×

সাময়িকী

শাড়ি যৌনাবেদনপূর্ণ পোশাক, জানতাম না

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৭:৫৫ পিএম

শাড়ি প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার একটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় লিখেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং মিডিয়ার বাইরে এ নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষের কথার জন্ম হয়েছে। অনেক নারী ব্যক্তিত্ব হতাশ হয়েছেন। দুঃখ পেয়েছেন। কয়েকজন আশা করেননি স্যারের কাছ থেকে এমন লেখা, সেটাও উল্লেখ করেছেন। কেউবা এটাকে আমলে নেননি।

আলোকিত কোনো শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তির লেখার ওপর মন্তব্য করবার দুঃসাহস, ইচ্ছে কোনোটাই আমার নেই। কোনোদিনও ছিল না। আজো নেই। তবে তার বা তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কোনো একটি ইস্যুতে প্রাসঙ্গিকভাবে নিজের মতামত দেয়া যায়। এটা ব্যক্তিস্বাধীনতার মধ্যে পড়ে। সুতরাং সাম্প্রতিক সময়ে শাড়ি নিয়ে উত্থাপিত প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু লিখবার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে একটা লেখা লিখতেই পারি। কারণ শাড়ি আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি পোশাক এবং দীর্ঘদিন আমি শাড়ি পরে বয়সটাকে অনায়াসে ফুরিয়ে দিচ্ছি। মানে হলো, বার্ধক্যের দিকে এগুচ্ছি। কাজেই দু’চারটি কথা বলাই যায়। কেন আমি শাড়ি পরি বা পছন্দ করি? এক কথায় উত্তর হলো, শাড়ি ভালোবাসি। আর তাই যে দিন থেকে শাড়ি পরতে শুরু করেছি, তখন থেকে কখনো চিন্তায় আসেনি, শাড়ির বিকল্প হিসেবে অন্য কিছু আছে কিনা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সবাইকে শাড়িই পরতে হবে এবং আমার মতো সকলেই শাড়িতে অভ্যস্ত হবেন, শাড়িকে বেশি পছন্দ করবেন। শাড়ি ছাড়া অন্য পোশাকেও মেয়েদের আমার এবং নিঃসন্দেহে অনেকেরই ভালো লাগে। আকর্ষণীয় লাগে তো বটেই। তবে এই ভালোলাগা-ভালোবাসা নির্ভর করে যতটা না তার পোশাকে, তার চাইতে বেশি নির্ভর করে তার চারপাশের পরিবেশ, তার ব্যক্তিত্বে এবং সামগ্রিক আচরণের সুস্থ বহিঃপ্রকাশের ওপর। যার মধ্যে তার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞান, মেধা, মানবতা, মাতৃত্ব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মেয়েদের পোশাকের ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতায় আমার অভিব্যক্তি এমনই। ব্যক্তিগতভাবে আমি ইতিবাচক ব্যক্তিত্বের ভেতরই ব্যক্তির রূপ খোঁজার চেষ্টা করি, খুঁজে পাই। যার ভেতর রূপের মাধুর্য অগাধ। শাড়ি প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার একটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় লিখেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং মিডিয়ার বাইরে এ নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষের কথার জন্ম হয়েছে। অনেক নারী ব্যক্তিত্ব হতাশ হয়েছেন। দুঃখ পেয়েছেন। কয়েকজন আশা করেননি স্যারের কাছ থেকে এমন লেখা, সেটাও উল্লেখ করেছেন। কেউবা এটাকে আমলে নেননি। কারণ একজন লেখক হিসেবে তিনি তার ব্যক্তিগত অভিমত দিয়েছেন। তবে বলেছেন, কিছু শব্দের ব্যবহার ভালো লাগেনি। দেশে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বা নৈতিক সামাজিক মূল্যবোধের যে ভঙ্গুর অবস্থা, নারীর প্রতি কামনা-বাসনার যে বেপরোয়া আচরণ ও অপরিণত-অসম্পূর্ণ শিক্ষা, ধর্ষণ আর যৌন হয়রানির যে লাগামছাড়া পরিস্থিতি ইত্যাদি অবস্থার মধ্যে একজন নারীকে কীভাবে দেখা দরকার, মূল্যায়ন করা প্রয়োজন, আর কীভাবে দেখছি, মূল্যায়ন করছি, তার বিশ্লেষণ ও ভাবনাটাও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কমবেশি সকলের। যাই হোক, শুরুতেই বলেছি, শাড়ি আমার খুব প্রিয় একটি পোশাক। স্কুল জীবনে ফ্রক, প্যান্ট-শার্ট, কলেজ জীবনে সালোয়ার কামিজ, ভার্সিটি জীবনে সালোয়ার কামিজের সাথে মাঝেসাঝে শাড়ি এবং তারপর কর্মময় জীবনের এই অবধি শাড়িতেই জড়িয়ে থাকছি। সিরিয়াসলি বলছি, এই শাড়ি পরার কারণ ছিল, বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে একটি পোশাককে বেছে নেয়া এবং শাড়ির প্রতি প্রচণ্ড দুর্বলতা। কিন্তু দীর্ঘদিন শাড়ি পরে একবারও মনে হয়নি আমার যে, শাড়ি হলো পৃথিবীর সবচেয়ে যৌনাবেদনপূর্ণ একটি পোশাক। হয়তো শাড়ি পরা অবস্থায় আয়নায় আমাকে যে দেখেছে, গুছিয়ে দিয়েছে, সে-ই আমি হলাম একজন নারী। আমি আমাকে দেখেছি, সেজেছি আমার মতো করে। কিন্তু যিনি শাড়িকে যৌনাবেদনপূর্ণ পোশাক হিসেবে দেখছেন, ভাবছেন এবং বলছেন, তিনি হলেন একজন পুরুষ। শ্রদ্ধা রেখে বলছি, তিনি কীভাবে দেখবেন, ভাববেন, এটি সম্পূর্ণ তার ব্যাপার। তবে সমাজে শুধু পুরুষই নারীর একমাত্র দর্শক নয় যেমন, ঠিক তেমনি নারীই পুরুষের একমাত্র দর্শক নয়। নারী ও পুরুষ, এই দু’সত্তার সম্মিলিত দর্শকও সমাজে আছেন এবং তারা বিভিন্ন সামাজিক সম্পর্কের ভেতর দিয়ে বসবাস করছেন। একজন পিতা বা ভাই, তার কন্যা বা বোনের সৌন্দর্যও উপভোগ করেন। একজন মা বা বোনও, তার পুত্র বা ভাইয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করে থাকেন। যেখানে পোশাকে যৌন আবেদন থাকার প্রয়োজন পড়ে না। সম্পর্কের এসব জায়গায় যে কোনো পোশাকই পরা হোক না কেন। এসব সম্পর্কের বাইরে দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা নারী ও পুরুষের মধ্যে বেশি, এই সত্য ঘুরেফিরে প্রকাশ পায়। কিন্তু তারপরও এই সমাজে দেখা যায় যে, কন্যার শ্লীলতাহানি করেছেন কোনো বাবা, কোনো চাচা-মামা কিংবা বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করেছেন তারই আপন ভাই কিংবা আত্মীয়-পরিজন। শাড়ি ও শাড়ির সৌন্দর্যের গুরুত্ব দিতে গিয়ে বাঙালি নারীর শরীর নিয়ে যে উঁচু-নিচু ঢেউ এবং শাড়িতে শরীর কতটা অনাবৃত রাখলে শরীর রহস্যখচিত হয়ে ওঠে এবং আরো কিছু বলা হলো, এক কথায় ভালো লাগেনি। কারণ শাড়িকে শরীর সর্বস্ব করে দেখাটা আপত্তিকর লেগেছে। পিনআপ ম্যাগাজিনের মতো লেগেছে। সেই সাথে নারীর সৌন্দর্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে শারীরিক উচ্চতার কথা বলা হয়েছে। একজন নারীকে একজন পুরুষের কাছে কেমন লাগবে কিংবা একজন পুরুষ একজন নারীকে কোন দৃষ্টিতে দেখবেন, উপভোগ করবেন, এটা সম্পূর্ণ তার ব্যাপার। দেখাটা ব্যক্তির স্বাদ, শিক্ষার ওপর। আবার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মানুষ যে শিক্ষা অর্জন করে থাকে, তা ব্যক্তিসত্তার ভেতর শেকড় হয়ে থাকে। তা থেকে বেরিয়ে আসাটা কঠিন হয়ে পড়ে। বাঙালি নারীদের গড় উচ্চতা ৫ ফিট ২ কী ৩ ইঞ্চি। এই উচ্চতার কমবেশি অবস্থায় অনেক নারী আছেন। যারা শাড়ি পরেন এবং যাদের অনেক সুন্দর দেখায়। অন্যরাও তাদের সুন্দর বলেন। কিন্তু নারীর উচ্চতা ৫ ফিট ৪ ইঞ্চির কম হলে তার শরীরে নারীজনিত গীতিময় ভঙ্গি পুরোপুরি ফুটে ওঠে না- এমন উপলব্ধি যে পুরুষ ব্যক্তির, তিনি সম্ভবত নিজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। এটা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত অভিমত, সর্বজনীন নয়। আর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিজের জন্য যতটা সম্মানের, কল্যাণের, অন্যের জন্য তা নাও হতে পারে। আর এখানেই সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। বিশেষত যারা জ্ঞানী, বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যক্তি হিসেবে সমাজে সমাদৃত। আবার অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতার নারীর প্রতি কোনো পুরুষের অনাগ্রহ থাকতে পারে, সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে কোনো পুরুষ তাদের সুন্দরের তালিকায় স্থান নাও দিতে পারেন। যেমন পারেন কোনো নারী কোনো পুরুষকে মানুষ নাও ভাবতে।

