×

জাতীয়

স্লুইসগেট নয় অভিশাপ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১০:২২ এএম

স্লুইসগেট নয় অভিশাপ
ছয় দশক আগে ‘আশীর্বাদ’ হিসেবে তৈরি হলেও গত তিন দশক ধরে যশোর ও খুলনার ৩৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকার ১০ লাখ মানুষের জন্য ‘অভিশাপ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভবদহ স্লুইসগেট। বছরের বেশির ভাগ সময় পানিবন্দি হয়ে থাকতে হয় তাদের। ফলে একদিকে বাধাগ্রস্ত হয় চাষাবাদ, অন্যদিকে যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিৎসা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ঝুঁকিতে জীবনযাপন করতে হয় জলাবদ্ধতার শিকার মানুষগুলোকে। তাদের অভিযোগ, ভবদহ সমস্যার সমাধানের নামে একের পর এক প্রকল্প তৈরি করে যুগ যুগ ধরে কোটি কোটি টাকা লুটপাটই হয়েছে শুধু, ন্যূনতম কোনো উন্নতি হয়নি পরিস্থিতির। ভবদহ পাড়ের মানুষের দুঃখ লাঘবের স্থায়ী সমাধানের পথও রয়ে গেছে অজানা। তবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলছে, স্থায়ী সমাধানের জন্য ৮শ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে ২০২০ সালের বর্ষা মৌসুমের আগেই স্থায়ী সমাধান হবে। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ভবদহের সব থেকে বড় ২১ কপাটের স্লুইসগেটের ১৮টি কপাটই পলি পড়ে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। গেট সংলগ্ন শ্রী, টেকা ও মুক্তেশ্বরী নদীর অবস্থাও ভয়াবহ। জোয়ারের সময় হাঁটু পানি হলেও ভাটার সময় ওই নদী তিনটি পুরোপুরি শুকিয়ে যায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সবুজ বিপ্লবের ঘোষণা দিয়ে ১৯৬০ সালের দিকে যশোরের সদর, মনিরামপুর, কেশবপুর, অভয়নগর, খুলনার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া উপজেলার মধ্যবর্তী ভবদহ নামক স্থানে শ্রীনদীর ওপর নির্মাণ করা হয় স্লুইসগেট। তিন দশক পরই যশোর ও খুলনার মধ্যবর্তী প্রায় ৩৩০শ বর্গকিলোমিটার এলাকার ১০ লক্ষাধিক মানুষের মরণ ফাঁদে পরিণত হয় এই স্লুইসগেট। পলি জমে ওই স্লুইসগেট দিয়ে বিল কেদারিয়া, বিল বকর ও বিল আড়পাড়াসহ যশোর ও খুলনা এলাকার মোট ২৭টি বিলের পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে প্রতি বর্ষা মৌসুমে বিল তীরবর্তী আশপাশের শত শত গ্রামে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, যা থেকে নিস্তার পেতে লেগে যায় ৮ মাস। ফলে ভবদহ স্লুইসগেট চিহ্নিত হয় যশোর ও খুলনার বিরাট এলাকার দুঃখ হিসেবে। জলাবদ্ধ এলাকার সাধারণ মানুষের আন্দোলন শুরু হলে ১৯৯৪ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় যশোর-খুলনা পানি নিষ্কাশন প্রকল্প (কেজিডিআরপি) গ্রহণ করা হয়। ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২৫৭ কোটি টাকা। কিন্তু সব অর্থ ব্যয় হওয়ার পরও জলাবদ্ধতার নিরসন হয় না। অভিযোগ আছে, ওই অর্থের বড় অংশই লুটপাট হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ২০০৭ সালে ৫৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, ২০১০ সালে ৭৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা, দফায় দফায় টিআরএমসহ ছোট ছোট প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়। সর্বশেষ ভবদহ গেটের উত্তর পাশে শ্রীনদী ড্রেজিংয়ে চলতি বছর ১ কোটি ৭ লাখ টাকার কাজ হয়েছে। পানিবন্দি মানুষের দাবির মুখে বর্তমানে একটি এস্কেভেটর দিয়ে হরিহর নদীতে ড্রেজিং চলছে, যা লোক দেখানো বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। ভবদহের আশপাশের পাচকাটিয়া, পদ্মনাথপুর, নেবুগাতি, হরিদাসকাঠি, সুজাতপুর, মশিয়াহাটি, নেহালপুর, পদ্মনাথপুর, আলিপুর, হাটগাছাসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে