×

মুক্তচিন্তা

প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতি সাধুবাদযোগ্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৯:০১ পিএম

একমাত্র প্রধানমন্ত্রীই পারেন প্রবল সাহস নিয়ে এদের মোকাবেলা করতে। নীতি ও আদর্শভ্রষ্ট ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ নেতাকর্মীদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতেই হবে। দেশ ধ্বংসের তথা বহু দাম দিয়ে কেনা আমাদের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার জন্য এদের চলমান দুষ্কর্মই যথেষ্ট! এসব নেতা নামধারীর কবল থেকে এই সংগঠনগুলোকে উদ্ধার করতে না পারলে অচিরেই সংকটের আবর্তে ছেয়ে যেতে পারে সব কিছু।

সন্ধ্যায় একটি গ্রোসারির দোকানে সামান্য কিছু কেনাকাটার জন্য ঢুকতেই পরিচিত এক বাঙালি ভদ্রলোকের প্রবল উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠস্বর শুনে সচকিত হয়ে উঠলাম। দেখলাম তিনি আরো তিন বাঙালি ভদ্রলোককে লক্ষ্য করে বলছেন, ‘এই না হলে শেখের বেটি। দেখলেন তো ছাত্রলীগের দুই প্রধান নেতাকে কীভাবে সংগঠন থেকে এক নিমিষেই তিনি বের করে দিলেন। অবিশ্যি, এদের আইনের হাতে সোপর্দ করে তাদের দুর্নীতি ও অন্যান্য অপকর্মের বিচার ও দণ্ডদান করা দরকার’ এই বলে তিনি চুপ করতেই অপর বয়স্ক এক ভদ্রলোক- যিনি পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট বলে উঠলেন, ‘দেশবাসী তো শেখের বেটির কাছ থেকে এ ধরনের কঠোর পদক্ষেপই প্রত্যাশা করে।’ দেশ দুর্নীতবাজ, ভণ্ড, ধড়িবাজ আর ইতর শ্রেণির মানুষে ছেয়ে গিয়েছে। নীতি-নৈতিকতা, দেশপ্রেম সবই এই শ্রেণির মানুষরূপী দানবদের কারণে আজ ভূলুণ্ঠিত। ইয়াজুজ-মাজুজের ক্ষুধা আর জিহ্বা নিয়ে দেশের সর্বত্রই এরা আজ হাজির হয়েছে আর জমি-জিরাত, নদী-নালা, খাল-বিল, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, কলকারখানা, পাহাড়-টিলা, বন-বাদাড়, রেল-বিমান- সব কিছুই এরা অবলীলায় সাবাড় করছে। যে যাচ্ছে লঙ্কায় সে-ই রাবণরূপে আত্মপ্রকাশ করছে। শিক্ষক-ছাত্র, রাজনীতিবিদ-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী, প্রকৌশলী-চিকিৎসক, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, সরকারি পিয়ন-চাপরাশি-দারোয়ান, বিভিন্ন স্তরের আমলা, বিচারক-আইনজীবী, ধর্মীয় নেতা তথা মোল্লা-পুরুত, মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিন, মাদ্রাসা শিক্ষক- মোদ্দাকথা সব শ্রেণি-পেশার মধ্যে দেশখেকো দানবদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার আর পেশিশক্তি ইস্তেমাল করে ক্ষমতাসীন দলের কিছু এমপি ও স্থানীয় জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীদের একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট সারাদেশে বেপরোয়াভাবে দখল-বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, কমিশন-বাণিজ্য, নিয়োগ ও বদলি-বাণিজ্য করে যাচ্ছে। আর এতে এরা সর্বপ্রকার সহযোগিতা পাচ্ছে পুলিশ, আদালত ও প্রশাসনের অন্যান্য কর্তাব্যক্তির কাছ থেকে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুলিশের যেমন অনেক সাফল্য আছে তেমনি আবার বেশ কিছু কলঙ্কজনক ও জনবিরোধী অত্যন্ত গর্হিত কাজে তাদের সম্পৃক্তের কথাও সর্বজনবিদিত। এ অবস্থা চলতে পারে না, চলতে দেয়া যায় না। কেননা এই ধারা অব্যাহত থাকার অর্থ দেশ গোল্লায় যাওয়া বা সম্পূর্ণভাবে বিপন্ন হওয়ার পথ সুপ্রশস্ত হওয়া। সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যে সাহস, প্রত্যয়বোধ, নীতিনিষ্ঠা, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের মানসিকতা থাকা দরকার তা প্রধানমন্ত্রী ব্যতিরেকে আর কারো মাঝে খুঁজে পাওয়া যাবে কি? গণতান্ত্রিক ইনস্টিটিউটগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগদান ও দলের মধ্যে নীতিনিষ্ঠ ও আদর্শিক সাংগঠনিক চর্চা ছাড়া এই দুর্নীতিবাজদের খপ্পর থেকে দেশকে বের করে আনা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আমাদের রাজনীতিক, আমলা ও বিভিন্ন পেশাজীবীর বড় একটি অংশের মাঝেই এই চেতনাবোধ বলতে গেলে একেবারেই অনুপস্থিত। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার ও দণ্ডদান আর দেশি-বিদেশি সব কায়েমি স্বার্থের জটাজাল ছিন্ন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তাদের দণ্ড কার্যকর করার মাধ্যমে যে ইতিহাস রচনা করেছেন ধর্মের আলোকে ও ন্যায়ের দুয়ারে তা ‘নিষ্কলুষ, অম্লান, অনির্বাণ ও সত্যস্বরূপ’! আর এ কারণেই তিনি বাংলার ইতিহাসে অক্ষয়, অনবদ্য ও অবিসংবাদিত নেতার মহিমায় সমাসীন থাকবেন চিরকাল। আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধুকে তার জীবদ্দশায় এক শ্রেণির চাটার দল, চোর-ছ্যাঁচোড় আর দুর্বৃত্ত কী অসহনীয় যন্ত্রণা আর অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। দেশটিকে স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা দিয়ে এর গণমানুষকে উজ্জীবিত করে বিশ্বে বাঙালিকে তার স্বমহিমায় উচ্চকিত করে মেলে ধরতে কী কায়-ক্লেশ, নির্যাতন-লাঞ্ছনা ও আত্মার শত অপমান আর জেল-জুলুমই না তিনি সহ্য করেছেন! তিনি ওই দেশবিরোধী দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে চেয়েছেন কিন্তু আস্তিনের নিচে ছুরি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ব্রুটাস-সিনা-ক্যাসিয়াসরা তার সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে গভীর চক্রান্তের মাধ্যমে তাকে সপরিবারে হত্যা করে দেশটিকে পাকিস্তানি বস্তা-পচা প্রতিক্রিয়াশীল ধারায় ফিরিয়ে নেয়ার আয়োজন করে। এসব কথাই দেশবাসীর জানা। এখানে এসবের অবতারণার কারণ এই যে, তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ পাকা মাঝি-মাল্লার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দুর্নীতিবাজ-ঠগবাজ-ধড়িবাজ-মতলববাজ-চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হয়েছেন, যা দেশবাসীর একান্তই প্রত্যাশিত। ছাত্রলীগের যে গৌরবজনক ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে তা বর্তমান সময়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের জানা আছে কি? না নেই। কীভাবেই বা তা থাকবে যদি কিনা সংগঠন অভ্যন্তরে সেসব গৌরব গাথার কথা নিয়মিত চর্চিত না হয়? ছাত্ররাজনীতি বলতে কী বোঝায় এবং ছাত্ররাজনীতি কতটুকু সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকবে তা যদি নির্ণিত ও নির্দিষ্ট না হয় তাহলে ছাত্ররা আবোল-তাবোল সব কাজেই লিপ্ত হবে বৈকি! ছাত্রলীগ ও যুবলীগসহ ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন টেন্ডারবাজি, হলে সিট-বাণিজ্য, বাইরে ফুটপাত ও বস্তি দখল-বাণিজ্য থেকে শুরু করে হেন কোনো অপকর্ম নেই যার সঙ্গে লিপ্ত নেই। কীভাবে তারা এ জাতীয় কুকর্মের সঙ্গে যুক্ত হলো বা হচ্ছে তা বের করা কি খুব কঠিন কাজ? এদের পেছনে কিছু অসাধু-অসৎ ও দেশবিরোধী ব্যবসায়ী, মাফিয়া, সিন্ডিকেট, আরো সহজ ভাষায় বলতে গেলে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগেরই সাবেক কিছু নেতা ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতা আছে যারা নিজেদের অবৈধ সব কর্মকাণ্ড পরিচালনায় এদের ব্যবহার করে থাকে নিয়মিতভাবে। পুলিশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এরাই ম্যানেজ করে আর অবৈধ উপায়ে অর্জিত কামাইয়ের অর্থ ছাত্রদের সঙ্গে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়। প্রধানমন্ত্রী একটু খোঁজ নিলেই এসব গড ফাদারকে পেয়ে যাবেন (আমার বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে এদের তত্ত্ব-তালাশ নিয়েছেন বা নিচ্ছেন)। ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদক কোটি কোটি টাকার কমিশন-বাণিজ্য ও অন্যান্য দুষ্কর্ম করে ফেরে এ যে ঐতিহ্যবাহী সংগঠন আওয়ামী লীগ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আকাশ ছোঁয়া ভাবমূর্তিকে কতখানি মলিন করে তা কি এই দুর্বৃত্তদের জানা আছে? না নেই, এ নিয়ে ওদের কোনো ভাবনাও নেই। কেবলই নিজের আখের গোছানো আর গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করার মধ্যে এদের তৃপ্তি! দেশ যাক না রসাতলে তাতে এদের কিছুই যায় আসে না! প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের এই অপকর্মের প্রতিবিধানের জন্য যে শক্ত পদক্ষেপ নিয়েছেন তাতে দেশের মানুষ এক কথায় খুশি। তবে বিভিন্ন মহলে এ প্রসঙ্গে কথা বলে দেখেছি যে তারা আরো মনে করে এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে অতি অবশ্যই এই দানব-দলনী রূপটি বজায় রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী, আপনি আপনার অত্যন্ত বিশ্বস্ত কিছু লোকের সমন্বয়ে অবিলম্বে একটি কমিটি গঠন করুন (এই কমিটিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের পরীক্ষিত ও নিবেদিতপ্রাণ বিভিন্ন জেলার অ্যাক্টিভিস্টদেরও যুক্ত করুন), যাদের কাজ হবে স্থানীয় প্রশাসন, ক্ষমতাসীন ও অন্য দলের নেতাকর্মীদের তৎপরতা ইত্যাদি পর্যালোচনা করা আর সে ক্ষেত্রে তারা কেবলই স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়-স্নাত সাধারণ মানুষের মতামত সংগ্রহ ও যাচাই করে অতিসত্বর আপনার কাছে একটি রিপোর্ট পেশ করবে। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলোর যেসব নেতাকর্মী প্রশাসন যন্ত্রের সহায়তায় সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে নিরীহ মানুষের জমি-জিরাত জোরপূর্বক দখল থেকে শুরু করে যেসব দুর্বৃত্তপনার মাধ্যমে জনদুর্ভোগের কারণ ঘটাচ্ছে তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হবে এবং অতঃপর তাৎক্ষণিকভাবে এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের সমর্থন যে অচিরেই আকাশচুম্বী রূপ ধারণ করবে তা তো বলাই বাহুল্য! একমাত্র প্রধানমন্ত্রীই পারেন প্রবল সাহস নিয়ে এদের মোকাবেলা করতে। নীতি ও আদর্শভ্রষ্ট ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ নেতাকর্মীদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতেই হবে। প্রধানমন্ত্রীর নিশ্চয়ই নীতিহীন-আদর্শহীন আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগ ‘নেতাদের’ প্রকৃত স্বরূপ জানা আছে। তিনি জানেন যে, এরা আদতে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক না তার নিজের লোক! এরা সব মতলববাজ। দেশ ধ্বংসের তথা বহু দাম দিয়ে কেনা আমাদের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার জন্য এদের চলমান দুষ্কর্মই যথেষ্ট! এসব নেতা নামধারীর কবল থেকে এই সংগঠনগুলোকে উদ্ধার করতে না পারলে অচিরেই সংকটের আবর্তে ছেয়ে যেতে পারে সব কিছু। সব কিছু আঁধারে ঢেকে পড়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী যে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন তা যেন কোনো আই ওয়াশে পরিণত না হয় সেদিকে সার্বক্ষণিক নজর রাখা আবশ্যক।

শাহীন রেজা নূর : কলাম লেখক ও সাংবাদিক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App