×

সাময়িকী

লেখক শেখ হাসিনা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৯:০৭ পিএম

লেখক শেখ হাসিনা
লেখক শেখ হাসিনা
লেখক শেখ হাসিনা

‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ শেখ হাসিনার একটি অনন্য সুন্দর সৃষ্টি। এ বইটিতে শেখ হাসিনার সাহিত্য প্রতিভার সবটুকু নির্যাস অনুভব করা যায়। বইটি তিনি লিখতে শুরু করেন ২০০৮ সালে বিশেষ কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায়।

১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর জন্ম। বর্ষার পানিতে ঝাঁপিয়ে, শীতের রোদ গায়ে মেখে, ঘাসফুল আর পাতায় পাতায় শিশিরের ঘ্রাণ নিয়ে বেড়ে ওঠে এক কিশোরী। স্মৃতির ডালা মেলে তিনি লিখেন, ‘খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নদীর ধারে বেড়ানো, শীতের দিনে নদীর উষ্ণ পানিতে পা ভেজানো আমার কাছে ভীষণ রকম লোভনীয় ছিল। নদীর পানিতে জোড়া নারকেল ভাসিয়ে অথবা কলাগাছ ফেলে সাঁতার কাটা, গামছা বিছিয়ে টেংরা, পুঁটি, খল্লা মাছ ধরা। বর্ষাকালে খালে অনেক কচুরিপানা ভেসে আসতো। সেই কচুরিপানা টেনে তুললে তার শেকড় থেকে বেরিয়ে আসতো কই আর বাইন মাছ। একবার একটা সাপ দেখে খুব ভয় পেয়েছিলাম’। এইটুকু পড়ে যে কেউ ভাবতেই পারেন এ বুঝি কোনো প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকেরই লেখা। ১৯৮৮ সালের এপ্রিল মাসে সাপ্তাহিক রোববারে যখন ‘স্মৃতির দখিন দুয়ার’ নামে এ লেখা প্রকাশিত হয় তখন এক নবীন লেখকের নাম জানা যায়, তিনি শেখ হাসিনা। লেখক হিসেবে তিনি তখন প্রথম পরিচিত হলেও দেশবাসীর কাছে ইতোপূর্বেই তিনি স্বনামধন্য এক রাজনীতিক। তারচেয়েও বড় পরিচয় তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা। দেশে তখন স্বৈরতন্ত্র চলছে। তিনি জানপ্রাণ দিয়ে তার বিরুদ্ধে লড়ছেন। স্বৈরতন্ত্র বিদায় করে সেই লড়াকু কন্যা দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু দুষ্টচক্রের চক্রান্তের কারণে প্রথমবার ক্ষমতায় বসতে পারেননি। ১৯৯৬ সালে তিনি প্রথমারের মতো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ফের ছন্দপতন ঘটে ২০০১ সালে। দেশ চলে যায় পাকিস্তানপন্থিদের হাতে। সে এক নিদারুণ সময়। নিকষ অন্ধকার চারদিকে। ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসে আজ অবধি অন্যায়-অনাচরের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে এই লেখায় আমরা অন্য এক শেখ হাসিনাকে খুঁজবো। আমরা খুঁজবো তাঁর লেখকসত্তাকে। যদিও তাঁর লেখকসত্তায় একেবারে জন্মসূত্রে মিশে আছে রাজনীতি। আছে এই বাংলার ঘাস-ফুল নদী, মাটি ও মানুষের স্পর্শ। তাঁর কলম থেকে কালি ঝরে না। অবিরত ঝরে যায় অশ্রু, রক্ত আর স্বপ্ন। ‘ওরা টোকাই কেন’ শেখ হাসিনার প্রথম বই, ‘ওরা টোকাই কেন’, প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। আগামী প্রকাশনী থেকে। লেখাগুলোকে ঠিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ নাকি স্মৃতিচারণা বলা যায় তা নিয়ে দ্বন্দ্ব হতে পারে। প্রতিটা লেখাতেই যেমন তাঁর ব্যক্তিগত কিছু স্মৃতি জড়িত আছে তেমনি আছে সমাজবিশ্লেষণের এক অপরূপ দৃষ্টিভঙ্গি। শিরোনামগুলো দেখলেই বোঝা যাবে তাঁর ভাবনার ডালপালা কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত : স্মৃতির দখিন দুয়ার, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, রাষ্ট্রীয় ধর্ম কার স্বার্থে, বন্যাদুর্গত মানুষের সঙ্গে, নূর হোসেন, ওরা টোকাই কেন। মাত্র ৭২ পৃষ্ঠার বইয়ে তিনি পুরো বাংলাদেশেরই একটা পরিপূর্ণ সমাজচিত্র উপস্থাপন করেছেন। সে জন্য কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, ‘তাঁর চোখে কথা বলে চলে/যেন ছাপান্নহাজার বর্গমাইল।’ বইটির ভূমিকা লিখেছেন তাঁর শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আনিসুজ্জামান। ভূমিকায় আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘গভীর এক বেদনাবোধ থেকে শেখ হাসিনা অবলোকন করেছেন পারিপ্বর্শকে। সেই বেদনাবোধ ছড়িয়ে আছে তাঁর রচনার অধিকাংশ স্থানে।’ কী সেই বেদনা? বাবা, মা, ভাই ও আত্মীয়-স্বজন হারা তিনি এক সর্বহারা। স্বদেশ থেকে মুছে দেয়া হচ্ছে বঙ্গবন্ধু নাম, তাঁর আদর্শ। ছোট ছোট দুই সন্তান ঘরে রেখে তিনি পথে পথে ঘুরছেন সেই আদর্শের খোঁজে। কখনো এক হচ্ছেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে, কখনো বন্যাদুর্গত মানুষের সেবায়, কখনোবা পথশিশুদের দেখে তাঁর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠছে। সেইসব অভিজ্ঞতাই লিপিবদ্ধ করছেন তাঁর লেখায়। ১৯৮৮ সালে একবার গ্রামে যান কিছুদিনের জন্য থাকতে। উদ্দেশ্য বাবার কবরটি সংস্কার করা আর গ্রামের মানুষদের সাথে কয়েকটা দিন থাকা। গিয়ে পড়লেন ভয়াবহ বন্যায়। ঢাকায় আসার সব পথ বন্ধ। তাই গ্রামেই ছিলেন ২৫ দিন। এ ক’টা দিন তিনি ঘরে বসে ছিলেন না। নৌকা, স্পিডবোট করে পুরো গোপালগঞ্জ ঘুরে বেড়ালেন। ত্রাণ দিলেন। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন, ‘বন্যাদুর্গত মানুষের সঙ্গে’ : ‘ঘরের ভিতরে মাচা বেঁধে বসবাস করছে সিরাজের মা, হঠাৎ দেখে পানির মধ্যে কি যেন নড়াচড়া করে। ফিরে তাকাতেই চোখে পড়ল, ‘ওরে বাবারে এইটা কি’ বলে মাচা থেকে লাফ দিয়ে পড়ল ঘরের বাইরে যাবার জন্য। ওদিকে পানির ভিতরে ছিল এক কাতলা মাছ। মাচার উপরের বাসিন্দা যেই না ভয়ে পানিতে লাফ দিয়েছে, পানির বাসিন্দাও ভয় পেয়ে এক লাফে মাচার উপরে। ভেলায় করে মানুষ যাচ্ছে। হঠাৎ গোখরা সাপ উঠল ভেলার ওপর। উঠেই ফোঁস করে ফণা তুলল। সে মানুষ আর করে কি? প্রাণের ভয়ে পানিতে দিল ঝাঁপ। জীবনের প্রয়োজনে কার স্থান যে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় কেউ সঠিক বলতে পারে না। প্রকৃতির খেলাই এমন, জীব-জানোয়ার শত্রু-মিত্র সব যেন একাকার।’

হাজার হাজার মানুষ বন্যাক্রান্ত, খাদ্য নেই, খাবার পানি নেই, মানুষ আর গরু-ছাগল এক জায়গায় জড়াজড়ি করে আছে। সন্তান হারিয়ে মা চোখের পানি ফেলছে। তাই তাঁর মন ভারাক্রান্ত। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘পানির কারণে সন্তান হারিয়েছে আবার চোখের পানিই ফেলছে। কী বিচিত্র খেলা!’ এই যে তাঁর দেখার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, ছোটখাটো মন্তব্য, তা কখনোই শুধু একজন রাজনীতিবিদের নয়, একজন প্রকৃত লেখকের। তিনি শুধু কিছু টুকরো মন্তব্য করেই ক্ষান্ত হননি। যথাযথ বিশ্লেষণও করেছেন। বাংলাদেশে কেন এত বন্যা হয়, বন্যার কী প্রভাব পড়ে, তাতে জনজীবন কী পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কীভাবে এর প্রতিরোধ করা সম্ভব এ নিয়ে আছে দীর্ঘ আলাপ। সে আলাপে আমরা আজ যাবো না। এই বইয়ে ‘রাষ্ট্রীয় ধর্ম কার স্বার্থে’ লেখাটাকে পরিপূর্ণ প্রবন্ধ বলা যায়। এখানে স্মৃতিচারণা নেই বললেই চলে। এ প্রবন্ধে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কী বোঝায়, ইসলাম যে একটা শান্তির ধর্ম, পবিত্র কোরান শরিফের মধ্যেই যে ধর্মনিরপেক্ষতার অমর বাণী গ্রন্থিত আছে তা তিনি অতি সংক্ষেপে মাত্র ছয়-সাত পৃষ্ঠায় বুঝিয়ে দিয়েছেন। লেখাটি অবশ্যই আজো সবার পাঠ্য বলেই মনে করি। নূর হোসেনকে নিয়ে একটি লেখা আছে। অনিবার্যভাবে এটি স্মৃতিচারণানির্ভরই। গণতন্ত্রের জন্য শহীদ হয়েছিলেন নূর হোসেন। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সমস্ত ঢাকা অবরোধ। জেনারেল এরশাদের স্বৈরসরকারকে হঠানোর জন্য অবরোধ আন্দোলনে ডাক দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তখন মিছিলের সামনে খালি গায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল এক দৃপ্ত যুবক : বুকে-পিঠে সাদা রঙের কালিতে লেখা দুটি স্লোগান : বুকে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। কে একজন গিয়ে তাকে শেখ হাসিনার কাছে নিয়ে এলো। শেখ হাসিনা তাকে বললেন, ‘জামাটা গায়ে দাও, একি সর্বনাশ করেছো, ওরা যে তোমাকে গুলি করে মারবে।’ নূর হোসেন মাথাটা এলিয়ে দিলেন প্রিয় নেত্রীর কাছে। বললেন, ‘জান দিয়া দিমু আপা, আপনে শুধু মাথায় হাত বুলাইয়া দ্যান।’ না, শেখ হাসিনা জান চাননি। তিনি বলেছিলেন, ‘না, জীবন দেবে ক্যানো, আমি আর শহীদ চাই না, আমি গাজী চাই। ও কথা আর মুখেও আনবে না। জামাটা গায়ে দাও। ওরা তোমাকে গুলি করবে।’ ঠিক যেন এক ভাইকে এক বড়বোনের কথা। আমি খুব কাছ থেকে এই বড়বোনকে দেখেছি। তাঁর স্নেহধন্য হয়েছি। একটু পরেই গুলিস্তান জিরো পয়েন্টের কাছে গিয়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন নূর হোসেন। শেখ হাসিনা বুক ফাটা আর্তনাদে লিখেন, ‘নূর হোসেন তোমার প্রতি সমগ্র জাতির আজ অঙ্গীকার। তুমি প্রতিবাদের প্রতীক। এ অবস্থার পরিবর্তন আমরা ঘটাবই। তুমি আজ প্রতিবাদের পোস্টার হয়ে রয়েছে প্রতিটি মুক্তিকামী বাঙালির হৃদয়ে। তোমাকে হাজার সালাম।’ বইটির শেষ লেখা ‘ওরা টোকাই কেন’। একটি স্মৃতিচারণা দিয়ে শুরু হলেও লেখাটি শেষ হয়েছে অসামান্য এক সমাজবিশ্লেষণ দিয়ে। কেন বাংলাদেশের হাজার হাজার শিশু রাস্তায় থাকে এর উত্তর শেখ হাসিনা খুঁজেছেন একেবারে সমাজের মূলে গিয়ে। দারিদ্র্য, অনাচার, অত্যাচার, ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা, দীর্ঘকালব্যাপী সামন্ত সমাজের নিয়ম-রীতি বহাল, পুরুষের বহুবিবাহ, নারীদের বঞ্চনা, পরিবার ভাঙা, প্রশাসনিক ব্যবস্থার অবহেলা, সুষ্ঠু রাজনৈতিক পদক্ষেপের অভাব সমস্ত কিছুই যে এর পেছনে দায়ী তা তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছেন। তাই অবাক হই না যখন তিনি এই হতভাগ্য মানুষগুলোর জন্য নানা মাত্রিক সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নির্ধারণ করেন। বাজেটে বরাদ্দ দেন।

শেখ হাসিনার যত বই শেখ হাসিনার মোট কতগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা নানা কারণে একটু জটিল। এর মানে এই না যে তার প্রচুর বই প্রকাশিত হয়েছে। গত ৩০ বছরে তাঁর বই বেরিয়েছে হাতে গোনা ১০-১২টা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কিছু বই একাধিক নামে বেরিয়েছে। কিছু বইয়ের ইংরেজি সংস্করণ বেরিয়েছে। কিছু বই নতুন নামে পুরনো লেখার পুনঃমুদ্র্রণ হয়েছে। এর মধ্যে বেরিয়েছে নির্বাচিত প্রবন্ধ ও রচনা সমগ্র, ১, ২। তার সঙ্গে আছে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ, তাঁর সংকলিত ভাষণ, উক্তি। সব মিলিয়ে প্রায় ২০টির মতো বই তাঁর নামে এখন বাজারে পাওয়া যায়। এ ছাড়া সাহিত্যের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ সম্পাদনা। বিশেষ করে জাতির পিতার অসমাপ্ত আত্মজীবনী (ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, প্রথম প্রকাশ ২০১২), কারাগারের রোজনামচা, বাংলা একাডেমি, প্রথম প্রকাশ ২০১৭; বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯৭২-৭৫), যৌথ সম্পাদনা শেখ হাসিনা, বেবী মওদুদ, আগামী প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৮; বাংলা আমার আমি বাংলার, যৌথ সম্পাদনা শেখ হাসিনা, বেবী মওদুদ; বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, রাবেয়া