গিয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এলাকাবাসীদের দাবি ছিল, মুক্তেশ^রী নদী খনন করা মাটি দিয়ে নদীর দুই পাড়ে বাঁধ দেয়া হোক। কিন্তু নদী খনন না করে আবাদি জমির মাটি কেটে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। তা ছাড়া ভবদহের নিচে টেকা নদী খননের নামে তিন ভাগ করে ফেলা হয়েছে। এটিও পানি নিষ্কাশনে বড় বাধা। এলাকাবাসী দাবি তুলেছেন, কেউ যেন আর সরকারি অর্থ লুটপাট করতে না পারে। বড় প্রকল্প নিয়ে যথাযথ কাজ করে ভবদহ সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা হোক। ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, আমাদের দীর্ঘ আন্দোলনের পর টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্টে (টিআরএম) প্রকল্প অনুমোদন হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ওই অঞ্চলকে জলাশয় দেখিয়ে টিআরএম বাতিল করে দেন। তিনি অভিযোগ করেন, জলাবদ্ধতা জিইয়ে রেখে সরকারি অর্থ লোপাটের কারখানায় পরিণত হয়েছে ভবদহ। ফলে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে বিরাট এলাকা পানিবন্দি হয়ে রাস্তাঘাট, ফসলাদি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে যায়। দীর্ঘসময়ের জন্য ঘটে মানবিক বিপর্যয়। তিনি বলেন, অভিশপ্ত ভবদহ স্লুইসগেট তুলে দিয়ে বাস্তবসম্মত কার্যকরী প্রকল্প গ্রহণ করা জরুরি। একই সঙ্গে এ পর্যন্ত কারা কীভাবে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছে তার তদন্ত করে জনসমক্ষে প্রকাশের দাবি করেন তিনি। ভবদহ সংগ্রাম কমিটির নেতা কমরেড গাজী হামিদ বলেন, ভবদহ স্লুইসগেট সম্পূর্ণ তুলে দিয়ে ভবদহের আশপাশের সব নদী খনন করে উজানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন, বিল কপালিয়াসহ খাল-বিলে টিআরএম চালু করে জোয়ার আধার সৃষ্টি এবং শ্রী, হরিহর, টেকা ও মুক্তেশ^রীসহ তলদেশ ভরাট হওয়া নদীর বেড থেকে মাটি কেটে পাড় বাঁধানোর ব্যবস্থা ভবদহ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হতে পারে। তিনি মনে করেন, ভবদহ স্লুইসগেটের কার্যকারিতা হারিয়ে গেছে। এই গেটের কারণে নদ-নদী ও খাল-বিলের পানি নিষ্কাশন হতে পারে না। যার কারণে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ভবদহ জলাবদ্ধতা নিরসন আন্দোলন কমিটি ও অভয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক আলহাজ এনামুল হক বাবুল বলেন, জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানে টিআরএমের বিকল্প নেই। উজানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন এবং বিল কপালিয়াসহ খাল-বিলে টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) চালু করতে হবে। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ঘোষিত দাবিগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা না হলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন, রাজপথ-রেলপথ অবরোধ, অনশনসহ কঠোর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হতদরিদ্র ও পানিবন্দি অসহায় ভবদহবাসীর ভাগ্যে ফিরিয়ে আনা হবে। প্রয়োজনে রক্ত দিয়ে হলেও দাবি বাস্তবায়ন করা হবে। এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার প্রধান প্রকৌশলী মো. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ভবদহ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য ৮শ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। চলতি সপ্তাহে এই প্রকল্পটি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। প্রকল্পটি পাস হলে আগামী ২০২০ সালের বর্ষা মৌসুমের আগেই ভবদহ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App