×

জাতীয়

ছাত্রলীগের গায়ে ‘চাঁদার’ কলঙ্ক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৩:২৩ এএম

ছাত্রলীগের গায়ে ‘চাঁদার’ কলঙ্ক
চাঁদাবাজি, হল দখল, টেন্ডার বাণিজ্য, অনুপ্রবেশ, মাদক ও টাকার বিনিময়ে কমিটি গঠন- ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নতুন নয়। তবে অতিসম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প থেকে ৮৬ কোটি টাকা চাঁদা দাবির ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এই অপকর্মের হোতা সংগঠনটির শীর্ষ দুই নেতা রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানী। দীর্ঘ যাছাই-বাছাই শেষে ১৪ মাস আগে শোভনকে সভাপতি ও রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অথচ এরাই ‘চাঁদা’র কলঙ্ক লেপে দেন শত সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটির গায়ে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে নেতৃত্ব থেকে শীর্ষ এই দুই নেতাকে সরিয়ে দেয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সংগঠনটির আদর্শিক নেত্রী শেখ হাসিনা। গণভবনে গত ৮ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের সংসদীয় ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের যৌথসভায় ছাত্রলীগের দুই নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে আলোচনা তোলেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। সেখানেই শোভন ও রাব্বানীকে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার কথা বলেন তিনি। এরপরই শুরু হয় তোলপাড়। ওই দিন থেকে প্রধানমন্ত্রী তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা বন্ধ করে দেন। এরপর একাধিকবার গণভবনে গেলেও প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাননি শোভন-রাব্বানী। উল্টো এই দুই ছাত্রলীগ নেতার গণভবনে প্রবেশের স্থায়ী পাস বাতিলের নির্দেশ দেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত চার আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, বিএম মোজাম্মেল হক ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠকও করেন শেখ হাসিনা। সেখানেও দুই নেতাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার বিষয়ে অনমনীয় মনোভাব দেখান তিনি। সে ক্ষেত্রে এ দুই নেতাকে সরিয়ে নতুন দুজন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করার বিষয়েও ভাবছেন আওয়ামী লীগ প্রধান। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ থাকলেও শোভন ও রাব্বানীর ওপর প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়েছেন মূলত জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ঘটনা নিয়ে। জাবির উন্নয়ন প্রকল্প থেকে ৪ থেকে ৬ শতাংশ টাকা চাঁদা দাবি করেন ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। যা জাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন। এ নিয়েই চটেছেন প্রধানমন্ত্রী। জাবি উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বলেন, গত ৮ আগস্ট ছাত্রলীগের সভাপতি শোভন ও সাধারণ সম্পাদক রাব্বানী আমার বাসায় আসে। তারা আমার কাছে ক্যাম্পাসের ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প থেকে ‘৪-৬ শতাংশ’ চাঁদা দাবি করে। নির্মাণ কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা তুলে দিতে তারা আমাকে চাপ দেয়। আমি প্রত্যাখ্যান করলে তারা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। একপর্যায়ে রাব্বানী বলেন, এখনকার দিনে ১-২ শতাংশের আলাপ কোথাও নেই। ৪-৬ শতাংশ ছাড়া কি হয়?…এটি একটি বড় প্রকল্প। আপনি আমাদের সহায়তা করলে, আমরাও আপনাকে সহযোগিতা করব। তিনি বলেন, পুরো প্রকল্প তহবিলের ৬ শতাংশ মানে হলো ৮৬ কোটি টাকা। আমি তাদের বললাম, আমি তাহলে ভবন বানাব কী দিয়ে, এসব কথা আমার সামনে আর বলবা না..আমি যখন তাদের চাপে নতি স্বীকার করতে অপারগতা প্রকাশ করলাম, তখন তারা আমার দিকে চেঁচিয়ে ওঠল এবং চলে গেল। তিনি আরো জানান, এতেও ক্ষান্ত হয়নি ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক। এর আগে গত ২৬ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন থাকার সময়ও আমার সঙ্গে দেখা করে নিজের পছন্দমতো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিতে চাপ দেয় রাব্বানী। বিষয়গুলো আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন, তারা (শোভন-রাব্বানী) তোমাকেও ঝামেলায় ফেলেছে! এ বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আমাকে কোনো দুশ্চিন্তা না করতেও বলেছেন। এদিকে উপাচার্যের কাছে চাঁদা দাবির অভিযোগটি ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী এতদিন অস্বীকার করে এলেও গতকাল একটি গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন, উপাচার্যের কাছে তারা তাদের ‘ন্যায্য’ পাওনা দাবি করেছিলেন। তবে সেই ন্যায্য পাওনার পরিমাণ কত ছিল, তা জানান তিনি। ঈদের খরচ হিসেবে ওই পাওনা দাবি করেছিলেন বলেও জানান রাব্বানী। শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ই নয়, দুই নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ- কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় (ইবি) শাখা ছাত্রলীগের কমিটিতে সাধারণ সম্পাদকের পদে ৪০ লাখ টাকা আর্থিক লেনদেন করেছেন। ৪০ লাখ টাকা দিয়ে নেতা হওয়া ইবি ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলামের সঙ্গে এক নেতার টেলিফোন আলাপে এ বিষয়টি প্রকাশ পায়। ওই টেলিফোন আলাপে তা উঠে আসে, রাকিবকে আঞ্চলিক নেতা হিসেবে ওই অঞ্চলের কমিটি গঠনের দায়িত্ব দিয়েছেন রাব্বানী। বিনিময়ে কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে টাকা দিতে হবে। এ ছাড়া টেন্ডারের ভাগ নিশ্চিত ও বাধা দূর করতে সামান্য অজুহাতে জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় (জবি) ছাত্রলীগের কমিটি ভেঙে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে শোভন-রাব্বানীর বিরুদ্ধে। জবি ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ জয়নুল আবেদীন রাসেল গতকাল তার ফেসবুকে পোস্টে শোভন-রাব্বানীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরে লিখেন, জনাব শোভন, রাব্বানী সাহেব….কেমন আছেন? মধুচন্দ্রিমা তো শেষ, এখন তো আর পায়ের তলায় মাটি খুজে পাবেন না। নিজেদের মহাপ্রতাপশালী ভেবেছিলেন, এখন দেখেন আপনাদের খুটির জোর কতটুকু। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক প্রত্যাশা নিয়ে আপনাদের নেতা বানিয়েছিল, আর আপনারা আপাকে কষ্ট দিলেন? আপা আপনাদের ক্ষমতা যেভাবে দিয়েছেন, আবার নিয়েও যাচ্ছেন। ছাত্রলীগের ইতিহাসে একমাত্র সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক আপনারা, যারা কিনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে প্রবেশে নিষিদ্ধ হয়েছেন। জনাব রাব্বানী সাহেব, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি স্থগিত করে আমাকে আর তরিকুলকে (জবির সাবেক সভাপতি) ডেকে নিয়ে মাসে কত টাকা করে যেন চেয়েছিলেন কমিটি ঠিক করে দেয়ার জন্য?? আর জগন্নাথের নতুন ক্যাম্পাসে বালু ভরাটের কাজের জন্য যে ঠিকাদারটা পাঠিয়েছিলেন তার নাম মনে আছে?? বালু ভরাট ঘনফুট কত টাকা করে যেন বলেছিলেন?? আপনি ভুলে গেলেও আমি ভুলি নাই। সেগুলো প্রমাণসহ দেয়া হয়েছে। আমাদের কমিটি ভেঙে যে মজাটা নিয়েছিলেন সেই মজাটা এখন আমি পাচ্ছি। আমরা বারবার বলার পরও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে না দিয়েই আমাদের কমিটি বিলুপ্ত করলেন। এখন তো মনে হচ্ছে আপনারাও আর কোনো ইউনিট কমিটি দিতে পারবেন না। আপনাদের এত ক্ষমতা তাহলে ফেব্রুয়ারিতে জগন্নাথের কমিটি বিলুপ্ত করে এখনো কমিটি দিতে পারলেন না কেন?? নাকি পোলাপাইনগুলোকে পেছনে পেছনে ঘুরিয়ে প্রটোকল নেয়ার ধান্দা। এসব ভণ্ডামি ছাত্রসমাজ বুঝে গেছে। ১ বছর ২ মাসে ১১০টি সাংগঠনিক জেলা ইউনিটের মধ্য মাত্র ২টা কমিটি দিয়েছেন, তাও ইবি ছাত্রলীগের কমিটিতে ৪০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। যদিও টাকা লেনদেনের বিনিময়ে কয়েকটি উপজেলা কমিটি দিয়েছেন। বাকি ১০৮ ইউনিট কমিটি মনে হয় না আর দিতে পারবেন, যদি না দেশরত্ন আপনাদের ক্ষমা করে শেষ সুযোগ না দেন।’ শুধু শোভন-রাব্বানী নয়; ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনটির নেতাদের বিরুদ্ধে আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিভিন্ন হলের নির্মাণ কাজ, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন নতুন ভবন নির্মাণ, নীলক্ষেতের ফুটপাত, রাজধানীর বিভিন্ন ভবনসহ নানা জায়গায় চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। ছাত্রলীগের আগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মহানগর ও বিভিন্ন হল কমিটির নেতাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ বারবারই উঠেছে। এমনকি এসব টাকার ভাগাভাগি নিয়েও নিজেদের মধ্যে অন্তর্কোন্দল দেখা দেয়। অতীতে খুনাখুনিরও ঘটনা ঘটেছে। যার জন্য বারবার নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হতে হয়েছে ছাত্রলীগকে। ক্ষুব্ধ হয়ে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রীর পদ থেকেও সরে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অতীতের বদনাম থেকে বেরিয়ে আসতেই এবার নিজ হাতে ছাত্রলীগের কমিটি করেন তিনি। কিন্তু সেই শোভন-রাব্বানীও ছাত্রলীগকে কলঙ্কিত করলেন চাঁদাবাজি, মাদক ও টেন্ডারবাজির কালিতে। আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল কেন্দ্রীয় নেতা প্রসঙ্গে ভোরের কাগজকে জানান, ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ এলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে চাঁদা দাবির ঘটনাটি প্রধানমন্ত্রী মোটেও ভালোভাবে নেননি। ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার এ ধরনের কর্মকাণ্ড তিনি খুবই কষ্ট পেয়েছেন। শোভন-রাব্বানীর বিষয়ে অনমনীয় তিনি। এদিকে স্বামী ও ছেলেকে জড়িয়ে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর আনা অভিযোগের বিষয়ে গতকাল সংবাদ সম্মেলন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ছাত্রলীগ আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা গল্প ফেঁদেছে। এ বিষয় আমি চ্যালেঞ্জ করছি। ঘটনা তদন্ত করে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও আচার্যকে আমি অনুরোধ করব। তিনি আরো বলেন, শোভন-রাব্বানীর মূল উদ্দেশ্য ছিল তারা ঠিকাদারের কাছ থেকে কমিশন নেবে। তারা এ বিষয়ে আমাকে ইঙ্গিত দিয়েছে। কিন্তু আমার কাছে এসে তারা হতাশ হয়েছে। তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে খোলা চিঠি লিখেছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App