×

মুক্তচিন্তা

এ অভিযান ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১০:২৫ পিএম

যুবলীগ সভাপতির মতো জনগণও মনে করে এই অবৈধ বাণিজ্য একদিনেই বেড়ে ওঠেনি। শোভন-রাব্বানীর মতো এক ছাত্রনেতা এই ছাত্রলীগের মূল নেতৃত্ব থেকে বেরিয়ে গিয়ে আমানতকারীর অর্থাৎ সাধারণ মানুষের টাকায় চলা ব্যাংকের শত কোটি টাকা করায়ত্ত করে লন্ডন-ঢাকা ক্ষেপ মারছেন। সে কারণে এসব প্রশ্নের উত্তর তো জনগণ নেতাদের কাছেই চাইবে। কারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে এটা কম-বেশি সবারই জিজ্ঞাসা থাকে, প্রশাসন সরকারের নির্দেশনার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা কি রাখে?

শোভন-রাব্বানীকে সরিয়ে দিয়ে ছাত্রলীগের যে শুদ্ধি আনা হলো, তাতে প্রধানমন্ত্রী প্রশংসিত হচ্ছেন। কেন্দ্র থেকে প্রত্যন্ত ইউনিটগুলোতে এর প্রভাব পড়েছে। এক ধরনের আতঙ্ক আছে। আর তাই ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ-আতঙ্ক থাকলেও বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থী এতে একটা পজেটিভ ইঙ্গিতই পেয়েছে। এমনকি মন্ত্রীদেরও কেউ কেউ ছাত্রলীগের ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে বলেছেন, এমন নজির নেই অতীতে। কিন্তু রাব্বানী কিংবা শোভন আত্মপক্ষ থেকে সবকিছুর ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে। কিন্তু কথায় চিঁড়া ভিজেনি। যা হওয়ার হয়েছে। শোভন-রাব্বানী ঝড় না থামতেই নতুন ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হলো সারাদেশ। যুবলীগকেও কাঠগড়ায় তুলেছেন দলের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যার ইঙ্গিত ক’দিন আগে তিনি দিয়েছিলেন একটা সভায়। যুবলীগের পক্ষ থেকে তার জন্মবার্ষিকী পালনের স্খাবকতা করতে গেলে তিনি বলেছিলেন, চাঁদাবাজির অর্থ দিয়ে তার দোয়ার প্রয়োজন নেই। এবং সে দিন থেকেই যুবলীগের মাঝেও একটা আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল। কখন কে উঠেন কাঠগড়ায়। কার ওপর নেমে আসে খড়গ, জারি হয় পরোয়ানা এ শঙ্কাটা ছিল অনেকেরই। কিন্তু এত দ্রুত যে একটা কিছু হয়ে যাবে, তা ছিল হয়তো ধারণার বাইরে, আর তাইতো যার তাৎক্ষণিক রেজাল্ট খুব তাড়াতাড়ি পেয়ে গেল বাংলাদেশ। ‘লীগ’ নামটার ইতিহাস অনেক ত্যাগের, লীগের ইতিহাস আন্দোলনের, জনগণের অধিকার আদায়ের। এই নামটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই বাংলাদেশের আবেগ। এই লীগের সঙ্গে বাংলাদেশের কিংবদন্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম জড়িত। এই নামটা মানেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। আওয়ামী লীগের একটা স্লোগানও হলো ‘বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ’। অথচ এই নামটাকেই ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো সময়ে ন্যক্কারজনক ঘটনাগুলো করে যাচ্ছে ওই দলের কর্মীরা। আজকের বাংলাদেশে লীগ ঘরানাটাই প্রধান। বাস্তবতার নিরিখে লীগই এখন বাংলাদেশে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। সরকারি পক্ষ থেকে বারবার জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে জাতীয় আয়ের কথা, আমাদের জিডিপি হার মানাচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকেও। একটা শনৈ শনৈ উন্নতি এখন দৃশ্যমান