×

মুক্তচিন্তা

দেশের আকাশ পেরিয়ে বিস্তৃত যে শারদীয়া

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৮:৩৯ পিএম

দেশের বাইরে যে বাঙালি, যে বাংলা সমাজ তার ভেতরও আজ নানাবিধ অসুরের আগমন। উৎসবের আমেজ যত বাড়বে, যত ব্যাপ্ত হবে আনন্দের সীমানায় তত আমরা হবো ভয়মুক্ত। আমাদের মেধা ও শ্রমের তুলনা হয় না। শুধু চাই সুস্থির সময়। সে সময় যদি আনন্দ আর ভালোবাসার না হয় তো দুঃখ-বেদনা পিছু ছাড়বে না। দেশের বাইরে বাংলাদেশের উৎসবের জগৎ বড় করে তোলা শারদীয় উৎসব ও ঈদ এখনো আমাদের মিলন ও বন্ধনের যোগসূত্র।

পূজা বিশেষত দুর্গাপূজা কেবল হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব হলেও তার আমেজ বাঙালির। যে কারণে নাম বদলে এর নাম হয়ে গেছে শারদীয় উৎসব। শরৎকালে দুর্গাকে অকাল বোধনে ডেকে এনেছিলেন। রাবণ বধের জন্য তার এই আগমনের কত কাহিনী। কতভাবে তা প্রভাবিত করেছে বাঙালির জীবন। বাংলাদেশে সুরথ রাজার মূল দুর্গাপূজা হয়ে গেছে বাসন্তী পূজা। রাজরাজড়ার পূজা মানুষের পূজায় নেমে এলো। আজকাল কেউ বিশ্বাস করবে না একদা এই পূজায় অধিকার ছিল না সাধারণ মানুষের। তারা ছিল কেবল দর্শক। বারোয়াড়ি পূজা বলতে যা বোঝায় তার ইতিহাসও চমৎকার। ওপার বাংলার বারো ইয়ার মানে বারোজন বন্ধুর অপার উৎসাহে যে পূজার শুরু তার নামেই চালু হয়ে গেল বারোয়াড়ি তথা সর্বজনীন শারদ উৎসব। বাংলাদেশ ও উভয় বাংলার সীমানা পেরিয়ে এই উৎসব এখন এমন এক রূপ ধারণ করেছে যার সঙ্গে আর কিছুর তুলনা চলে না। আমাদের শিল্প সাহিত্যের জগতে এই উৎসবের প্রভাব কতটা ব্যাপক সেটা বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না। পূজা সংখ্যার লেখকরা আমাদের অন্দর মহলে ঢুকেছিলেন বলেই বাংলা সাহিত্যে গল্প-উপন্যাসের জনপ্রিয়তা পেয়েছিল আকাশ সমান প্রিয়তা। সে জগতের হাত ধরে আমাদের হাত ধরে নিভে যাওয়ার লেখকদের অনেকেই আজ আকাশের তারা। তারা নেই বটে, রয়ে গেছে অসামান্য সব কথাসাহিত্য। এখনো পূজা সংখ্যা মানে আনন্দের এক বিশাল উপকরণ। যেসব গান আমাদের ভুবন রাঙিয়ে দিয়ে গেছে, যে রংয়ে বাংলার সুরের আকাশ এখনো রঙিন তার অনেকটাই দুর্গাপূজার আনন্দ আর উৎসবে রচিত ও গীত। যে ধারা এখন বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে সপ্ত সিন্ধু দশ দিগন্তে প্রবহমান। বাংলাদেশের পূজার জগৎ কতটা বর্ণিল সেটা সমাজের দিকে তাকালেই বোঝা সম্ভব। প্রতিকূলতার রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে পূজা আজ এমন আকার ধারণ করেছে যেখানে মানুষের পরিচয় একটাই সে মানুষ। আর দেশপ্রিয় সে স্লোগান ধর্ম যার যার উৎসব সবার প্রমাণে এই উৎসব রাখছে ব্যাপক প্রভাব। যে কারণে আজ বাংলাদেশের বাইরেও এর বিস্তৃতি অসাধারণ ও অপ্রতিরোধ্য। আমি যখন সিডনি আসি তখন মিটমিট করে জ্বলা দু-চারটে পূজায় আমরা গুটিকয় বাঙালি একত্রিত হতাম। বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা প্রজ্ঞা, মেধা, মননের পাশপাশি রাজনীতি বা কলহও রেখে আসিনি আমরা। যে কারণেই হোক একত্রিত বাঙালি সবাই মিলে একটা পূজা করবে এমনটা যেমন ভাবা যায় না, তেমনি অমন একটা পূজায় দুর্গাকে ধরে রাখাও অসম্ভব। বাড়তে বাড়তে এখন এসে ঠেকেছে তেরো-চৌদ্দটা পূজায়। সবগুলোতে উপচেপড়া মানুষের ভিড়। এক সময় মনে হতো আমাদের প্রজন্ম বা দুয়েক প্রজন্মের পর কি পূজার এ ধারা অব্যাহত থাকবে? কারা ধরবে হাল, কাদের ওপর নির্ভর করব আমরা? কি আশ্চর্য! যেসব তরুণ ছেঁড়া জিন্স পরে কানে হেডফোন লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতো, যাদের বাংলা উচ্চারণ শুনে বোঝা যাবে না তারা কি অজি, না বাংলাদেশি, না বাঙালি সে তারাই আজ পুরোভাগে। নানা পূজায় তাদের নেতৃত্ব আর কর্মমুখরতা এখন আমাদের প্রেরণা। তারা বুঝিয়ে দিয়েছে সংস্কৃতি বা আচার কিংবা বিশ্বাস থাকে রক্তে। একদিন না একদিন তা বেরিয়ে আসবেই। লন্ডন কিংবা আমেরিকার শহরগুলোর কথা বলাই বাহুল্য। সেখানে আপনি পূজা দেখবেন বা প্রসাদও পাবেন। কিন্তু খাবার পেতে হলে আপনাকে টিকেট কাটতে হবে। টিকেট কাটা ছাড়া আপনি খাবার পাবেন এমন প্রত্যাশা না করাই উত্তম এবং এর কারণ কি অপ্রতুলতা না কৃপণতা? কোনোটাই না। মানুষের ভিড়ে গমগম করা পূজার উৎসব কীভাবে সামাল দেবেন আয়োজকরা? ডলার-পাউন্ড থাকলেও জনবল নেই সামলানোর। এমন অবস্থা যে অজিরাই সিডনিকে গ্রাস করবে এটা ভাবা অন্যায় মনে করি না। ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের পূজায় সে প্রথা চালু হয়ে গেছে। দাদারা এসব দিকে পাইওনিয়ারও বটে। ধারণা করি একেবারে বাধ্য না হলে বাংলাদেশি পূজায় কোনোদিনও খাবার কিনে খাওয়ার প্রচলন দেখবো না। বলছিলাম দেশের বাইরের পূজার অনুষঙ্গের কথা। এখন সব পূজায় সংকলন প্রকাশ নিয়মিত ব্যাপার। দিন দিন এগুলোর মান বাড়ছে। যোগ হচ্ছে নতুন লেখকের দল। কি যে ভালো লাগে। দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বাঙালির নতুন প্রজন্ম লিখছে আমাদের পূর্বাধিকার, আমাদের অতীত আর ইতিহাস বিষয়ে। পূজার মন্ত্র স্তোত্র কিংবা নিয়ম পেরিয়ে বড় হয়ে ওঠা সংস্কৃতি যে আলো জ্বালিয়ে রেখেছে তার আলোকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এগিয়ে গেলে অন্ধকার কূপমণ্ডূকতা আর সংকীর্ণতা পালানোর পথ পাবে না একদিন। দেশে নানাবিধ সমস্যার কথা চাইলেই চোখ বুজে এড়ানো যাবে না। একদিকে যেমন উন্নয়ন আর অগ্রগতি আরেকদিকে চলছে ষড়যন্ত্র। যে ষড়যন্ত্র আমাদের সমাজকে ধর্মের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে উত্তেজিত করে তার বিরুদ্ধে আনন্দের জাগরণ জরুরি। সে জাগরণ সমাজ কীভাবে পাবে? এখন তো অনেক কিছুই বলা, করা এমনকি ভাবাও নিষেধ। এককালে যে সংস্কৃতি আমাদের পথ দেখাতো তাও ক্লীশ। এমন এক আবহে শারদীয় উৎসবের আনন্দে অবগাহন স্বস্তির বৈকি। এখনো সাধারণ মানুষের মনে যে আবেগ, যে ভালোবাসা তাতে দাগ বসাতে পারেনি অসুরের দল। এই অসুর মহিষাসুরের চাইতেও ভয়ঙ্কর। এ অসুর যৌবনকে বিভ্রান্ত করে। জঙ্গি করে। তারুণ্যকে করে উন্মাদনার নির্মম শিকার। শারদ উৎসব সেসব কুয়াশা সরিয়ে দিতে যথেষ্ট কিনা জানি না, তবে তার ভেতর আছে জাগরণ ও মুক্তির দিশা। দেশের বাইরে যে বাঙালি, যে বাংলা সমাজ তার ভেতরও আজ নানাবিধ অসুরের আগমন। উৎসবের আমেজ যত বাড়বে, যত ব্যাপ্ত হবে আনন্দের সীমানায় তত আমরা হবো ভয়মুক্ত। আমাদের মেধা ও শ্রমের তুলনা হয় না। শুধু চাই সুস্থির সময়। সে সময় যদি আনন্দ আর ভালোবাসার না হয় তো দুঃখ-বেদনা পিছু ছাড়বে না। দেশের বাইরে বাংলাদেশের উৎসবের জগৎ বড় করে তোলা শারদীয় উৎসব ও ঈদ এখনো আমাদের মিলন ও বন্ধনের যোগসূত্র। সমাজে সংসারে বিদ্যা সচ্ছলতা সাহস ও স্বীকৃতির পাশাপাশি সৃজনের সব দেবদেবীকে প্রতীক করে সঙ্গে নিয়ে আসা দুর্গা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যত বড় হবে ততই মঙ্গল। শুভ শারদীয়া।

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App