×

মুক্তচিন্তা

আসামের নাগরিকপঞ্জি নিয়ে উদ্বেগ কি আদৌ যুক্তিযুক্ত?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৮:২৭ পিএম

অনেক বাংলাদেশি নাগরিক মনে করেন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে যেভাবে এ দেশে ঠেলে দেয়া হয়েছে, একইভাবে আসামের বিপুলসংখ্যক বাংলাভাষীকে এ দেশে ঠেলে দেয়া হতে পারে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে স্থিতিশীলতা ফিরে আনতে বাংলাদেশ সব ধরনের সহায়তা করলেও বাংলাদেশকে এখন অস্থির করে তুলতে চাইছে ভারত। শুধু মুসলিম পরিচয়ের কারণে বিপুলসংখ্যক ভারতীয়ের নাগরিক অধিকার হরণ করা হয়েছে।

সম্প্রতি জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি প্রকাশিত হয়েছে আসামে। তা নিয়ে গোটা দেশের রাজনীতি উত্তপ্ত। এনআরসির পুরো কথাটি হলো National Register of Citizens- ‘জাতীয় নাগরিকপঞ্জি’ অর্থাৎ ভারতীয় নাগরিকদের নামের তালিকা। এই তালিকায় যাদের নাম থাকবে কেবল তারাই ভারতের নাগরিক বলে গণ্য হবে, আর যাদের নাম থাকবে না তারা ভারতের নাগরিক বলে গণ্য হবে না। চূড়ান্ত তালিকায় মোট আবেদনকারীদের মধ্যে ৩ কোটি ৩০ লাখের মধ্যে বাদ গেছে প্রায় ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন মানুষ। এদের ভবিষ্যৎ তবে কী? কোথায় স্থান হবে এদের? এ নিয়ে বাংলাদেশে পত্রপত্রিকায় ও সামাজিক মাধ্যমে বিস্তর হুল্লোড় হচ্ছে। কিন্তু এই উদ্বেগ কি আদৌ যুক্তিযুক্ত? বোধহয় না।

আসুন, মূলত বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে আসাম পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে দেখা যাক। ১৯৮৫ সালের ১৫ আগস্ট দিল্লিতে আসাম ‘বাঙালি তাড়াও’ আন্দোলনের প্রতিনিধি দল অল আসাম স্টুডেন্ট ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর উপস্থিতিতে আসামের রাজ্য সরকারের মুখ্য সচিব ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের গৃহ সচিবের ‘আসাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী আসামে বসবাসরত অন্য ভাষাভাষী মানুষদের তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়।

১. ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারির আগে যারা আসামে এসেছেন তারা আসামের বৈধ নাগরিক হিসেবে ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন। ২. ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত যারা আসামে এসেছেন, প্রথম ১০ বছর নাগরিকত্ব পাবেন না, তবে আসামে থাকতে পারবেন।

৩. ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পরে যারা আসামে প্রবেশ করেছেন, তারা আসামের নাগরিক নন। তারা ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন না। তাদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে। এই অংশে যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী হিসেবে আসামে গেছেন, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেননি মূলত তাদের ফেরত পাঠানোর জন্যই চলছিল এই আন্দোলন।

চুক্তি হলেও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ ছিল না। বরং অনুপ্রবেশকারীদের প্রতি নরম অবস্থান নিয়েছিল পূর্বেকার সব রাজনৈতিক নেতারা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ২০০৫ সালের ১০ মার্চ লোকসভায় বাংলাদেশি উদ্বাস্তুদের খাঁটি উদ্বাস্তু (বোনাফাইড রিফিউজি) রূপে গণ্য করে তাদের সপক্ষে বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রসংঘের (ইউএনও) বিধি অনুযায়ী উদ্বাস্তুদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে।’ আবার ২০০৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাজ্যসভায় বিরোধী নেতা হিসেবে মনমোহন সিং উপপ্রধানমন্ত্রী এল কে আদবানির উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘দেশ ভাগ হওয়ার পরও বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা নির্যাতন ভোগ করছেন। আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে পরিস্থিতির চাপে পড়ে এ দেশে আসা হতভাগ্য মানুষগুলোকে সুরক্ষা দেয়া এবং ভাগ্যহীন লোকদের নাগরিকত্ব প্রদানের প্রক্রিয়াকে অধিকতর সহজ (মোর লিবারেল) করে তোলা।’ রাজ্যসভায় ডেপুটি চেয়ারপারসন নাজমা হেপতুল্লা তখন মন্তব্য করেছিলেন, পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরাও দুর্ভোগে আছেন। তাদের বিষয়েও লক্ষ রাখা প্রয়োজন। সে সময়ের উপপ্রধানমন্ত্রী আদবানি মনমোহন সিংয়ের মতকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা সর্বদাই বলি যে, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের বলি হয়ে কোনো ব্যক্তি দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে এ দেশে এলে সে খাঁটি উদ্বাস্তু। অন্য কোনো কারণে এমনকি অর্থনৈতিক কারণে আসা বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের এক পর্যায়ভুক্ত করা যায় না।’ তা হলে হঠাৎ করে এই নাগরিকপঞ্জি নির্মাণের উদ্যোগ? ২০১৪ সালে ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে বিষয়টি ভোটের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আসাম রাজ্য বিজেপি ‘বাংলাদেশি তাড়াও’ বিষয়টি প্রধান করে নির্বাচনের মাঠে নামে। আসাম থেকে ৮০ লাখ অবৈধ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হবে, নরেন্দ্র মোদিসহ বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে তা অন্তর্ভুক্ত করেন। এই ইস্যু কাজে লাগিয়ে বিজেপি বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার পর ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে আসামের নাগরিকদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে বিজেপি সরকার।

