কে শামীম সাবেক এক মন্ত্রীকে ঘুষের টাকা দিতেন বস্তা ভরে’। প্রকাশিত খবরটি যদি আংশিক সত্যও হয়ে থাকে, তাহলেও এর পরিণাম কী ভয়াবহ। আরো একটি বড় কারণ যা ছাত্ররাজনীতির অপসংস্কৃতিকে উৎসাহিত করেছে, তা হলো পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা কিংবা পরোক্ষ সহযোগিতা, অবৈধ ব্যবসা, মাদক পাচার ও ক্যাসিনো চালানোর মতো ঘটনায়।

ভাবা যায়, বাংলাদেশে নৈশ ক্যাসিনো সংস্কৃতি? যে রাজধানী ঢাকা এক সময় সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার জন্য সুখ্যাতি অর্জন করেছিল সেই ঢাকায় একুশ শতকে ক্যাসিনো অপসংস্কৃতির নৈশ অনাচারের কথা? কিন্তু ভাবা নয়, বাস্তবে এর নগ্নরূপ এমনই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে তারই দলের অঙ্গ সংগঠনের ছাত্র-যুব নেতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে- গ্রেপ্তার, রিমান্ড ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। কিন্তু সম্রাট এখনো আসনে, সমীকরণটি কি? যাই হোক অনেকের মনে স্বস্তি এবং প্রত্যাশা যে, এই কঠোর ব্যবস্থা অব্যাহত রেখে ছাত্র-যুব রাজনীতিকে যেন সুস্থ পথে গতি করা হয়। তা না হলে ছাত্র-যুব রাজনীতির দূষণ সর্ববিস্তারি হয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাধির রূপ ধারণ করবে। ক্রমে গোটা সমাজকে দূষিত করতে পারে। অতএব সময় থাকতে সাধু সাবধান।

আহমদ রফিক: লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App