সারাদেশটাতেই। উন্নয়নের স্লোগান শুধু শুধুই নয়। দেড় হাজার কোটি টাকার প্রজক্টে নিয়ে কাজ চলা জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে সে কারণেই ১৮৬ কোটি টাকার ভাগ বসাতে পারে শোভন-রাব্বানীরা। আর সে জন্যই অর্থটা আসলে বাংলাদেশের কোনো ফ্যাক্টর বলে মনেই হয় না। নৈতিক হোক আর অনৈতিক হোক অর্থের প্রবাহ না থাকলে পর্দা-বালিশ-বই-কম্পিউটার মেরামতের মতো স্বল্পমূল্যের সামগ্রীর মূল্য কোটি টাকা ছড়িয়ে যেত না। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল খুঁটিয়ে খুঁটিয়েও হাঁটতে পারছে না। বলতে গেলে এখন বাংলাদেশের একমাত্র শব্দই লীগ। তাইতো লীগ নামক শব্দ দিয়ে কত সংগঠন গজিয়ে উঠেছে, তার ইয়ত্তা নেই। এই ব্রিটেনে কোনো বাংলাদেশি কৃষক নেই, তবুও শুনেছি এখানে আছে কৃষকের লীগ, তাঁতীর তাঁত বোনা কবে শেষ হয়েছে কে জানে, তবুও লীগের মন্ত্রে তাঁতী লীগও গড়ে তুলেছেন ব্রিটেনের কিছু লীগ দরদিরা। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু-শেখ হাসিনা-শেখ রাসেল নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনগুলোর মাঝে এখানেও আছে দ্বিধাবিভক্তি, নিজেদের মাঝেই। আমার বাস করা শহরে তো বটেই, পাশাপাশি শহরগুলোতে একই সংগঠনের (ব্যানার একই) নামে আলাদা আলাদা মিটিং হয় বিভিন্ন দিবসে। বিভিন্ন দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজনে কার আগে কোনো গ্রুপের নেতাকে বক্তৃতা দিতে হবে, এ নিয়ে হিমশিম খায় আমার বাস করা শহরের সহকারী দূতাবাস। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি নৈমিত্তিক ব্যাপার, দূতাবাসের অভ্যন্তরেই। সত্যি কথা হলো, দূতাবাস আয়োজিত জাতীয় দিবসগুলোতে লীগের কর্মী-সমর্থকদের বাইরে হাতেগোনা দুয়েকজন ছাড়া খুব একটা অন্য কারো উপস্থিত না হওয়াও এর একটা কারণ হতে পারে। আর এসবে চোখ দিলেই আমরা ধারণায় নিতে পারি, কেন বেড়ে যাচ্ছে লীগ নামের তৎপরতা। জুয়া-ক্যাসিনো তথা অনৈতিক ব্যবসার সন্ধানে নামা ১৮ সেপ্টেম্বর বুধবার রাতের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ (ক্রীড়া চক্র) ক্লাবে র‌্যাবের অভিযানকালে দেখা যায়, যে রুমটিতে ক্যাসিনো পরিচালনা করা হতো সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি টাঙানো। পাশেই মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের ছবি ঝুলানো। এ ছাড়া সম্রাটের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ (ক্রীড়া চক্র) ক্লাবে নেতৃস্থানীয়দের ছবিও ঝুলতে দেখা যায়। এ ব্যবসাটি তিনিই চালান। অর্থাৎ অনৈতিক ব্যবসাটাতেও ব্যবহৃত হচ্ছে লীগ কিংবা দেশের প্রধানমন্ত্রী কিংবা বঙ্গবন্ধুর ছবি। এ রকম ছবি-ব্যবসা ব্রিটেনেও আছে। এমনকি বঙ্গবন্ধু কিংবা শেখ হাসিনার পরিবারের কারো সঙ্গে ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়ে নিজেকে মহিমান্বিত করে তোলা হচ্ছে। এরাই আবার এখান থেকেও দেশের সঙ্গে করছে বিভিন্ন মামলার বিভিন্ন ধরনের সুপারিশ। যে সুপারিশ থেকে এরাও বানিয়ে নিচ্ছে কাড়ি কাড়ি টাকা। দেশে-বিদেশে লীগের নাম নিয়ে চলছে দুর্বৃত্তায়ন... ছাত্রলীগ চাঁদাবাজির দায়ে সরাসরি সম্পৃক্ত, যুবলীগের অধিকাংশ নেতা অবৈধ আর অনৈতিক ব্যবসায় কোটি কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য করছেন, আর চাঁদাবাজিতে জমে উঠছে