২০০৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর দেশের উপপ্রধানমন্ত্রী এল কে আদবানি সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য ‘নাগরিকত্ব (সংশোধন) বিল-২০০৩’ পেশ করেছিলেন অত্যাচারিত হয়ে আসা বাঙালি হিন্দুদের রক্ষার জন্য। এ বছর সে বিল পাস হলো। বিলটিতে বলা হয়েছে, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বিতাড়িত হয়ে ভারতে এলে, তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেয়া হবে। ১৯৫৫-এর নাগরিকত্ব আইনের এই সংশোধনী অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে ভারতে আসা অন্য দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবে তার জন্য ছয় বছর এ দেশে বাস করতে হবে। অর্থাৎ হিন্দুদের সমস্যা এ দেশে হবে না। কিন্তু ‘ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব’ ভারতীয় সংবিধানের মূল কাঠামোর পরিপন্থী। তাই যখন ভারতের কেন্দ্রীয় বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সম্প্রতি ঢাকায় গিয়ে মন্তব্য করলেন যে এনআরসি ভারতের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ বিষয়, তখন এ কথা ধরে নেয়া যায় যে এনআরসি এ দেশের একান্ত ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হলে নিশ্চয়ই ‘বিদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত মানুষগুলোকে বিদেশে পাঠানো হবে না। তা হলে এদের নিয়ে কী করা হবে? এখনো স্পষ্ট নয়।

নাগরিকপঞ্জি প্রস্তুতির প্রয়োজনটি কেন অনুভূত হয়েছিল, তা বোঝা সহজ। কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই অনন্তকাল ধরে অন্য দেশ থেকে আগত মানুষের স্রোতকে নিজের জনসমাজের অঙ্গীভূত করা সহজ নয়। ১৯৫০ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রসংঘের ৪২৮ (৫) নম্বর প্রস্তাব মর্মে উদ্বাস্তুদের সংজ্ঞা নির্ণয় করে বলা হয়, ‘তারাই উদ্বাস্তু যারা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি বা রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে অত্যাচারিত হতে পারে, এ রকম আশঙ্কা থেকে নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে এসেছেন। সেই ব্যক্তিই শরণার্থী বা উদ্বাস্তু।’ তা হলে এরা কারা? অনুপ্রবেশকারী না উদ্বাস্তু? সত্যিকারের অনুপ্রবেশকারী হলে তাদের ‘পুশ ব্যাক’ করা কি বাস্তবে সম্ভব? কখনই নয়। তা হলে সেটা আন্তর্জাতিক ইস্যু হয়ে যাবে। সে রাস্তায় ভারতের ক্ষমতাসীন দল যাবে না। যে কথাটা বারেবারে ভারতে উচ্চারিত হয়েছে তা হলো শরণার্থী বা উদ্বাস্তুদের চাপ শুধু সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো কেন নেবে? তাদের ভাগ করে দেয়া হোক অন্যান্য রাজ্যের মধ্যে। এর আগেও এই বণ্টন হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যা, আন্দামানে পাঠানো হয়েছে।

আরেকটা সম্ভাবনা এই উদ্যোগ থেকে উঁকি দিচ্ছে তা হলো একটি পরোক্ষ হুমকি। বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা নির্যাতিত হয়ে এ দেশে এলে তাদের গ্রহণ করা হবে ঠিকই, কিন্তু এ দেশ থেকেও চিহ্নিত বাংলাদেশ থেকে আগত মুসলমানদের ভারত ঠেলে দিতে উদ্যোগী হবে। তবে এসবই রাজনৈতিক বক্তব্যের মধ্যেই সীমিত থাকবে, বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবেই বিষয়টি এমন সরলও নয়। অনেক বাংলাদেশি নাগরিক মনে করেন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে যেভাবে এ দেশে ঠেলে দেয়া হয়েছে, একইভাবে আসামের বিপুলসংখ্যক বাংলাভাষীকে এ দেশে ঠেলে দেয়া হতে পারে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে স্থিতিশীলতা ফিরে আনতে বাংলাদেশ সব ধরনের সহায়তা করলেও বাংলাদেশকে এখন অস্থির করে তুলতে চাইছে ভারত। শুধু মুসলিম পরিচয়ের কারণে বিপুলসংখ্যক ভারতীয়ের নাগরিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। এরপরেও এই বিষয় নিয়ে আলোচনার অবতারণা করার সত্যি কোনো ভিত্তি আছে কি?

অমিত গোস্বামী: কলকাতা থেকে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App