×

মুক্তচিন্তা

ছিঁচকে চুরির ত্রিশূল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০১:৩০ পিএম

কয়েকটি দুর্নীতির চিত্র বর্তমানে সবার মুখে মুখে ফিরছে। তার মধ্যে অন্যতম বালিশ এবং পর্দা কেনার দুর্নীতি। দেশের অন্যতম মেগা প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসবাসের জন্য নির্মিত গ্রিন সিটিতে আসবাবপত্র ও অন্যান্য জিনিস ক্রয়ে লাগামছাড়া দুর্নীতির তথ্য ফাঁস হয়। একটি বালিশের পেছনে ব্যয় দেখানো হয় ৬ হাজার ৭১৭ টাকা। এর মধ্যে এর দাম বাবদ ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা আর সেই বালিশ নিচ থেকে ফ্ল্যাটে ওঠাতে খরচ ৭৬০ টাকা উল্লেখ করা হয়। এই আলোচিত ঘটনার পরও থামেনি দুর্নীতি। বরং মনে হয় এক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিযোগিতা হচ্ছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় ৭ কোটি টাকার বই কিনে। যেখানে সাড়ে ৫ হাজার টাকা দামের বই ৮৫ হাজার ৫০০ টাকায় কেনা হয়েছে। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের কেনাকাটার দুর্নীতির চিত্র আরো ভয়াবহ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একজন রোগীকে আড়াল করার পর্দা কিনেছে সাড়ে ৩৭ লাখ টাকায়। এত দামি পর্দা কেনা হলেও সেটি কার জন্য কেনা হয়েছে তা বলা কঠিন। কারণ মেডিকেল কলেজে পর্দার ব্যবহার নেই বছরের পর বছর। এই পর্দা কেনার বিষয়ে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সেই কেনাকাটার মধ্য দিয়েই ঘটনার শেষ নয়। সে সঙ্গে হাসপাতালটি ১১ কোটি ৫৩ লাখ ৪৬৫ টাকার মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনাকাটায় বিল দেখিয়েছে ৫২ কোটি ৬৬ লাখ ৭১ হাজার ২০০ টাকা। আরো আছে। একইভাবে অভাবনীয় দাম দেখিয়ে কেনা বেশিরভাগ যন্ত্রই ফেলে রাখা হয়েছে তালাবদ্ধ ঘরে। সেই ঘরের তালায় জং পড়েছে। বোঝাই যায় সহজে যে রোগীর সেবায় এসব যন্ত্রপাতি বের করা হয়নি। কয়েকটি যন্ত্রপাতির ঠিকানাও মেলেনি। কেনাকাটা কেন্দ্রিক দুর্নীতির সংস্কৃতির আরো আছে। ওয়াসার পানি বিশুদ্ধতা নিয়ে যখন হৈচৈ শুরু হলো তখন জানা গেল সেই পানি বিশুদ্ধ করতে আধুনিক যন্ত্রপাতি দরকার। তাই তড়িঘড়ি করেই সেই পানিকে বিশুদ্ধ করার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার জন্য টাকা বরাদ্দ হলো। কিন্তু ওয়াসার পানি বিশুদ্ধ হয়নি, তবে প্রকল্পের ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা পাইপ কেনার নামে পানিতে পড়ে গেছে। আফ্রিকার দেশ উগান্ডার বেশিরভাগ মানুষ নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত এবং সেখানে উন্নত পয়োনিষ্কাশন সুবিধারও অভাব। কিন্তু কীভাবে যেন সেই দেশকেই প্রশিক্ষণ নেয়ার দেশ হিসেবে যোগ্য ভাবছেন ওয়াসার কর্তাব্যক্তিরা। আরো মজার তথ্য আমরা ইতোমধ্যেই জেনে গেছি যে, চট্টগ্রাম ওয়াসা তাদের ২৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ‘প্রশিক্ষণের’ জন্য পূর্ব-মধ্য আফ্রিকার এই দরিদ্র দেশে পাঠিয়েছে। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের আরো ১৪ কর্মকর্তাও দেশটি ভ্রমণে গেছেন। এসব সফরে ব্যয় হয়েছে অন্তত ৫ কোটি টাকা। প্রাথমিকভাবে এ ব্যয় বিশ্বব্যাংক বহন করলেও পরে সুদে-আসলে তা ওয়াসাকেই পরিশোধ করতে হবে। দুর্নীতির থলেতে আরো আছে। কিছুদিন পরপর এগুলো বের হয়। বরেন্দ্র এলাকার বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) ১২৮ কোটি ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ব্যয়ে ‘পুকুর পুনঃখনন ও ভূ-উপরিস্থ পানি উন্নয়নের মাধ্যমে ক্ষুদ্র সেচে ব্যবহার’ শীর্ষক প্রকল্পের জন্য ১৬ কর্মকর্তাকে বিদেশ সফর করাবেন। প্রকল্পের ১৬ কর্মকর্তা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস যে কোনো একটি দেশ সফর করবেন এবং পুকুর পুনঃখনন ও ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের কাজে দক্ষতা অর্জন করবেন। প্রথম পর্যায়ে আটজন ও পরবর্তী পর্যায়ে আট কর্মকর্তা এই সফরে যাবেন। বালিশ, পর্দা আর প্রশিক্ষণই নয়, খাগড়াছড়ির আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন-৬ (এপিবিএন)-এর ঘর মেরামতের কাজে একটি ঢেউটিনের দাম ধরা হয়েছে ১ লাখ টাকা, যা বর্তমান বাজারমূল্যের তুলনায় ১০০ গুণেরও বেশি। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, ওই মেরামত কাজে মাত্র দুই বান্ডেল টিনের দাম দেখানো হয়েছে ১৪ লাখ টাকা। প্রতিনিয়তই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা ও ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য চলছে এবং নানা আলাপ-আলোচনায় ওঠে আসছে এসব দুর্নীতি। কেন এগুলো আলোচনায়? এ কথা তো সবাই মানবেন যে একটি দেশের সরকার চলে জনগণের কর ও ট্যাক্সের টাকায়। যত বাজেট বা প্রবৃদ্ধি হোক না কেন একজন শ্রমজীবী মানুষ যখন ক্ষুধা মেটাতে এক টুকরা রুটি আর কলা খান তখনো সেটির মূল্যের সঙ্গে তাকে ১৫ শতাংশ কর মূল্য হিসাবে পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটায় এ ধরনের অভিযোগ বারবার শুধু এখন নয় সব সময় ছিল। তবে এবারেরগুলো মোটা দাগের। খালি চোখেই দেখা যায়। অথচ ভিন্ন চিত্রই কাক্সিক্ষত, আমলাদের হওয়ার কথা জনগণের সেবক। চাকরিজীবীদের বলা হয় সিভিল সার্ভেন্ট। অর্থাৎ জনগণের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করাই তাদের প্রধান দায়িত্ব। জনগণকে অপেক্ষা করানো তো দূরে থাক, জনগণকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা এবং তাদের জীবন স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ করাই দায়িত্ব সরকারি চাকরিজীবীদের এবং এটিই তাদের সেবক হিসেবে দায়িত্ব পালনের ব্রত। অথচ সরকারি সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়, তারা জনগণের সেবক তো নয়ই বরং শোষক হয়ে দুর্নীতির আখড়া তৈরি করছে এবং তা করছে খোদ জনগণের করের টাকায়। জনগণের টাকায় এ ধরনের অপচয় জনগণকে নিশ্চিতভাবেই ব্যথিত করে এবং এই লুটপাটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী করে। এ ধরনের দুর্নীতি আসলে কী কী ধরনের ক্ষতি করছে। প্রথমত, এর ফলে পর্যাপ্ত অর্থ সংশ্লিষ্ট খাতে ব্যয় না হওয়ার কারণে হয় সেই উন্নয়ন কাজটি বাধাপ্রাপ্ত হয়, না হলে নিম্নমানের কাজ করা হয়। রাষ্ট্র এবং সরকারের প্রতি জনগণের ভরসা এবং আস্থার জায়গাটি কমে যায়। দ্বিতীয়ত, সরকারের কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা অধিক পরিমাণে দুর্নীতিমুখী হয়ে ওঠেন। আর সর্বশেষ জনগণের করের টাকার যথার্থভাবে ব্যবহার না করা এবং এর জবাবদিহিতা না থাকা কোনোভাবেই জনগণের প্রতি আমলা বা সেবকদের দায় এবং দায়িত্বের প্রকাশ ঘটে না। অন্যদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বালিশ ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে পর্দা ক্রয়ে দুর্নীতির বিষয়কে ছোট হিসেবেই দেখা হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ বড় ধরনের দুর্নীতিকে ছিঁচকে কাজ’ বলেছেন এবং আরো জানিয়েছেন যে একে হাওয়া ভবনের লুটপাটের সঙ্গে মেলানো যাবে না। সরকারের দায়িত্বশীল পদ থেকে এ ধরনের বক্তব্য একভাবে যেমন এ ধরনের দুর্নীতিগুলোকে বৈধতা দেয় অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের দুর্নীতির দিকে ঝুঁকতে উৎসাহিত করে। তারা জেনে যায় হাওয়া ভবনের দুর্নীতিই এই সরকারের কাছে দুর্নীতির একমাত্র মডেল। তাই সেটি অতিক্রম না করা পর্যন্ত দুর্নীতি চালিয়ে যাওয়া যাবে। আর এই সরকারের সময় যত দুর্নীতিই হোক না কেন সেটির একমাত্র তুলনা থাকবে হাওয়া ভবনের দুর্নীতি। আর এই কারণেই একের পর এক দুর্নীতি ঘটতে থাকে। বালিশ, পর্দা, ঢেউটিন, পানি সবই যায় দুর্নীতিতে ভেসে। এসব দুর্নীতিবাজ সেবকের বিরুদ্ধে খুব বড় ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয় না বলে দিন দিন বাড়তে থাকে এ ধরনের চিত্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাহাকার কিংবা পত্রিকার লেখনী তাদের জনগণের প্রতি দায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় না। তারা জানে তাদের খুঁটির জোর জনগণ নয়, তাদের জোর অন্য জায়গায়। তাই যাদের সেবা দেয়ার কথা, তাদের টাকা দিয়েই তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ সাজায়। আর এতে আসকারা দেন স্বয়ং মন্ত্রী এবং সরকারের দলীয় নেতারা। জনগণ এখন শুধু চোখ বন্ধ করে সেই লাখ টাকার পর্দার ইমেজটি কল্পনা করবে। সত্যি আমাদের কি কিছুই অবশিষ্ট নেই আর? জোবাইদা নাসরীন : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App