×

মুক্তচিন্তা

বাঙালির জাতিরাষ্ট্রের পিতা শেখ মুজিব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১০:২৭ পিএম

মার্চের ভাষা আন্দোলনে বাংলার জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও অংশগ্রহণ পাকিস্তানি শাসকদের ভীত করে তোলে। বঙ্গবন্ধুর জবানিতেই আমরা সামনে জানতে পারব বাংলা ভাষা আন্দোলন কোন পথ ধরে সামনে এগিয়ে যায়। আমরা এটিও অনুভব করব যে বাংলা ভাষার আন্দোলনই ছাত্রলীগের গণভিত্তি তৈরি করে এবং মুসলিম লীগের রাজনীতিকে বাংলায় শেকড়সহ উপড়ে ফেলা হয়।

পাঁচ ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংসদে ভাষার দাবি এবং মার্চে ভাষা দিবস পালন করার মধ্য দিয়ে আজকের বাংলাদেশ ভূখণ্ডটি একটি নতুন জাতিসত্তা গড়ে তোলার শুভ সূচনা করে। ১৯৪৭-এর পাক-ভারত বিভাজনের আগে রাজনৈতিক ইস্যুটি ছিল হিন্দু-মুসলমানের। পূর্ববঙ্গে হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার এবং এক শ্রেণির হিন্দুর জাতপ্রথা ও মুসলিম বিদ্বেষ এমন একটি অবস্থা তৈরি করেছিল যে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে অবিভক্ত ভারতে মুসলিমদের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। কিন্তু ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারিতেই পাকিস্তানিরা তাদের কুৎসিত চেহারা দেখাতে শুরু করে। ভাষা দিবসে জাতির পিতাসহ বাঙালি নেতারা গ্রেপ্তার হন। বঙ্গবন্ধু সেই সময়ের বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছেন, “তখন পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার অধিবেশন চলছিল। শোভাযাত্রা রোজই বের হচ্ছিল। নাজিমুদ্দীন সাহেব বেগতিক দেখলেন। আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে। ওয়াদুদ ও বখতিয়ার দুজনই ছাত্রলীগ কর্মী, তাদের ভীষণভাবে আহত করে জেল হাসপাতালে রাখা হয়েছে। এই সময় শেরে বাংলা, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, তোফাজ্জল আলী, ডা. মালেক, সবুর সাহেব, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন ও আরো অনেকে মুসলিম লীগ পার্টির বিরুদ্ধে ভীষণভাবে প্রতিবাদ করলেন। আবার শহীদ সাহেবের দল এক হয়ে গেছে। নাজিমুদ্দীন সাহেব ঘাবড়িয়ে গেলেন এবং সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলাপ করতে রাজি হলেন। আমরা জেলে, কি আলাপ হয়েছিল জানি না। তবে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে কামরুদ্দিন সাহেব জেলে আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বললেন, নাজিমুদ্দীন সাহেব এই দাবিগুলি মানতে রাজি হয়েছেন; এখনই পূর্ব পাকিস্তানের অফিসিয়াল ভাষা বাংলা করে ফেলবে। পূর্ব পাকিস্তান আইনসভা থেকে সুপারিশ করবেন, যাতে কেন্দ্রে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হয়। সমস্ত মামলা উঠিয়ে নিবেন, বন্দিদের মুক্তি দিবেন এবং পুলিশ যে জুলুম করেছে সেই জন্য তিনি নিজেই তদন্ত করবেন। আর কি কি ছিল আমার মনে নাই। তিনি নিজেই হোম মিনিস্টার, আবার নিজেই তদন্ত করবেন এ যেন এক প্রহসন। আমাদের এক জায়গায় রাখা হয়েছিল জেলের ভিতর। যে ওয়ার্ডে আমাদের রাখা হয়েছিল, তার নাম চার নম্বর ওয়ার্ড। তিনতলা দালান। দেওয়ালের বাইরেই মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচদিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল দশটায় মেয়েরা স্কুলের ছাদে উঠে স্লোগান দিতে শুরু করত, আর চারটায় শেষ করত। ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা একটু ক্লান্তও হত না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই,’ ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’- নানা ধরনের স্লোগান। এই সময় শামসুল হক সাহেবকে আমি বললাম, ‘হক সাহেব ঐ দেখুন, আমাদের বোনেরা বেরিয়ে এসেছে। