×

জাতীয়

জুয়ার জৌলুসে হতবাক দেশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১০:৪৩ এএম

জুয়ার জৌলুসে হতবাক দেশ
জুয়ার জৌলুসে হতবাক দেশ
জুয়ার জৌলুসে হতবাক দেশ
বিভিন্ন ক্লাবের আড়ালে অবৈধ জুয়া ও ক্যাসিনোর রমরমা ব্যবসা দেখে হতবাক রাজধানীসহ পুরো দেশবাসী। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নাকের ডগাতেই ক্লাবগুলো চালিয়ে আসছিল অবৈধ এসব কর্মকাণ্ড। বিদেশ থেকে আমদানি করা দামি ইলেক্ট্রিক মেশিন ও বোর্ডে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার জুয়ার আসর চালাতো ক্লাবগুলো। ভিভিআইপি কক্ষ, পানাহার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে প্রার্থনার স্থান কী নেই এসব ক্যাসিনোতে। ১-৫ হাজার টাকা দিয়ে সাধারণ বোর্ড শুরু হলেও ভিভিআইপি কক্ষে খেলাই শুরু হতো ১ লাখ টাকার টোকেন কয়েন দিয়ে। হেরে গেলে ১ শতাংশ হারে দেয়া হতো যাতায়াত বিল। র‌্যাবের অভিযানের পর রাজধানীর মতিঝিল থানা এলাকার আরামবাগ, দিলকুশা, মোহামেডান ও ভিক্টোরিয়া ক্লাবে গতকাল রবিবার পুলিশি অভিযানে দেখা মিলেছে এমন দৃশ্যের। তবে এসব অভিযানে কাউকে আটক করা যায়নি। ক্লাবগুলোর সঙ্গে কারা সংশ্লিষ্ট সে বিষয়ে কিছু জানাতেও পারেনি পুলিশ। অভিযান শেষে চারটি ক্লাবেই ঝোলানো হয়েছে তালা। এদিকে গুলশান-বনানী এলাকার ক্লাবগুলোর মধ্যে কয়েকটি বন্ধ থাকলেও অভিজাত হিসেবে পরিচিত ক্লাবগুলো চলছে আগের মতোই। যদিও থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে ধানমন্ডি এলাকার ক্লাবগুলোতে। রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) দুপুর আড়াইটা থেকে বন্ধ থাকা আরামবাগ, দিলকুশা, মোহামেডান ও ভিক্টোরিয়া ক্লাবে অভিযান চালায় ডিএমপি মতিঝিল অঞ্চলের পুলিশ। সে সময় আরামবাগ, দিলকুশা ক্লাবের অভিযানের নেতৃত্ব দেন অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার শিবলী নোমান। তিনি ভোরের কাগজকে জানান, আরামবাগ ক্লাবে গিয়ে দেখা যায় সেখানে আগে থেকেই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। তবে সেখানে যে ক্যাসিনো চলে তা বোঝা যাচ্ছিল। এখানকার দুই ক্লাব থেকেই মিলেছে ক্যাসিনো ও জুয়া খেলার প্রচুর সরঞ্জাম। তবে কাউকে আটক করা যায়নি। অন্যদিকে রাজধানীর ভিক্টোরিয়া ক্লাবে অভিযান চালিয়ে নগদ ১ লাখ টাকা, মদ, বিয়ার, জুয়া ও ক্যাসিনোর সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে পুলিশ। মতিঝিল অঞ্চলের উপপুলিশ কমিশনার আনোয়ার হোসেন জানান, ক্লাবের ভেতরের পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে এখানেও নিয়মিত ক্যাসিনো চালানো হতো। এদিকে পুলিশের নাকের ডগায় এসব ক্যাসিনো কীভাবে এতদিন ধরে চলছিল, সেই প্রশ্ন উঠেছে সর্বমহলে। সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের কাছে খবর আসা মাত্রই অভিযানে এসেছি। কতদিন ধরে চলছে, কারা এর সঙ্গে জড়িত এসব বিষয় তদন্ত করে দেখা হবে। ক্যাসিনো পরিচালনা করা অবৈধ। এখান থেকে যাদের নাম আসবে, তারা যত প্রভাবশালীই হোক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। রোববার অভিযানের সময় সরজমিনে ভিক্টোরিয়া ক্লাবে ঢুকে দেখা যায়, সুন্দরী তরুণীরা তাস বিছিয়ে দিচ্ছেন, টেবিলের ওপর স্তরে-স্তরে সাজানো ক্যাসিনোর কয়েন, তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন সুন্দরী নারীরা। সমুদ্রতীরে উল্লাস করছেন স্বল্পবসনধারী মেয়েরা, এমন অসংখ্য বড়-বড় পোস্টার দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে মতিঝিলের ভিক্টোরিয়া ক্লাব। জুয়ার স্বর্গরাজ্য লাস ভেগাসের আদলেই সাজানো হয়েছে ক্লাবটি। মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে টেবিলের ওপর অসংখ্য বান্ডিলে থরে থরে সাজানো বিদেশি