×

সাময়িকী

কথাশিল্পী নাজমা জেসমিন চৌধুরী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৬:৪৮ পিএম

কথাশিল্পী নাজমা জেসমিন চৌধুরী

নাজমা জেসমিন চৌধুরীর প্রয়াণের দুই যুগেরও অধিক কাল অতিক্রান্ত হলো। ২৯ বছর আগে, ১৯৮৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর একজন সমগ্র মানুষ, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার এবং শিশুতোষ নাট্যকার-লেখক আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ২৯ বছর অতিক্রান্ত হলো, কিন্তু তাঁর জায়গায় তো কেউ দাঁড়াল না। তাঁর অভাব থেকেই গেল। নাজমা আপার সঙ্গে আমার পরিচয় গত শতকের সাতের দশকের গোড়ায়; আমাদের সবার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর স্ত্রী হিসেবে। সদাহাস্য, বিনয়ী মানুষ। আমরা তখন ছুটছি তীব্র গতিতে সদ্য স্বাধীন দেশে। জীর্ণ-পুরনোকে ছুড়ে ফেলে নতুন কিছু সৃষ্টির লক্ষ্যে। ভুল হচ্ছে, তবু নতুন কিছু করা চাই। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, শিল্পকলা সর্বক্ষেত্রে এক নবউত্থানের সম্ভাবনা। কিন্তু রাজনীতি হঠাৎ ভয়াবহ সংকটে নিপতিত হলো। একদিকে উগ্র জাতীয়তাবাদ, অন্যদিকে তথাকথিত কিছু বাম সংগঠনের হঠকারী তৎপরতায় দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি। এর মধ্যে ’৭৫-এর মধ্য আগস্টে সংঘটিত রক্তাক্ত অধ্যায় এবং সামরিক শাসন দেশকে হঠাৎ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে কাক্সিক্ষত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত করল। তারপরও নাটক-কবিতা-চিত্রকলা-উপন্যাস অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে শিল্পকলা ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া গণমানুষের রায় এবং স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা অব্যাহত রাখল। এই যাত্রাপথে আমরা আবার সাক্ষাৎ পেলাম নাজমা জেসমিন চৌধুরীর। অন্য এক নাজমা আপা। সংগঠক এবং সৃষ্টিশীল একজন মানুষ। তিনিও আমাদের মতো ভাঙাগড়ার মানুষ। ১৯৭৬ সালে ঢাকা থিয়েটার সিদ্ধান্ত নেয় শিশু-কিশোরদের নাট্যদল গড়ার। মুস্তাফা মজিদকে দায়িত্ব দেয়া হলো। প্রয়াত বেগম মমতাজ হোসেনসহ কয়েকজন তরুণকে সঙ্গে নিয়ে মুস্তাফা মজিদ নাট্যদল ‘ঢাকা শিশুনাট্যম’ সংগঠিত করে নাটক মঞ্চায়ন শুরু করলেন। কবি হাবিবুর রহমান রচিত ‘আলোর ফুল’ এবং ‘মায়াকানন’ নাটক দুটির মঞ্চায়নের পর অরুণ চৌধুরীর নাট্যরূপে সুকুমার রায়ের হযবরল তৃতীয় প্রযোজনা। নাজমা আপা হযবরল নাটক দেখতে এসে আমাদের নাট্য-আন্দোলনে জড়িয়ে গেলেন। যদিও এর মধ্যে নাজমা আপা বাংলাদেশ টেলিভিশন আয়োজিত জাতীয়ভিত্তিক নাট্যরচনা প্রতিযোগিতায় তাঁর রচিত নাটক প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। কিন্তু টেলিভিশন নয়, মঞ্চই হচ্ছে নাটকের মূল ভূমি এ ধারণা তাঁর বিশ্বাসের অন্তর্গত। তাই তিনি মঞ্চের জন্যই প্রথম নাটক লিখলেন ১৯৭৮ সালে ‘আলোটা জ্বালো’; মঞ্চায়ন করল ঢাকা শিশুনাট্যম। নির্দেশনায় ছিলেন মুস্তাফা মজিদ। ১৯৭৮ সালেই তিনি সংগঠিত করলেন ঢাকা লিটল থিয়েটার। মযহারুল ইসলাম বাবলা ও মোরশেদুল ইসলাম ঢাকা লিটল থিয়েটার সংগঠনে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবে দলের প্রাণ ছিলেন নাজমা জেসমিন চৌধুরী। ঢাকা থিয়েটারের নামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে এবং একটি সাংগঠনিক সম্পর্ক বজায় রাখতে তিনি এ নামটি বেছে নিলেন। ঢাকা লিটল থিয়েটারে যে নাজমা আপাকে পেলাম, তিনি এক ভিন্ন মানুষ। শিক্ষক নন, বন্ধু সবার, বন্ধু ছোট-বড় সবারই। তাঁর প্রাণোচ্ছল উপস্থিতি শিশু থেকে প্রৌঢ় সবাইকে উজ্জীবিত করে রাখত সর্বক্ষণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের আবাসের নাজমা আপার বাসার বসার ঘরটি ছিল বেশ বড়। বারান্দা এবং শোয়ার ঘরও বড়। আমাদের লিটল থিয়েটারের মহড়া শুরু হতো তাঁর বসার ঘরে এবং ক্রমশ তা ছড়িয়ে পড়ত বারান্দা হয়ে শোয়ার ঘর পর্যন্ত। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার নীরবে বাসা থেকে বের হয়ে বাইরে হাঁটতে চলে যেতেন; যেন আমাদের অসুবিধা না হয়। নাজমা আপা মহড়ায় অংশ নিচ্ছেন নাট্যকার হিসেবে, আবার এক ফাঁকে দৌড়ে রান্নাঘরে ঢুকে চা-নাশতা বানাতেন। শিশু-কিশোরদের জন্য আলাদা খাওয়া। সব এক হাতে করতেন। কখনো বিরক্ত হতে দেখিনি। উপরন্তু দেখেছি তাঁর প্রচণ্ড উৎসাহ-উদ্দীপনা! ঢাকা লিটল থিয়েটারের প্রথম নাটক কী হবে, কে লিখবেন? সবাই বললাম, ‘নাজমা আপা, আপনি লিখুন।’ তিনি স্বভাবসিদ্ধ বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘আমি পারব?’ সবার চাপাচাপিতে রাজি হলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘তাসের দেশ’ ছোটদের জন্য রূপান্তরের কাজে হাত দিলেন। নাট্যপ্রয়োগ নিয়ে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হয়েছে। প্রায়ই বসেছি তাঁর সঙ্গে। কারিগরি দিকগুলো বুঝে তিনি নাটক লেখার পক্ষপাতী। তাই প্রায়ই আলোচনা হতো। তিনি নিরহঙ্কার নিবিষ্ট মনে আমার কথা শুনতেন এবং পরের সপ্তাহে আবার বসতেন। এভাবেই রূপান্তর করলেন কবিগুরুর ‘তাসের দেশ’ ছোটদের জন্য। মযহারুল ইসলাম বাবলা ও মোরশেদুল ইসলাম যৌথভাবে নির্দেশনা দিলেন ‘তাসের দেশ’ নাটকটি। কিন্তু সবকিছু সামলানোর কাজটি করেছেন নাজমা আপা পেছন থেকে। আশাতীত সাফল্য ও সাড়া পেল নাটকটি। এ যাবৎ কালের সর্বাধিক মঞ্চস্থ নাটক ‘তাসের দেশ’। প্রথম প্রদর্শনী শেষে আনন্দে শিশুদের সঙ্গে তিনিও যেন শিশু হয়ে উঠলেন। নাজমা জেসমিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর প্রকাশিত গল্প ‘তোমাকে অভিনন্দন দীপা’ পড়ে চমকে উঠতে হয়। দীর্ঘ ৩০ বছর সংসার করা শিক্ষিত গৃহিণী সালমা যখন তার মেয়েকে ধনী নিপীড়ক স্বামীর কাছে ফিরে যেতে বারণ করে, এমনকি ৩০ বছরের সঙ্গী স্বামী ওয়াহেদ আলীর শয্যায় বসে স্বামী পরিত্যাগী নারী অধিকারে নিবেদিত দীপাকে গভীর রাতে অভিনন্দন জানায়, তখন আমাদের জানা হয়ে যায়, এ অন্য এক লেখক, অন্য এক নাজমা জেসমিন চৌধুরী। তিনি শিশুতোষ লেখক বা একজন ঔপন্যাসিকই নন, তিনি একজন মুক্ত ও স্বাধীন বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার দৃঢ়প্রত্যয়ী রাজনীতি-সচেতন কথাশিল্পী। না, শুধু এ গল্পেই নয়, তাঁর বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস, নাটকে মুক্তির কথা এসেছে ঘুরেফিরে। এ জায়গায় নাজমা জেসমিন চৌধুরী অন্যদের থেকে আলাদা। তিনি শিশুদের গড়তে চেয়েছিলেন এক নতুন সমাজ গড়ার মানুষ হিসেবে। শিশুদের জন্য লিখেছেন তিনি বিরামহীন। সংগঠিত করেছেন শিশু-কিশোরদের মঞ্চনাটক। প্রাত্যহিক জীবন এবং মঞ্চশিল্পকে আলাদা করেননি কোনোদিন। চলেছেন একই তাল-লয়-সুরে। পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ থেকে তাঁর অকাল প্রস্থানের পর আর কাউকে দেখিনি এভাবে জীবন আর শিল্পকে একই সরল রেখায় ঐক্য সাধনে। তাই লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, তাঁর পথে বা জায়গায় কেউ তো দাঁড়াল না!

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App