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে পারবে না।’ হক সাহেব আমাকে বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ, মুজিব।’ আমাদের ১১ তারিখে জেলে নেওয়া হয়েছিল, আর ১৫ তারিখ সন্ধ্যায় মুক্তি দেওয়া হয়। জেলগেট থেকে শোভাযাত্রা করে আমাদের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে নিয়ে যাওয়া হলো। ১৩ তারিখ সন্ধ্যায় কারাগারের ভিতর একটা গোলমাল হয়। একজন অবাঙালি জমাদার আমাদের ওয়ার্ডে তালা বন্ধ করতে এসেছেন। আমরা আমাদের জায়গায় এই সময় বসে থাকতাম। জমাদার সাহেব এক দুই গণনা করে দেখতেন, আমরা সংখ্যায় ঠিক আছি কি না। হিসাব মিললে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিতেন। সন্ধ্যার সময় জেলখানার সমস্ত কয়েদিদের গণনা করে বাইরে থেকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে বন্ধ করা হয়। জমাদার কয়েকবার গণনা করলেন, কিন্তু হিসাব ঠিক হচ্ছে না। পাশের আরেকটা রুমেও আমাদের কিছু ছাত্র ছিল, তাদের গণনা ঠিক হয়েছে। ছোট ছোট কয়েকজন ছাত্র ছিল, তারা কারও কথা শুনতে চাইত না। গণনার সময় এক জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যেত। আমি ও শামসুল হক সাহেব সকলকে ধমকিয়ে বসিলে রাখতাম। আমরা দুইজন ও আবদুল মান্নান (এখন নবকুমার হাইস্কুলের হেডমাস্টার) এই তিনজনই একটু বয়সে বড় ছিলাম। খাওয়ার ভাগ-বাটোয়ারার ভাগ মান্নান সাহেবের উপরই ছিল। হিসাব যখন মিলছে না তখন জমাদার সাহেব রাগ করে ফেললেন এবং কড়া কথা বললেন। এতে ছাত্ররা ক্ষেপে জায়গা ছেড়ে উঠে পড়ল এবং হৈচৈ শুরু করল। আমি ও হক সাহেব আবার সকলকে এক জায়গায় বসিয়ে দিলাম। জমাদার সাহেব গণনা করলেন এবং হিসাব মিলল। কিন্তু দরজার বাইরে যেয়ে তিনি হঠাৎ বাঁশি বাজিয়ে দিলেন এবং পাগলা ঘণ্টা বেজে গেল। পাগলা ঘণ্টার অর্থ বিপদ সংকেত। এ অবস্থায় জেল সিপাহিরা যে যে অবস্থায় থাকুক না কেন, বন্দুক-লাঠিসোটা নিয়ে ভিতরে আসে এবং দরকার হলে মারপিট শুরু করে। এই সময় আইন বলে কিছুই থাকে না। সিপাহিরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে, যদিও সুবেদার হাওলাদার তাদের সাথে থাকে। জেলার ও ডেপুটি জেলার সাহেবরাও ভিতরের দিকে ছুটতে থাকেন। আমরা কিছুতেই বুঝতে পারলাম না, কি হয়েছে। যে বাঙালি সিপাহি আমাদের ওখানে ডিউটিতে ছিল সে তালা বন্ধ করে ফেলেছে। জমাদার তার কাছে চাবি চাইল। সে চাবি দিতে আপত্তি করল। এ নিয়ে দুইজনের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হলো, আমরা দেখতে পেলাম। সিপাহি চাবি নিয়ে এক দৌড়ে দোতলা থেকে নিচে নেমে গেল। জমাদারের ইচ্ছা ছিল দরজা খুলে সিপাহিদের নিয়ে ভিতরে ঢুকে আমাদের মারপিট করবে। জেলার, ডেপুটি জেলার বা সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব ভিতরে আসবার পূর্বেই আমরা বুঝতে পেরে সকলকে তাড়াতাড়ি যার যার জায়গায় বসতে বলে শামসুল হক সাহেব ও আমি দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের না মেরে ভিতরে যেন কেউ না আসতে পারে এই উদ্দেশ্যে। এ কথাও সকলকে বলে দিলাম যে, আমরা মার না খাওয়া পর্যন্ত কেউ হাত তুলবে না। যদি আমাদের আক্রমণ করে এবং মারপিট করে তখন টেবিল, চেয়ার, থালা, বাটি যা আছে তাই দিয়ে প্রতিরোধ করত হবে। হক সাহেব ও আমি দুইজনই একগুঁয়ে ছিলাম। দরকার হলে সমানে হাতও চালাতে পারতাম, আর এটা আমার ছোট্টকাল থেকে বদ অভ্যাসও ছিল। সিপাহি যদি চাবি না নিয়ে ভাগত তবে আমাদের মার খেতে হত, সে সম্বন্ধে সন্দেহ ছিল না। কারণ, আমরা তো একটা রুমে বন্ধ। এর মধ্যে বহু সিপাহি চলে এসেছে, তারা অসভ্য ভাষায় গালাগালি করছিল। এমন সময় জেলার সাহেব ও ডেপুটি জেলার জনাব মোখলেসুর রহমান আমাদের গেটে এসে দাঁড়িয়ে