বুকস, ২০১৯ ইত্যাদি। এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর ওপর গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোর সম্পাদনা করেছেন তিনি। মাওলা ব্রাদার্স দুটো খণ্ড এরই মধ্যে বের করেছে। বঙ্গবন্ধুর লেখা আরো কয়েকটি বইয়ের সম্পাদনা সম্পন্ন করেছিলেন তিনি। আমার বড়ই সৌভাগ্য আমার লেখা ‘বঙ্গবন্ধু সহজ পাঠ’ বইটিও তিনি সম্পাদনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ওপর আমার বড় বইটির নামও তিনি ঠিক করে দিয়েছিলেন। স্মরণীয় যে শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের চেয়ারম্যান। শেখ হাসিনা ভাষণ নিয়ে আলাদা করে বেশ কয়েকটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তাতে ঠাঁই পেয়েছে নব্বই-এর গণআন্দোলনে বক্তব্য-ভাষণ, বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে সংসদে প্রদত্ত ভাষণ, ১৯৯৬-২০০০ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ভাষণ, ২০০৭ থেকে চলমান সময় পর্যন্ত কিছু ভাষণের সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন নিয়ে শেখ হাসিনার ইংরেজি ভাষণগুলো বাংলায় রূপান্তর করে প্রকাশ করেছে অনুপম প্রকাশনী, ২০০৭ সালে। ১৯৮৭-১৯৯৪ পর্যন্ত জাতীয় সংসদে শেখ হাসিনার প্রদত্ত ভাষণ সংকলন ও সম্পাদনা করেছিলেন পান্না কায়সার। আগামী প্রকাশনী থেকে বইটি বেরোয় ১৯৯৮ সালে। বইটি অত্যন্ত সুপরিচিত। ‘জাতিসংঘ মিলেনিয়াম সামিটে শেখ হাসিনা’ গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন মোনায়েম সরকার। বইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লিখেছিলেন প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া। কিছু উল্লেখযোগ্য বইয়ের পর্যালোচনা উল্লেখ্য যে, শেখ হাসিনার প্রথমদিকে প্রকাশিত তিনটি বই : ‘ওরা টোকাই কেন’, ‘বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম’, ‘দারিদ্র্য দূরীকরণ কিছু চিন্তাভাবনা’ নিয়ে আমি ২০০৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য পাতায় বিশাল একটি লেখা লিখি। লেখার শিরোনাম ছিল : অপরাজেয় সংকল্প শক্তি ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়। সেখানে আমি লিখেছিলাম, মানুষের অসহায়ত্ব এবং স্বচেষ্টায় তাদের ঘুরে দাঁড়াবার ভঙ্গিটি ডায়রির মতো সে সব খণ্ড চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন অনায়াসে এক নিজস্ব স্টাইলে। তাঁর লেখার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিটি ঘটনা অন্তর দিয়ে দেখা এবং মানবিক এক দৃষ্টিভঙ্গিতে তার বিশ্লেষণ। শেখ হাসিনা তাঁর লেখায় অনায়াসে রাজনীতিকে মিশিয়েছেন। মোটেও আরোপিত নয় সেই মিশ্রণ। স্বাভাবিকভাবেই তা মিশেছে। শত্রুপক্ষকেও যেমন সাহসী ভাষায় আক্রমণ করেছেন তেমনি স্বদেশের উন্নয়নেরও স্বপ্ন দেখিয়েছেন। মনে রাখতে হবে তিনি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজগুলো নিয়ে মাঠে নেমেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সাথে এ প্রজন্মের এক শক্ত সেতুবন্ধন করতে তিনি বদ্ধপরিকর। ফলে তাঁর লেখায় সমাজচিত্রই প্রধান। দারিদ্র্য দূরীকরণ : কিছু চিন্তাভাবনা (১৯৯৫) বইটিতে তিনি দারিদ্র্য নিরসনের জন্য সুচিন্তিত মতামত তুলে ধরেছেন অনেক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে। বিশেষ করে দারিদ্র্য নিরসন না করা গেলে যে গণতন্ত্রের কোনো অর্থই থাকে না সে কথাটি খুবই স্পষ্টভাবে যুক্তি দিয়ে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের চিন্তা-চেতনাকে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের নিগড়ে