×

মুক্তচিন্তা

এই ঝাঁকুনি কী ধরনের প্রভাব ফেলছে?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১০:৪৪ পিএম

সব কাজ প্রধানমন্ত্রীনির্ভর হয়ে পড়ছে। তিনি না বললে কেউ নড়াচড়া করছেন না। বাংলাদেশে তোষামোদি সংস্কৃতির সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলে এটি, যার কারণে জনগণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কী করলে প্রধানমন্ত্রী খুশি হবেন আর কোনটি করলে তিনি বেজার হতে পারেন- সেই চিন্তায় আছে সবাই। সবার টার্গেট ক্ষমতার তোয়াজ করা, ক্ষমতার সেবা করা। কেউই সত্যিকারের জনগণের সেবক হয়ে উঠছেন না।

এ দেশের মানুষের চোখ হঠাৎ করেই ছানাবড়া। মফস্বল থেকে শুরু করে ঢাকার বড় বড় ক্লাবে হাউজি খেলার প্রচলন থাকলেও আশপাশেই ফুলেফেঁপে এত বড় হয়ে যাওয়া ক্যাসিনোর খবর এ দেশের মানুষকে সত্যিই অবাক করে দিয়েছে। আরো সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল যে, এ দেশে ক্রিকেট ক্রিজ তৈরি হওয়ার আগে আশির দশক পর্যন্ত মানুষের টানটান উত্তেজনা নিয়ে থাকা যে ফুটবল ক্লাবগুলোকে সমর্থন করতেন, ভালোবাসতেন, সেগুলোর বেশিরভাগই এখন এই ঝলমলে ক্যাসিনোর আখড়ায় পরিণত হয়েছে। শুধু মালিকই নয়, ক্যাসিনোতে যাতায়াত যাদের ছিল তারা বেশিরভাগই বিত্তশালী এবং সবাই ক্ষমতার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত। বলার অপেক্ষা রাখে না, যাদের অবৈধ এবং অগাধ টাকা রয়েছে, তারাই এই ক্যাসিনো সংস্কৃতির রক্ষক। চলছিল সবই ঠিকঠাক মতো। তবে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মতে এটি নিয়ে চলছিল নানা ধরনের ফিসফাস এবং এক ধরনের অস্বস্তি। ক্যাসিনো পরিচালকরাও হয়তো সেটি টের পেয়ে গিয়েছিলেন। এটা সবারই জানা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জুয়ার আসর চলে, সেখানে ক্যাসিনোকেন্দ্রিক হয় রমরমা ব্যবসা। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাসিনোর জায়গা হিসেবে পরিচিত লাস ভেগাস। কিন্তু বাংলাদেশেও যে লাস ভেগাসের ছোট সংস্করণ হয়ে গেছে সেটি ছিল অজানা। এবার রাজধানী ঢাকার অন্তত ৬০ স্পটে অবৈধ ক্যাসিনো (জুয়ার আসর) ব্যবসা চলছে বলে জানিয়েছে গোয়েন্দা সূত্র। শুধু দেশের ব্যবসায়ীই নয় এসব ক্যাসিনো পরিচালনার জন্য নেপাল, থাইল্যান্ডসহ চারটি দেশ থেকে প্রশিক্ষিতদের আনা হয়েছিল। বাংলাদেশের ক্যাসিনো ব্যবসার ইতিহাস খুঁড়ে দেখা যাচ্ছে যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় রাজধানীতে অর্ধশতাধিক ক্যাসিনো চালু হয়েছিল। তার সবই নিয়ন্ত্রণ করত যুবদল। সেনা সমর্থিত সরকারের সময় এগুলো বন্ধ করা হলেও ক্ষমতা বদলের পর ক্যাসিনোগুলো যুবলীগের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং দলীয় ক্ষমতা বিস্তার করে যুবলীগ নেতারা ক্যাসিনো সাম্রাজ্য বিস্তার করে। কিন্তু সেখানে এমন বজ্রপাত হবে কেউ ভাবতেই পারেনি। বিশেষ করে মতিঝিল ও গুলিস্তানে ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনো ও জুয়ার আসরে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালিত হবে তা ঘুণাক্ষরেও কেউ কল্পনা করেনি। ধরা পড়ার পর যুবলীগ নেতা পুলিশকে বলেছেন, ‘পুলিশ এতদিন কী করেছে?’ পুলিশকে ইঙ্গিত করে যুবলীগ নেতাদের ‘আঙুল চোষা’ বকাবকি একভাবে আমাদের এই আভাস দেয় যে, এই অভিযানের জন্য তারা প্রস্তুত ছিলেন না। এখন প্রশ্ন হলো, ওপরের নির্দেশ ছাড়া যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে কতটা সফলভাবে দাঁড়াতে পারত পুলিশ প্রশাসন? আর এই যুবলীগ নেতাই এই ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য পুলিশের ‘দফারফা’ করতেন কিংবা হয়তো সেই পুলিশের লাশ পাওয়া যেত কোনো জলাশয়ে কিংবা আঁস্তাকুড়ে। রাজধানী ঢাকার নগর জীবনের বিভিন্ন দুর্ভোগ যখন বারবার আলোচিত হয় তখনই বিভিন্ন মন্ত্রী বারবার বলে আসছেন যে দেশ এখন প্যারিস এবং সিঙ্গাপুরের মতো হয়েছে। আসলেই হয়তো তাই, অন্তত ঢাকা শহরজুড়ে এত ছোট-বড় ক্যাসিনোর আখড়ার খবর, দেশকে ইউরোপ-আমেরিকার অঞ্চলভুক্তই মনে হচ্ছে। তাই মন্ত্রীদের এতদিন করা দাবির মাজেজা এখনই জনগণ বুঝতে পারছে ক্যাসিনোগুলো জনসমক্ষে নিয়ে আসার পর। তবে এই ক্যাসিনোগুলোর মালিক কোনো সাদামাটা জনগণ নয়। বিভিন্ন সরকারের আমলে সরকারদলীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় ক্লাবপাড়াগুলোতে বাধাবিঘ্নহীনভাবে জমজমাট জুয়ার আসর বসত। এটিও স্পষ্ট যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও সব জানতেন। কিন্তু যেহেতু সরকার সব সময় চুপ ছিল তাই তারাও নীরব ছিলেন। আর সরকারের ইঙ্গিত ছাড়া সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতাদের বিপক্ষে দাঁড়ানো যে এত সহজ নয়, তা সবাই বোঝে। এর বাইরে হয়তো তাদের সঙ্গে ভিন্ন রকমের দেনদরবার আগে থেকেই করে রেখেছিলেন ক্যাসিনোর মালিকরা। কারণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকার সাধারণ জনগণ পুলিশকে এই বিষয়ে লিখিতভাবে অভিযোগ দিয়েছিল, সেগুলো পুলিশ আমলে নেয়নি। শুধু ক্যাসিনোই নয় বর্তমানে সরকারি বিভিন্ন খাতে দুর্নীতির চিত্র, ছাত্রনেতাদের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ক্ষমতা প্রদর্শনসহ নানা ধরনের বেহাল অবস্থা সরকারকে চাপের মধ্যে রেখেছে বলা চলে। বিশেষ করে বালিশ, পর্দা, চেয়ার-টেবিল প্রভৃতি কেনাকাটা বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির চিত্র বের হলে সরকার বেশ অস্বস্তিতে পড়ে। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও। বর্তমানে বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে চৌদ্দজন উপাচার্যের বিষয়ে কাজ করছে ইউজিসির গঠন করা তদন্ত কমিটি। এর বাইরে তো আছেই বিভিন্ন পর্যায়ে নেতাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাস এবং অনৈতিক কাজে জড়িয়ে আধিপত্য জিইয়ে রাখার প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে উন্নয়ন কাজের ‘ন্যায্য পার্সেন্টেজ’ চাওয়া নিয়ে জড়িয়ে পড়া এবং অন্যান্য বিষয়ে অনৈতিকতার অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরিয়ে দিয়েছেন ছাত্রলীগের অন্যতম প্রধান দুই নেতাকে। এর পাশাপাশি নিজেই বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দলীয় নেতাদের সংস্কার কার্যক্রম শুরু করছেন। এ ক্ষেত্রে জনগণের বাহবা তিনি কুড়াচ্ছেন। আপাততভাবে সবার মনে কম-বেশি এক ধরনের স্বস্তির জায়গা তৈরি হচ্ছে। তবে শঙ্কায় কমছে না। কারণ কতদিন মেয়াদ থাকবে এই দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের? কেন এই প্রশ্ন, কেন এই শঙ্কা? কারণ এর আগেও প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন বিষয়ে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন কিন্তু খুব বেশিদিন জারি রাখতে পারেননি। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ও আমরা দেখেছি সারাদেশ নড়েচড়ে ওঠেছিল। আঠারোতে পা দেয়া কিশোর-তারুণ্য রাস্তায় নেমে এসেছিল একটু সংস্কারের আশায়। খুব আশান্বিত বিষয় ছিল যে, সবাই তাদের সেই নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন। সবাই তাদের লাইসেন্স দেখিয়েছিলেন। বাংলাদেশ দেখছিল একটি গণতান্ত্রিকভাবে নিয়মতান্ত্রিক একটি স্বপ্নের দেশের। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আবারও একই দশা। একই বিষয় ছিল মাদককে ঘিরেও। প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিষয়েও বেশ দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেছিলেন। সেই হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তৎপর ছিল বেশ কয়দিন। তারপর যেন কী হয়! সবই ফিরে যায় আগের অবস্থায়। কিছুতেই যেন সেই পরিবর্তন ধরে রাখা যায় না। এখন তাই জনমনেও এক ধরনের অবিশ্বাসের জায়গা। এটাও আগের গুলোর মতো লোক দেখানো নয় তো? আর এই রকম দুই-চারজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই কি পাল্টাবে সব? মোটেই নয়। এর আগেও দেখা গেছে দল থেকে বিভিন্ন অপরাধে বহিষ্কৃত হওয়াদের আবার দলে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে, কখনো কখনো নতুন দায়িত্ব দিয়েই। আবার অনেকের ক্ষেত্রে তাকে বহিষ্কার করে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে তার স্ত্রীকে। সে ক্ষেত্রে জনগণের চোখে ধূলি দেয়া ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলেই দলীয় নেতাদের অপরাধ প্রবণতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সব কাজ প্রধানমন্ত্রীনির্ভর হয়ে পড়ছে। তিনি না বললে কেউ নড়াচড়া করছেন না। বাংলাদেশে তোষামোদি সংস্কৃতির সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলে এটি, যার কারণে জনগণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কী করলে প্রধানমন্ত্রী খুশি হবেন আর কোনটি করলে তিনি বেজার হতে পারেন- সেই চিন্তায় আছে সবাই। সবার টার্গেট ক্ষমতার তোয়াজ করা, ক্ষমতার সেবা করা। কেউই সত্যিকারের জনগণের সেবক হয়ে উঠছেন না। সর্বশেষ প্রশ্ন হলো, দলের ভেতর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ঝাঁকুনি দলীয় নেতাকর্মীর ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলছে। এটি কি শুরু? তিনি কি শুদ্ধি অভিযানটি ঘর থেকেই চালু রাখবেন? নাকি এটি ছিল ভয় দেখানো মাত্র। জনগণ আসলে সেটিই দেখতে চায়, এটি কতদিন টিকে থাকে। দুর্নীতির চাষাবাদের এ দেশে শুদ্ধি অভিযান আসলে কতদিন জিইয়ে রাখা যাবে? তবে সরকারের আন্তরিকতার ওপরই যে এটি নির্ভর করবে অনেকখানি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

জোবাইদা নাসরীন : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App