সিপাহিদের নিচে যেতে হুকুম দিলেন। কিছু সময়ের মধ্যে জেল সুপারিনটেনডেন্ট মি. বিলও এসে হাজির হলেন এবং ঘটনা শুনে সিপাহিদের যেতে বললেন। সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবকে শামসুল হক সাহেব সমস্ত ঘটনা বললেন। এই বিল সাহেবই ১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে রাজবন্দিদের উপর গুলি করে কয়েকজন দেশপ্রেমিককে হত্যা করেছিলেন। পরে আমরা বুঝতে পারলাম একটা ষড়যন্ত্র হয়েছিল, আমাদের মারপিট করার জন্য। পরের দিন ডেপুটি জেলার মোখলেসুর রহমান সাহেব আমাদের জেলের আইনকানুন ও নিয়ম সম্বন্ধে অনেক কিছু বললেন। আমি যদিও কয়েকদিন হাজত খেটেছিলাম ছোটবেলায়, তবু জেলের আইনকানুন কিছুই বুঝতাম না, আর জানতাম না। দু’একখানা বই পড়ে যা কিছু সামান্য জ্ঞান হয়েছিল জেল সম্বন্ধে। এ কথা সত্য, আইনকানুন ছাত্ররা একটু কমই মানত জেলখানায়। শামসুল হক সাহেব, মান্নান সাহেব ও আমি- এই তিনজনই সকলকে বুঝিয়ে রাখতাম। এদের মধ্যে অনেকে স্কুলের ছাত্রও ছিল। নয় কি দশ বছরের একটা ছেলেও ছিল আমাদের সাথে। তার বাবা তার সাথে জেলগেটে দেখা করতে এসেছিল এবং তাকে বলেছিল, ‘তোকে আজই বের করে নিব’। ছেলেটা তার বাবাকে বলেছিল, ‘অন্যান্য ছাত্রদের না ছাড়লে আমি যাব না’। সে যখন এই কথা ফিরে এসে আমাদের বলল, তখন সকলে তাকে আদর করতে লাগল এবং তার নামে ‘জিন্দাবাদ’ দিল। তার নাম আজ আর আমার মনে নাই, তবে কথাগুলো মনে আছে। ভীষণ শক্ত ছেলে ছিল। গ্রেপ্তারকৃত একজন ছাত্রেরও মনোবল নষ্ট হয় নাই। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যে কোনো ত্যাগ তারা স্বীকারে প্রস্তুত ছিল।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ৯৫-৯৬ পৃষ্ঠা) অতি সহজ-সরল ভাষায় জাতির পিতা ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নটির যে বিবরণ প্রদান করেছেন তাতে একদিকে যেমন করে বাংলার তরুণ-যুবার অসাধারণ মনোবলের পরিচয় পাওয়া যায় অন্যদিকে তেমনি বাংলার মেয়েরা, স্কুলপড়ুয়া বালকদের অসাধারণ দেশপ্রেমের বিবরণ পাওয়া যায়। কারাগারের যে বাঙালি রক্ষী চাবি নিয়ে নিচে নেমে এসেছিলেন তার প্রচ্ছন্ন দেশপ্রেম মুগ্ধ করার মতো যেমনি স্কুলপড়ুয়া বালক তার সঙ্গে জেলে থাকা রাজবন্দিদের মুক্তি না দিলে সে নিজেও জেলের বাইরে যেতে চায় না বলে যে দৃঢ় মনোবলের পরিচয় দিয়েছে তা জাতি হিসেবে আমাদের গর্বের ধন। আমরা যদি সিক্রেটস ডকুমেন্টসের প্রথম খণ্ডটি দেখি তবে তাতেও দেখতে পাই যে পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করতে বঙ্গবন্ধুকে পাওয়া যায় ১৯৪৮-এর জানুয়ারিতেই। ১৩ জানুয়ারি ১৯৪৮ উপস্থাপিত পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয় যে শেখ মুজিবুর রহমান প্রকাশিত একটি পুস্তিকা ‘পূর্ব্ব পাকিস্তানে দুর্ভাগা জনসাধারণ কৈফিয়ত দিতে হবে আমাদের দাবী’ মূল্য ৩ টাকা বর্ধমান হাউসের সামনে বিলি/বিক্রি করা হয় (পৃষ্ঠা ৪)। বস্তুত ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু ও তার সাথীরা যে নিজস্ব ধারার রাজনীতি গড়ে তুলেন এবং সেটি যে পাকিস্তানের মূল রাজনীতির ভিত্তিতে ভিন্নতা আনতে শুরু করে সেটি আঁচ করতে এমনকি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীরও কিছু বাকি থাকেনি। মার্চের ভাষা আন্দোলনে বাংলার জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও অংশগ্রহণ পাকিস্তানি শাসকদের ভীত করে তোলে। বঙ্গবন্ধুর জবানিতেই আমরা সামনে জানতে পারব বাংলা ভাষা আন্দোলন কোন পথ ধরে সামনে এগিয়ে যায়। আমরা এটিও অনুভব করব যে বাংলা ভাষার আন্দোলনই ছাত্রলীগের গণভিত্তি তৈরি করে এবং মুসলিম লীগের রাজনীতিকে বাংলায় শেকড়সহ উপড়ে ফেলা হয়।

মোস্তাফা জব্বার : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App