বেঁধে না ফেলতে পারলে যে দারিদ্র্য দূরীকরণের জাতীয় কর্মসূচি তৈরি করা সম্ভব হবে না সে কথাটিও তিনি বলতে ভুলে যাননি। বিশেষ করে একানব্বইয়ে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের নেতৃত্বে তৈরি টাস্কফোর্স প্রতিবেদনে দারিদ্র্য নিরসনের জন্য যেসব নীতি পরামর্শ দেয়া হয়েছিল সেগুলোর তিনি প্রশংসা করেন। তৎকালীন সরকার এসব নীতি পরামর্শকে রাজনৈতিক অঙ্গীকারে কেন রূপান্তর করতে পারল না- সে প্রশ্নও তিনি করেছেন। উল্লেখ, ঐ টাস্কফোর্সের আমি একজন সদস্য ছিলাম। সময় অনুযায়ী তাঁর লেখার ধরন ও বিষয় পাল্টিয়েছে। ২০০০ সালের আগে তাঁর লেখায় গুরুত্ব পেয়েছে স্বৈরতন্ত্র, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, দারিদ্র্য দূরীকরণ, বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়। বিশেষ করে ২০০১ সালে দেশে আবার স্বাধীনতাবিরোধী এক ক্ষমতাচক্র সরকারে বসলে তিনি প্রবল বিদ্রোহে ফেটে পড়েন। লিখেন, ‘বিপন্ন গণতন্ত্র লাঞ্ছিত মানবতা’ (২০০২) ও ‘সহে না মানবতার অবমাননা’ (২০০৩) নামে দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বিপন্ন গণতন্ত্র লাঞ্ছিত মানবতা (২০০২) গ্রন্থের প্রথম লেখা : আমার কলেজ জীবন। তিনি গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ)-এ পড়তেন। এ কলেজে পড়ার সময়ই রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি। এ কলেজে পড়ার সময় ছাত্রীদের জড়ো করে তিনি প্রথম ইট দিয়ে শহীদ মিনার তৈরি করেছিলেন। পাকিস্তান আমলের প্রিন্সিপাল কিছুতেই কলেজের ভেতর শহীদ মিনার বানাতে দিবেন না। কিন্তু তাঁর নিজের ভাষায়, ‘আমাদের আন্দোলন বেশ তুঙ্গে। শহীদ মিনার আমাদের চাই। ঢাকার ডিসিকে প্রিন্সিপাল খবর দিলেন। আমাকে হুমকি দিলেন অ্যারেস্ট করবার। আব্বা তখন জেলে, নাজিমুদ্দিন রোড বকশীবাজার থেকে বেশি দূরে না। চার আনা রিকশা ভাড়া লাগে। কলেজ থেকে প্রায়ই যেতাম। আমাকে হুমকি দেয়া হলো গ্রেপ্তারের, বললাম, আপত্তি নেই। কারণ প্রায়ই তো যাচ্ছি’ (পৃষ্ঠা-১৪)। স্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি জন্য তিনি ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু যখন শহীদ মিনার তৈরি হয় তিনি তখন কলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রবেশ করেছেন। তাকে আর খবর দেয়া হয়নি। এ নিয়ে দুঃখ করে বলেছেন, ‘খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। আমি এত আন্দোলন করলাম, অথচ সেই শহীদ মিনার তৈরি হলো, আমাকে একবার জানাল না।’ (পৃষ্ঠা-১৬) এ বইয়ে ‘সংগ্রামে আন্দোলনে গৌরবগাথায়, ভালোবাসি মাতৃভাষা, হরতাল করব, হরতাল করব না, বিপন্ন গণতন্ত্র লাঞ্ছিত মানবতা এবং ভোট কারচুপি : বন্দি গণতন্ত্র অসহায় জনগণ’ প্রবন্ধগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। লেখাগুলো সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতির জীবন্ত-জ্বলন্ত ইতিহাস। ‘সহে না মানবতার অবমাননা’ (২০০৩) বইটিতে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অত্যাচার-নৃশংসতার ভয়াবহ ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। এ জাতির দুর্ভাগ্য যে এ দেশের মানুষ সব ভুলে যায়। কিন্তু কিছু ইতিহাস আছে যা ভুললে আমাদের চলবে না। তাহলে জাতি আবার নিপতিত হবে অন্ধকার গুহায়। অপারেশন ক্লিনহার্টের নামে বিএনপি-জামায়াত সরকার দেশব্যাপী যে রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল আমরা যেন ভুলে না যাই সে জন্য শেখ হাসিনা ‘দায়মুক্তির অধ্যাদেশ’ নামে এক লেখায় তার বিবরণ রেখে দিয়েছেন। প্রতিটা নিহত মানুষের নামধাম, বয়স, পরিচয়, বিবরণ সেখানে আছে। এ বইটি মানবতার অবমাননার এক নিষ্ঠুরতম ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে। সবুজ মাঠ পেরিয়ে ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ শেখ হাসিনার একটি অনন্য সুন্দর সৃষ্টি। তাই ভাবলাম বইটি নিয়ে আলাদা করে লিখি। এ বইটিতে শেখ হাসিনার সাহিত্য প্রতিভার সবটুকু নির্যাস অনুভব করা যায়। বইটির সুন্দর প্রচ্ছদ এঁকেছেন খ্যাতিমান শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। বইটি তিনি লিখতে শুরু করেন ২০০৮ সালে বিশেষ কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায়। তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার মিথ্যা মামলা দিয়ে তাঁকে কারাবন্দি করে রেখেছিল সংসদ ভবনের পাশে এক বাড়িতে। দুতলার যে ঘরে তিনি থাকতেন সেখান থেকে গণভনের পাশে বিশাল এক সবুজ মাঠ দেখা যেত। ওই সবুজ মাঠ পেরিয়েই গণভবন। ওই সবুজ মাঠের ওপারে গণভবনের দিকে তাকিয়ে তিনি ভাবতেন এক সময় ওই বাড়িতে তার পিতা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি নিজেও ওই বাড়িতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ছিলেন। আর আজ তিনি কারাগারে! সবুজ মাঠ পেরিয়ে লেখার বাকি অংশ অবশ্য তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে গণভবনে গিয়েই শেষ করেছেন, ২০১০ সালের ৬ মার্চ। লিখেছেন, ‘আল্লাহ সবই পারেন। গণভবনের মাঠ, তারপর রাস্তা, পাশে লেক, তারপর বিশাল খেলার মাঠ। ওই মাঠের পাশেই বাড়িটায় বন্দি ছিলাম। আর এখন সেই সবুজ মাঠ পেরিয়ে যে গণভবন সেখানে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উঠেছি’। (পৃষ্ঠা ৪৭) সাহিত্যমানসের জন্য প্রয়োজন কল্পনাশক্তি। সে কল্পনাশক্তি শেখ হাসিনার কীরকম তা ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’-এর প্রতিটা লেখাতেই প্রমাণ পাওয়া যাবে। সবুজ মাঠ পেরিয়ে-এর লেখক অনেক পরিণত। বাক্যের ধরন অনেক বদলে গেছে। বেশ শক্ত ও ঋজু। এর মধ্যে লেখকের অভিজ্ঞতাও বেড়েছে। জীবন ও সমাজদর্শনের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে গেছে। এখন তিনি আরো বেশি পরিপক্ব। এ বইয়ের একটা লেখা উল্লেখ না করে পারছি না। লেখাটি হলো : ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কিছু সময়। বুক ভেঙে যাওয়ার মতো একটি লেখা। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বহু বছর বন্দি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫২ সাল একটানা প্রায় তিন বছর জেলে কেটেছে তাঁর জীবন। তার পরও ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৬, ১৯৭১- বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। যে বয়সে বাবার হাত ধরে ছোট্ট শেখ হাসিনার স্কুলে যাবার কথা সে বয়সে মায়ের হাত ধরে দিনের পর দিন গেছেন বাবাকে দেখতে জেলখানায়। ১৯৫৪ সাল থেকে তারা ঢাকায় বসবাস করতে শুরু করেন, তখন থেকেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার যাবার পুরনো ঢাকার এই রাস্তায় তাদের যাতায়াত। এক সময় মায়ের সাথে ছোট ভাইবোনদের নিয়ে এ কারাগারে আসতেন বাবাকে দেখতেন। আজ এসেছেন তিনি একা! রেহানাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কী কারণে রেহানাকে ছাড়াই আসতে হলো। তাই মনটা আরো বেশি খারাপ তার। বাবা যেখানে বসতেন, হাঁটতেন সে জায়গাগুলো একা একা ঘুরে দেখছেন। এক সময় কামাল-জামাল, রাসেল আসতো সাথে। রাসেল কিছুতেই বাবাকে ছেড়ে যেতে চাইত না। চোখের পানি দিয়ে তিনি লিখছেন, ‘যখনই জেলখানায় গিয়েছি আব্বার সাথে দেখা করতে, তখনই ফেরার সময় কষ্ট যেন বেড়ে যেত। তখন জামাল ছোট ছিল, আব্বাকে ছেড়ে কিছুতেই আসতে চাইত