×

শিক্ষা

৯ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি শিক্ষা আইন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০১:২৪ এএম

৯ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি শিক্ষা আইন
৯ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি শিক্ষা আইন
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদে যাওয়া-আসা আর রিভিউ করার মধ্য দিয়ে ২০১১ থেকে ২০১৯- এই ৯টি বছর পার করেছে শিক্ষা আইনের খসড়া। এর মধ্যে তিন দফা মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে আইনটি আলোচনায় এলেও সেখান থেকে ‘পত্রপাঠ’ ফেরত আসে সেটি। এরকম পরিস্থিতিতে আজ বুধবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এসইডিপি প্রকল্পের সভাকক্ষে এখন আবার নতুন করে আইনকে রিভিউ করার জন্য সভা ডাকা হয়েছে। জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খালেদা আক্তার ভোরের কাগজকে বলেন, রিভিউয়ের বিষয়ে পরামর্শ দিতে দুজন পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারা খসড়া পরিবর্তনের বিষয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনা অংশীজনদের সামনে তুলে ধরবেন। পরে সেটি মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে পাঠানো হবে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়। টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কাজটি চলছে ধীরগতিতে। সর্বশেষ খসড়ায় কোচিং, প্রাইভেট ও সব ধরনের নোট-গাইড, অনুশীলন বা সহায়ক বই নিষিদ্ধ করা হয়। তখন কোচিং, গাইড ও প্রাইভেট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত একটি গোষ্ঠী আইনটি ঠেকাতে তৎপরতা শুরু করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বর্তমান নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ সব ধরনের কোচিং-প্রাইভেট বন্ধের বিপক্ষে। কিন্তু নোট গাইড ও কোচিং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রফা না হওয়ার কারণেই যেন দফায় দফায় ঘষামাজা করা হচ্ছে খসড়াটি। শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার মধ্যেই শিক্ষা আইনের এ সংকটে উদ্বিগ্ন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্যসহ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা। দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ, শিক্ষক-অভিভাবক ও শিক্ষা প্রশাসনের প্রায় সর্বস্তরের কর্মকর্তাই নিষিদ্ধ নোট-গাইড ও কোচিং বাণিজ্যের লাগাম টেনে ধরতে চান, চান অবৈধ শিক্ষা বাণিজ্য স্থায়ী বন্ধ করতে। প্রথম খসড়ায় নোট-গাইড নিষিদ্ধ ও কোচিং বাণিজ্য বন্ধের ‘বিধি-বিধান’ থাকায় প্রত্যাশিত আইন বাধার মুখে পড়েছে অভিযোগ করে শিক্ষাবিদরা বলছেন, আইন ঠেকাতে নোট-গাইড ব্যবসায়ী ও কোচিং বাণিজ্যে জড়িত সিন্ডিকেট একজোট হয়ে কাজ করছে। এই চক্র যে কোনো মূল্যে প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন থেকে নিজেদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ধারা-উপধারাগুলো বাদ রাখতে চায়। কিছু আমলাও বছরের পর বছর ধরে এদের হয়ে কাজ করেছেন। জাতীয় শিক্ষানীতি ’১০ এ নীতি বাস্তবায়নের জন্যই ‘শিক্ষা আইন’ প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে এই আইনের মাধ্যমে নোট-গাইড বই ও কোচিং সেন্টারসহ সব ধরনের অবৈধ শিক্ষা বাণিজ্য বন্ধের কথা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিদ্যমান আইন-কানুন ও বিধি-বিধানের সঙ্গে সমন্বয় করে খসড়া আইনটি চূড়ান্ত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি দু’জন কনসালটেন্টকে (পরামর্শক) (সাবেক অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমেদ ও সাবেক সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল) নিয়োগ দিয়েছে। ২০১০ সালে শিক্ষানীতি