আমাদের সমাজে নারীরা এখনো নিরাপদ নয়। নারীর প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে গিয়েও কামনা-বাসনার জায়গায় এসে পুরুষ সমাজ দাঁড়িয়ে যায়। খুব সহজে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো সম্ভব হয় না। একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করলেও এই সমাজে সেই নারীর আগে দোষ খোঁজা হয়।

শাড়ির জন্য নারীর শরীরিক উচ্চতা দরকার, কথাটা কতটা খাটে যদি আমরা গ্রামীণ নারীদের দেখি। গ্রামের নারীরা গড় উচ্চতার হয়ে থাকেন, কেউ আবার তারও কম এবং তারা শাড়ি পরেন। তাদের নারীজনিত গতিময় ভঙ্গি নেই, সৌন্দর্য নেই, এমন কথা সম্ভবত কেউ বলতে পারবেন না। বাঙালি গ্রামীণ নারীদের অকৃত্রিম রূপ শাড়ির ভাঁজে নেই। বরং গ্রামীণ সরল অভিব্যক্তিতে আছে। তাই উচ্চতা দিয়ে নারীর সৌন্দর্য পরিমাপ কতটা সমীচীন, ভাবা দরকার। আমাদের সমাজে নারীরা এখনো নিরাপদ নয়। নারীর প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে গিয়েও কামনা-বাসনার জায়গায় এসে পুরুষ সমাজ দাঁড়িয়ে যায়। খুব সহজে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো সম্ভব হয় না। একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করলেও এই সমাজে সেই নারীর আগে দোষ খোঁজা হয়। প্রতিনিয়ত নারীরা ধর্ষণ আর যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। ছোট-বড় সকল বয়সের নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে মাদ্রাসা, মন্দির, পরিবহন, অফিস, আদালত, থানা, হাসপাতাল, পথঘাট, পরিবার সবখানেই পুরুষের যৌন আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এ দেশে ধর্ষকের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। আড়াই মাসের শিশুও ধর্ষকের থাবা থেকে তার কচি দেহকে রক্ষা করতে পারেনি। পারছে না। অথচ আড়াই মাসের শিশুর শরীরে নারীজনিত গতিময়তা থাকবার কথা নয়। সে নারী বা পুরুষ হয়ে ওঠে না সেই অর্থে। অথচ তার শরীরটাও চলে যাচ্ছে পুরুষের কামনার বিষাক্ত ছোবলের ভেতর। রাষ্ট্রও পারছে না ধর্ষক শ্রেণিকে ভীত করতে। রোধ করতে। যৌনতা, কামনা-বাসনার নিকৃষ্ট ও জঘন্যতম বহিঃপ্রকাশ হলো ধর্ষণ। জ্ঞানীরা, বোদ্ধারা দায়ী করেন সামাজিক অবক্ষয়কে। বলেন, সচেতনতার অভাব বড্ড। অথচ সমাজকে ক্ষয় থেকে মুক্ত করতে কিংবা নারীর প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ প্রদর্শন হয় কী করে, সেটা খুব একটা তাদের বলতে শুনি না। নারীর সৌন্দর্য বলতে যদি কেবল নারীর শরীরকেই বুঝানো হয়, তাহলে সকলের দৃষ্টি তো সেই শরীরের দিকেই যাবে, তাই না? আর শাড়িকে যৌনাবেদনপূর্ণ বলা হলে, উঠতি বয়সের ছেলেপিলে কিংবা অসুস্থ মানসিকতার পুরুষ তো শাড়ি পরিহীতা নারীদের প্রতি দৃষ্টির মাধ্যমেই যৌন আচরণের কাজটি সেরে নেবার কথা ভাবতে পারেন। নাকি? পরিশেষে বলি, পোশাক নয়, একজন নারীর সৌন্দর্য, উজ্জ্বলতা তার ইতিবাচক ব্যক্তিত্বে। পোশাকের গুণগান গাইতে গিয়ে নারীর শরীরকে যৌনাবেদনময়ী করে উপস্থাপনের সময় বোধহয় এখন আর নেই। পুরুষের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে নারী এখন কেবল ভোগপণ্য নয়, বরং নারী তার মেধা, যোগ্যতা আর দক্ষতায় এখন অনেক পুরুষের চাইতেও শীর্ষে, এগিয়ে এবং শ্রদ্ধাপূর্ণ আসনে আসীন। আর সফলতার শীর্ষে পৌঁছেছেন, আর দশজন মানুষের জীবন আলোকিত করেছেন, দেশের জন্য সুনাম বয়ে এনেছেন, এমন অনেক নারী শাড়ি পরেন না। পোশাকের মানদণ্ডে তাদের অসুন্দর ভাবা এবং ছোট করে দেখার প্রচেষ্টা কষ্টদায়ক বৈকি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App