না। এরপর রেহানা যখন আসত, একই অবস্থা হতো, কিছুতেই আসতে চাইত না। আমি ও কামাল বড় ছিলাম বলে কষ্টটা বাইরে ছোটদের মতো প্রকাশ করতে পারতাম না। সবার বাবা বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যায়, দোকানে নিয়ে যায়, গল্প করে, খেলা করে আর আমরা শুধুই বঞ্চিত হয়েছি বাবার স্নেহ আদর ভালোবাসার সান্নিধ্য থেকে। ছোট্ট রাসেল জেলখানায় গেলে কিছুতেই আব্বাকে ফেলে বাসায় আসবে না। আব্বাকে সাথে নিয়ে বাসায় যাবে। আব্বা তাকে বোঝাতেন যে, এটা আমার বাসা, আমি থাকি। তুমি মা’র সাথে তোমার বাসায় যাও। কিন্তু ছোট্ট রাসেল কী তা শুনত, জিদ ধরত, কান্নাকাটি করত। বাসায় এসে বারবার মাকে জিজ্ঞেস করত, আব্বা কোথায়? মা বলতেন, এই তো আমি তোমার আব্বা। আমাকে তুমি আব্বা বলে ডাকো।’ (ঐ, পৃষ্ঠা-১৩) শেখ মুজিব আমার পিতা শেখ হাসিনার ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে কলকাতা বইমেলায়। সেবার কলকাতার বইমেলা উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কলকাতার প্রকাশনা সংস্থা ‘সাহিত্য প্রকাশনালয়’ মেলায় বইটি প্রকাশ করে। আগামী প্রকাশনী থেকে শেখ হাসিনার এই বই বাংলাদেশ সংস্করণ প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অমর একুশের বইমেলায়। সর্বশেষ সংস্করণ হয় ২০১৭ সালের বইমেলায়। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। বইটিতে একটি দীর্ঘ প্রস্তাবনা লিখেছেন কলকাতার প্রখ্যাত লেখক, দার্শনিক ও পদার্থবিজ্ঞানী পার্থ ঘোষ। পার্থ ঘোষের প্রস্তাবনাটিই আলাদা করে স্মরণযোগ্য। পুরো প্রস্তাবনাটিই এখানে তুলে দিতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু স্থানাভাবে শুধু একটা ছোট মন্তব্যই তুলে দিচ্ছি : ‘প্রস্তাবনা দীর্ঘ মনে হতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, এরও প্রয়োজন আছে। শেখ হাসিনার এই প্রবন্ধগুলো পড়ার সময় তাঁর জীবন ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে ভুলে গেলে চলবে না। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছি, বাংলাদেশের মানুষ পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকদের লেখালেখি সম্পর্কে যতখানি ওয়াকিবহাল, পশ্চিমবঙ্গের পাঠক বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে ততখানিই নিস্পৃহ। শেখ হাসিনার প্রবন্ধ সংকলনের প্রস্তাবনা হিসেবে তাই এই দীর্ঘ উপস্থাপনার প্রয়োজন হয়ে পড়ল।’ বইটিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখা নিশ্চিতভাবেই : ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’। এ বইটি পড়ে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অনেক অজানা কিছু কথা জানা যায়। রূপকথার গল্পের মতো শেখ হাসিনা তার দাদির মুখে শোনা বাবার গল্প বলেছেন। ‘দাদির কাছে গল্প শুনেছি, যখন ছুটির সময় হতো তখন দাদি আমগাছের নিচে এসে দাঁড়াতেন। খোকা আসবে দূর থেকে রাস্তার উপর নজর রাখতেন। একদিন দেখেন তার খোকা গায়ের চাদর জড়িয়ে হেঁটে আসছে, পরনের পায়জামা-পাঞ্জাবি নেই। কি ব্যাপার? এক গরিব ছেলেকে তার শত ছিন্ন কাপড় দেখে সব দিয়ে এসেছেন।’ (পৃষ্ঠা-২৮) সুফিয়া কামাল ও জাহানারা ইমাম শেখ হাসিনার জীবনের উল্লেখযোগ্য একটি দিক তিনি কবি সুফিয়া কামাল এবং শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। যা তাঁর রাজনৈতিক জীবন তো বটেই, লেখালেখির জীবনকেও সমৃদ্ধ করেছে। এ দুজনকে নিয়েই তিনি অসামান্য দুটি স্মৃতিকথা লিখেছেন। ‘কবি সুফিয়া কামাল : মায়ের প্রতিকৃতি’ লেখায় শেখ হাসিনা লিখেন, ‘কবি সুফিয়া কামাল এই নামটির সাথে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার মুসলিম নারীজাগরণের ইতিহাস। যে কয়েকজন সাহসী নারী বাংলার নারীসমাজকে আত্মপ্রত্যয়ের চেতনায় জাগ্রত করেছেন তিনি তাঁদের মধ্যে অনত্যম।’ (সবুজ মাঠ পেরিয়ে, মাওলা ব্রাদার্স, পৃষ্ঠা-৬১) সময় পেলেই শেখ হাসিনা তাঁর কাছে গিয়ে বসে থাকতেন। ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর মহীয়সী নারী আমাদের ছেড়ে চলে যান। ২০১০ সালের ১০ নভেম্বর তাঁর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে শেখ হাসিনা ফেলেন কয়েক ফোঁটা অশ্রু। এমন আরো কয়েক ফোঁটা অশ্রু ফেলেছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে। ১৯৯৪ সালের ২৫ জানুয়ারি তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান, তার ঠিক ছ’মাস পরেই তাঁকে নিয়ে এক বেদনাবিদুর স্মৃতিচারণা লিখেন শেখ হাসিনা। ‘আমাদের চেতনার অগ্নিশিখা’ শিরোনামে লেখাটি প্রথম গ্রন্থভুক্ত হয় দারিদ্র্য দূরীকরণ : কিছু চিন্তাভাবনা বইয়ে, ১৯৯৫ সালে। পরবর্তীতে ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইয়ে ‘বেগম জাহানারা ইমাম’ শিরোনামে লেখাটি নতুন করে সংযুক্ত হয়। জাহানারা ইমামের সঙ্গে শেখ হাসিনা একটা আত্মার বন্ধন অনুভ করতেন। শেষ হয়েও হইল না শেষ খুব ভালো লাগত আমি যদি অন্তত বিশ হাজার শব্দে শেখ হাসিনাকে নিয়ে একটা লেখা লিখতে পারতাম। দু-তিন হাজার শব্দে তাঁকে ধারণ করা সম্ভব নয়। তাই এই লেখায় অনেক কিছুই বাদ গেল। তাঁকে নিয়ে অন্যান্য কবি-সাহিত্যিকদের মন্তব্য কিছুই তুলে ধরা গেল না। তবে প্রতীকী হিসেবে পশ্চিবাংলার প্রবীণ সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাসের কিছু কথা উল্লেখ করতে চাই, ‘হাসিনা বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্য নিয়ে যে কতটা আগ্রহী তা তাঁর সঙ্গে কথা না বলে বোঝা যাবে না। এপার বাংলা থেকে কোনো ভালো লেখা প্রকাশ হলেই তিনি তা পড়ে ফেলেন। এ কথা আমার শোনা সমরেশ মজুমদারের কাছ থেকে।’ (শেখ হাসিনাকে যেমন দেখেছি, আপনজন, সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত, পৃষ্ঠা-৩৪) তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ, তাঁকে নিয়ে রচিত গ্রন্থগুলো নিয়ে কিছু বলতে পারলাম না। নিশ্চয়ই আমি তাঁকে নিয়ে একদিন আরো বিস্তৃত করে কিছু লিখব। লিখব তাঁর সাথে আমার আলাপের বিষয়। লিখব টুকরো টুকরো সব স্মৃতিকথা। আমি চাই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ তরুণ প্রজন্ম তাঁর লেখা পাঠ করুক। তাহলেই তারা জানতে পারবে বাংলার প্রকৃত ইতিহাস। গণতন্ত্র সমুন্নত করতেই তিনি লিখেছেন, ‘তাঁর বেশির ভাগ লেখার বিষয়ই তাই। তিনি আমাদের জাতির ইতিহাসের সেতুবন্ধন। রচনাসমগ্র-১-এর ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, আমার লেখা এই দেশের মানুষকে ঘিরে, মানুষের কথা বলতে চাই।’ মানুষের জন্যই তাঁর জীবন উৎসর্গকৃত, যেমনটি ছিল তাঁর পিতার। বঙ্গবন্ধুর অসামপ্ত কাজগুলো তিনি সমাপ্ত করে যাচ্ছেন। প্রার্থনা করি তিনি আরো দীর্ঘজীবী হোন। এখনো অনেক কাজ বাকি। তবে শেষবেলায় আমি বলবো, লেখালেখির পেছনে তিনি আরেকটু সময় দিলে জাতি উপকৃত হতো। বিশেষ করে তাঁর আত্মজীবনীটি লিখে যাওয়া উচিত। বঙ্গবন্ধু যদি আত্মজীবনী না লিখে যেতেন তাহলে সে সময়ের অতি দরকারি কিছু ইতিহাস আমরা কোত্থেকে জানতাম! ইতিহাসের সেই পরম্পরার অংশ হিসেবেই তিনি নিশ্চয়ই নিজের জীবনের দুঃখ, আনন্দ, সংগ্রাম ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের নানা কথা নতুন প্রজন্মের জন্য লিখে যাবেন। সেই প্রত্যাশা নিয়েই শেষ করছি আজ। শুভ জন্মদিন, বঙ্গবন্ধুকন্যা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App