কাগজ-প্লাস্টিকের দামি তাস। এর মধ্যেই শোভা পাচ্ছে একটি মদের বোতল। পাশের একটি টেবিলে সাজানো ক্যাসিনোর বিভিন্ন মুদ্রামানের হাজার হাজার কয়েন। ভেতরের প্রতিটি দেয়ালে ঝুলছে জুয়ার সামগ্রীর সঙ্গে স্বল্পবসনা সুন্দরী নারীদের ছবি। একেবারে পশ্চিম দিকে রয়েছে ক্যাশ কাউন্টার। তার পাশেই একটি বাথরুম। বাথরুমটির ‘এগজস্ট’ ফ্যান খুলে ফেলে রাখা রয়েছে। ক্লাবের একদিকে ভিআইপি কক্ষ, যেখানে লাখ টাকার জুয়া খেলা হতো প্রতিদিন। খাওয়ার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে কী নেই সেখানে! এ কক্ষ থেকেই কৃষ্ণা শ্রেষ্ঠা নামে এক নেপালি নাগরিকের ভিজিটিং কার্ড পাওয়া যায়। পরিচয় হিসেবে লেখা রয়েছে সহকারী ব্যবস্থাপক। কার্ডে তার দেশি ও নেপালি দুটি নাম্বারই দেয়া আছে। এ ছাড়াও ‘প্রবেশ নিষিদ্ধ’ একটি কক্ষে বিভিন্ন ধরনের দেব-দেবীর ছবিসহ পূজার একটি স্থান দেখা গেছে। পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে নেপালি কৃষ্ণাই ক্লাবটি পরিচালনা করতেন। প্রায় চার হাজার স্কয়ার ফুটের মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অভিযানে সেখানকার কর্মরত স্টাফ তালিকা ও কার্য বিবরণের রেজিস্টার পায় পুলিশ। যাচাইবাছাই করে দেখা যায়, ক্লাবে দুই শিফটে প্রায় ৫০ জন কর্মী কাজ করতেন, যাদের অধিকাংশই পার্বত্য অঞ্চলের। এ ছাড়া সেখানে চাকরিপ্রত্যাশীদের অসংখ্য বায়োডাটা পাওয়া গেছে। পুলিশের ধারণা, এ ক্লাবটিও নেপালি কিংবা অন্য দেশের নাগরিকদের দিয়ে তাদের ক্যাসিনো চালাতো। খরচ কমাতে ক্লাবটি পার্বত্য জেলার তরুণ-তরুণী ও উপজাতিদের নিয়োগ দিত। কাগজপত্র যাচাইবাছাই করে আরো দেখা যায়, মোহামেডানে কর্মরতদের অধিকাংশের বয়স ১৯-২৩। তাদের কেউ কেউ এইচএসসি পাস করেছে, কেউ আবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। পড়াশোনার পাশাপাশি ক্যাসিনোতে কাজ করছে তারা। ক্লাবে জুয়া পরিচালিত হতো সকাল ১০টা থেকে পরদিন ভোর ৫টা পর্যন্ত, মোট ১৯ ঘণ্টা। ক্লাব বন্ধ থাকত মাত্র ৫ ঘণ্টা। কর্মচারীরা দুই শিফটে ১০ ও ৯ ঘণ্টা করে কাজ করত। রাতের ডিউটিতে রাখা হতো মেয়েদের। এখানেও ক্যাসিনো খেলার জন্য রয়েছে ভিভিআইপি কক্ষ। এখানেও বোর্ড শুরু হতো ১ লাখ টাকা দিয়ে। খেলার শুরুতেই ২০% টাকা অগ্রিম দিতে হতো। হেরে গেলে বাড়ি ফেরার হাতখরচা দেয়া হতো মূল টাকার ১ শতাংশ। এ ছাড়া সেখানে পাওয়া গেছে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের লেখা ‘ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ঘটনাবহুল ইতিহাস’ বইটি। সেখানেও তালিকা পাওয়া গেছে ক্লাবে আসা নিয়মিত অতিথিদের। ক্লাবপাড়া ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আরামবাগ, দিলকুশা ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে এসব ক্যাসিনো ও জুয়ার আসর চালাতেন মূলত ৯নং ওয়ার্ড কমিশনার মমিনুল হক সাঈদ ও ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব চালাতেন যুবলীগ দক্ষিণ সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট। এ বিষয়ে মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার আনোয়ার হোসেন বলেন, সবই তদন্ত করে দেখা হবে। এদিকে বনানীর এফ-ব্লকের ১ নম্বর রোডে অবস্থিত বনানী ক্লাবের ৬ তলা ভবনের পুরোটাই রোববার রাতেও খোলা থাকতে দেখা গেছে। বনানী ক্লাবের সিকিউরিটি ইনচার্জ মো. মনিরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ক্লাবের সদস্য ছাড়া কেউই এখানে প্রবেশ করতে পারে না। ক্লাবটিতে সুইমিং পুল, রেস্টুরেন্ট ও জিমনেশিয়াম রয়েছে। তবে কোনো বার বা ক্যাসিনো নেই। এখানে কোনো ধরনের জুয়া খেলাও হয় না। অসামাজিক কোনো কার্যকলাপ এখানে হয় না বলে দাবি করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App