×

আন্তর্জাতিক

ধর্ম নয়, আধিপত্যবাদই অনার কিলিংয়ের মূল কারণ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৮:১৫ পিএম

ধর্ম নয়, আধিপত্যবাদই অনার কিলিংয়ের মূল কারণ
ধর্ম নয়, আধিপত্যবাদই অনার কিলিংয়ের মূল কারণ
ধর্ম নয়, আধিপত্যবাদই অনার কিলিংয়ের মূল কারণ
পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে নিজ ভাইয়ের হাতে হত্যার শিকার হন পাকিস্তানের সোশ্যাল মিডিয়া সেলেব্রিটি কান্দিল বালোচ। হত্যাকারীর ভাষ্যমতে কান্দিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খোলামেলা পশ্চিমা ধাচের ছবি প্রকাশ করায় তার পরিবারের সম্মানহানি ঘটেছে। আর তাই পরিবারকে এই সম্মানহানির দায়মুক্ত করতেই তিনি তার বোনকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছেন। সম্প্রতি পাকিস্তানের একটি আদালত বোনের হত্যার দায়ে কান্দিল বালোচের ভাই ওয়াসিমকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। এ ঘটনায় বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী শুধু ২০১৫ সালেই পাকিস্তানে প্রায় সহস্রাধিক অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে৷ পাকিস্তানের গ্রামীণ সমাজে অনার কিলিংয়ের প্রতি জনসাধারণেরও সমর্থন থাকার ফলে, এই কুপ্রথা দূর করার যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যাহত হয়েছে ও হচ্ছে৷ ইতিপূর্বে নিহতের পরিবার হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দিলে সে ছাড় পেতো; এ'বছর আইনের সে ফাঁকটি বন্ধ করা হয়েছে৷ গত এক দশকের কিছু অনার কিলিংয়ের ঘটনা উল্লেখ করলে সবচেয়ে বেশিবার পাকিস্তানের কথাই উঠে আসে। ২০১১ সালে পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখাওয়া  প্রদেশের আকোরা খাতাক শহরের ১৮ বছরের মেয়ে রোকসানা এবং ২২ বছরের ছেলে ইউনুস পালিয়ে বিয়ে করে আশ্রয় নেন আকোরা খাতাক অঞ্চলের মাটির এক  ঘরে। পরিবারের সম্মানহানির দায়ে তারাও শিকার হন অনার কিলিংয়ের। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে দুচোখ দিয়ে জল পড়ছিল রোখসানার। তিনি বলেন, 'সেদিন  আমরা দুজন বিছানায় ঘুমিয়ে ছিলাম। আমি ঘুমের মধ্যেও পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। চোখ খুলে দেখি, আমার সামনে অস্ত্রধারী অনেকগুলো লোক। বুঝতে  পারছিলাম, আমার জীবন আজ শেষ। আমি আমার স্বামীকে চিত্কার করে ডাকছিলাম।' রোখসানার ভাষ্য, 'প্রচলিত নিয়ম না মানার কারণে তারা প্রথমে আমাকে গুলি করল, এরপর আমার স্বামীকে। তারা এত গুলি ছুড়েছিল, মনে হচ্ছিল যেন কোনো বিস্ফোরণ ঘটেছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছিলাম আমরা। আমি আমার স্বামীর কাছে যেতে পারছিলাম না। তাঁকে ডাকছিলাম। এক মুহূর্তের জন্য সে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করল।' এর প্রায় ১৫ মিনিট পর কয়েকজন প্রতিবেশী এসে রোকসানাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। আর সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। এরপর এ ঘটনায় মামলা করেছেন রোকসানা। ২০১৪ সালের ২৭ মে পাকিস্তানের লাহোর শহরে প্রেমিককে বিয়ে করার দোষে হাইকোর্টের সামনে পাথর ছুঁড়ে ফারজানা ইকবালকে হত্যা করে তাঁর পরিবারের সদস্যরা৷ প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী পরিবারের সম্মতির বাইরে গিয়ে নিজের পছন্দে কোনো ছেলে-মেয়ে বিয়ে করলে বা কোনো ধরনের সম্পর্ক গড়ে তুললে সেই সম্পর্ককে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত এলাকায় পরিবারের 'অনার কিলিং' এর যোগ্য বলে মনে করা হয়। এর শাস্তি হিসেবে ওই মেয়ের পরিবারের প্রথমে মেয়েটিকে, এরপর