প্রণয়নের পর ২০১১ সালে শিক্ষা আইন নিয়ে কাজ শুরু করে মন্ত্রণালয়। শিক্ষা আইনের প্রথম খসড়া তৈরি করা হয় ২০১২ সালে। পরে নানা বিষয় সংযোজন-বিয়োজন করে জনমত যাচাইয়ের জন্য ২০১৩ সালে খসড়া প্রকাশ করা হয় মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে। এরপর তা মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হলে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ দিয়ে তা ফেরত পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় এ পর্যন্ত তিনবার খসড়া অদল বদল করেছে। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে শুরু হয় নোট-গাইড ব্যবসায়ীদের তদ্বির, দেয়া হয় আন্দোলনের হুমকি। কোচিং ব্যবসায়ীরাও সক্রিয় হয়। শিক্ষা আইনকে দুর্বল করে অবাধ বাণিজ্য করার আশায় প্রতিবাদ কর্মসূচিও চালিয়ে যেতে থাকে। তবে শিক্ষা আইনের খসড়া প্রণয়নের ৯ বছরের মাথায় এসে হঠাৎ কনসালটেন্ট নিয়োগ দিয়ে পরামর্শ নেয়ার ঘটনা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। জানা গেছে, নোট-গাইড ও কোচিং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আঁতাত করে শিক্ষা প্রশাসনের একটি চক্র নতুন নতুন অজুহাত তৈরি করে শিক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়া সব সময়ই বাধাগ্রস্ত করছে। নানা রকম গোঁজামিল দিয়ে উদ্দেশ্যপূর্ণ খসড়া তৈরি করছেন। এতে বারবার আইনের খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, আইন মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন অংশীজনের কাছে শুধু হাতবদলই হয়েছে ফল হয়েছে শূন্য। গোঁজামিল দিয়ে খসড়া তৈরির কারণে সর্বশেষ ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হলে ক্ষোভ প্রকাশ করে আবার মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়। শিক্ষা আইনের খসড়ায় ব্যাপক অসামঞ্জস্য, বৈপরিত্যও বিদ্যমান বিভিন্ন আইনের সঙ্গে অসঙ্গতি থাকায় আবারো এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ফেরত পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ফলে গত সরকারের আমলে শিক্ষা আইন আলোর মুখই আর দেখেনি। শিক্ষা আইনের খসড়া অনুযায়ী, কোনো ধরনের নোট বা গাইড বই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ ও বাজারজাত করা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। নোট-গাইড ক্রয় বা পাঠে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বাধ্য করলে বা উৎসাহ দিলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, প্রতিষ্ঠান প্রধান বা ব্যবস্থাপনা কমিটির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিধান লঙ্ঘনে অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা এক বছর কারাদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। নোট-গাইড ব্যবসায়ীরা আইনের ওই জায়গায় আপত্তি জানিয়ে বলেছে, শিক্ষা আইনে নোট-গাইডের অংশটিই থাকতে পারবে না। তারা নোট-গাইডকে সহায়ক বই হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছে, এটি ছাড়া কেউ পড়াশুনা করতে পারে না এবং এই বইটি বাবা-মা কিনে দেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই বই কিনতে কাউকে বাধ্য করা হয় না। অভিভাবক তার সন্তানদের ভালো ফলাফলের জন্য নিজ দায়িত্বে কিনে দিচ্ছেন। আর নোট-গাইডের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী বছর থেকে এসব বইয়ের দাম কমাচ্ছে নোট-গাইড ব্যবসায়ীরা। ফলে নোট-গাইড অংশ বাদ শিক্ষা আইন চূড়ান্ত করার দাবি তাদের। কিন্তু শিক্ষাবিদরা এই দাবিকে বলছেন, ‘মামাবাড়ির আবদার’। আর শিক্ষা প্রশাসনের কেউ কেউ নোট-গাইড ব্যবসায়ীদের দাবির পক্ষে। ফলে দীর্ঘসূত্রতার কবল থেকে বের হতে পারছে না শিক্ষা আইন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App