তাদের টাকার পাহাড়। সারাদেশটাতেই তারা তৈরি করেছেন টেন্ডার আর চাঁদাবাজির অবাধ নেটওয়ার্ক। এমনি সময়ে লাগাম টেনে ধরতে উদ্যোগী হয়েছেন দলটির নেতা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উপর থেকেই শুরু করেছেন তিনি শুদ্ধি অভিযান। ছাত্রলীগ থেকে যুবলীগ... একটা স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে সংগঠনের নেতাকর্মীদের। যা জেলা-উপজেলায় দুর্নীতিবাজ-চাঁদাবাজ লীগ নামধারীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। অনেকেই গা ঢাকা দিতে পারে, এ শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দুদকের অভিযানে প্রশাসনের বড় কর্মকর্তাদেরও ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। প্রধানমন্ত্রীর এ রকম কঠোর আত্মশুদ্ধির ব্যাপারটি যখন প্রশংসিত হচ্ছে, ঠিক সে সময়ে যুবলীগের সভাপতি কি সঠিক কথাগুলো বলতে পেরেছেন গণমাধ্যমে, সে প্রশ্নটিও আসছে। মহানগর যুবলীগের সভাপতিসহ অন্যান্য পদবির নেতারাও যেখানে চাঁদাবাজি কিংবা অবৈধ ব্যবসায় জড়িত, যাদের গ্রেপ্তার করল র‌্যাব, সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমালোচনা করে এখন তিনি নিজেই সমালোচিত হচ্ছেন। কারণ তার কথায় এই নেতাদের দ্বারাই নাকি মহানগরে যুবলীগ সবচেয়ে বেশি সংগঠিত হয়েছে। যে নেতারা চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত, যারা দেশের অবৈধ-অনৈতিক ব্যবসার নেতৃত্ব দেয়, তারুণ্যকে মাদকে ডুবিয়ে দিতে যারা অনৈতিক ব্যবসা চালাচ্ছে, তারাই মহানগরের নেতা। এদের ছত্রছায়ায় সংগঠন তো সংগঠিত হওয়ার কথা নয়, বরং এদের নেতৃত্বে অনৈতিকতাই প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে, এটাই প্রমাণিত হয়েছে র‌্যাবের অভিযানে। অথচ এদের পক্ষে কথা বলে, তাদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমালোচনা করে মূলত ‘লীগ’টাকে তিনি প্রশ্নের সম্মুখীন করে তুললেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, আগে কেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এগুলো দেখেনি। অন্যদিকে তার নেতাদের বিচারের জন্য ‘যুবলীগের ট্রাইব্যুনাল’ কথাটা বলে একটা দেশে চলমান আইন-আদালতের বাইরে একটা নিজস্ব আইনের ইঙ্গিত দিয়ে তিনি যুবলীগকে যেন রাষ্ট্রীয় আইনের বাইরে নিয়ে নিলেন। একথাগুলো উচ্চারণ করে তিনি সেই প্রচলতি ‘গডফাদার কনসেপ্টে’র কথাটাই মনে করিয়ে দিলেন সাধারণ মানুষকে। যুবলীগ সভাপতির মতো জনগণও মনে করে এই অবৈধ বাণিজ্য একদিনেই বেড়ে উঠেনি। শোভন-রাব্বানীর মতো এক ছাত্রনেতা এই ছাত্রলীগের মূল নেতৃত্ব থেকে বেরিয়ে গিয়ে আমানতকারীর অর্থাৎ সাধারণ মানুষের টাকায় চলা ব্যাংকের শত কোটি টাকা করায়ত্ত করে লন্ডন-ঢাকা ক্ষেপ মারছেন। সে কারণে এসব প্রশ্নের উত্তর তো জনগণ নেতাদের কাছেই চাইবে। কারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে এটা কম বেশি সবারই জিজ্ঞাসা থাকে, প্রশাসন সরকারের নির্দেশনার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা কি রাখে? প্রশ্ন হলো এ শুদ্ধি অভিযান কি কেবল রাজধানীতে সীমাবদ্ধ থাকবে নাকি সমাজকে জিম্মি করে রাখা ক্ষমতাধরদের ক্ষমতার উৎসকে গুড়িয়ে দেবে? আমরা চাই দীর্ঘদিনের মর্চে ধরা শুদ্ধ রাজনীতি চর্চায় এ অভিযান ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App