ছেলেটিকে হত্যা করার অধিকার রয়েছে। দেশে দেশে অনার কিলিং প্রচলিত। নারীরা হয় এই অনার কিলিং এর প্রধান শিকার। পাকিস্তান, জর্ডান, লেবানন, মরোক্কো, সিরিয়ান রিপাবলিক ছাড়া  অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশে এ প্রথা অধিক প্রচলিত। তবে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানীর মত উন্নত দেশেও অনার কিলিং এর খবর পাওয়া যায়। নিজ পরিবার বা গোত্রের সম্মান হানির বিচারের নামে প্রতি বছর সারা বিশ্বে কত কিশোরী, তরুণী ও মহিলাকে শারীরিক নির্যাতনের পর নির্মম নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই৷ ২০০০ সাল থেকে বিক্ষিপ্তভাবে সংগৃহীত ও প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা বিশ্বে বছরে প্রায় ৫ হাজার অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে থাকে৷জাতিসংঘের বিবৃতির সঙ্গেও মেলে৷ কিন্তু সংখ্যাটি নিশ্চিত করার কোনো উপায় নেই, কারণ মৃতদেহ এত যত্ন সহকারে লুকিয়ে ফেলা হয় কিংবা নষ্ট করে ফেলা হয় যে তা চিহ্নিত করারই আর কোনো উপায় থাকে না। যেহেতু বহু অনার কিলিংয়ের ঘটনাকে দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হয়, সেহেতু বাস্তব পরিসংখ্যান এর চারগুণ হলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই৷ ভারতে প্রতিবছর প্রায় হাজার খানেক অনার কিলিং হয় বলে অনুমান করা হয়, যদিও বাস্তবিক সংখ্যা জানা সম্ভব নয়৷ উত্তর ভারতে, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশ ও হরিয়ানাতেই অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে বেশি, দক্ষিণ ভারত বা মহারাষ্ট্র কিংবা গুজরাটে সে তুলনায় কম৷ অনার কিলিংয়ের খবর পাওয়া গেছে পাঞ্জাব ও বিহার থেকেও৷ পশ্চিমবঙ্গে অনার কিলিং গত একশ বছর ধরেই প্রায় নেই বললেই চলে৷ ব্রিটেনে অভিবাসীদের মধ্যে অনার কিলিং বিরল নয়৷ কুর্দি, পাকিস্তানি ও সিরীয় বাবারা নিজেদের মেয়েদের স্বহস্তে হত্যা করছেন, এমন ঘটনা বারংবার ঘটেছে৷ ২০১০ সালে এক শিখ পিতা তাঁর কন্যাকে হত্যা করেন৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষিপ্ত হলেও, অভিবাসী সম্প্রদায়গুলির মধ্যে একাধিক অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটেছে৷ জার্মানি ও ইউরোপের অন্য কয়েকটি দেশেও অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটেছে৷ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনার কিলিংয়ের খবর এখনো পাওয়া যায়নি৷ তবে পরিবারের পছন্দে বিয়ে না করার কারণে হত্যার ঘটনা বেশ কিছু ঘটেছে৷তাই বলাই যায় যে অনার কিলিংয়ের মানসিক অবস্থা বাংলাদেশে বিদ্যমান৷ পাকিস্তানের মতো এখানে ততোটা প্রকট নয়৷ তবে যতোটা হচ্ছে তা ব্যক্তি ও পরিবারের অহংবোধ থেকেই হচ্ছে। তবে এ ধরনের ঘটনা বাড়তে থাকলে সেটা অনার কিলিংয়ের রুপে আবির্ভূত হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। বহুল প্রচলিত একটি ভ্রান্ত ধারণা হলো, ইসলাম ধর্মের সাথে মিশে আছে অনার কিলিংয়ের অস্তিত্ব। তবে কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। কেননা শিখ, হিন্দু আর খ্রিস্টান পরিবারগুলোতেও অনার কিলিংয়ের রেকর্ড রয়েছে। ভারত বা পাকিস্তান এলাকায় এই প্রথার প্রচলন মাত্রাতিরিক্ত হলেও পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই তা কম-বেশি দেখা যায় “অনার কিলিংয়ের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই, পুরো ব্যাপারটাই নিয়ন্ত্রণ আর আধিপত্য বিস্তারের সাথে জড়িত,” জানান প্রখ্যাত ডকুমেন্টারি নির্মাতা শারমিন ওবায়েদ চিনয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App