×

জাতীয়

সড়কে দুঃসহ শব্দসন্ত্রাস হাইড্রোলিক হর্ন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১২:৪০ পিএম

সড়কে দুঃসহ শব্দসন্ত্রাস হাইড্রোলিক হর্ন
সড়কে দুঃসহ শব্দসন্ত্রাস হাইড্রোলিক হর্ন
শব্দদূষণ সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টিতে চার বছর ধরে ‘হর্ন হুদাই বাজায় ভুদাই’ ক্যাম্পেইন করছেন মমিনুর রহমান রয়েল নামের এক তরুণ। তিনি জানান, একদিন বহুকষ্টে আমার মেয়েকে ঘুম পাড়াই। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ হর্নের বিকট শব্দে মেয়েটি জেগে যায়। এরপর কোনো শব্দ শুনলেই মেয়েটি ভয়ে-আতঙ্কে কাঁপতে থাকে। অন্য শিশুদের কথা ভেবে সেই থেকে রয়েল শক্তভাবে ক্যাম্পেইনে নামেন। প্রখ্যাত চিকিৎসক প্রাণ গোপাল দত্ত জানিয়েছেন, বছর কয়েক আগে চট্টগ্রাম মেডিকেলে আকস্মিক উচ্চশব্দে চমকে ওঠার কারণে সময়ের আগেই শিশু জন্ম দেয় এক মা। ওই ঘটনায় সেখানে উচ্চশব্দ প্রতিরোধে আইনই করা হয়। শব্দদূষণ রোধে পুলিশ গত ১৮ এপ্রিল ঝিনাইদহে অভিযানে নেমে অর্ধশতাধিক হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ করে। এ ঘটনার দুদিন পরই হর্নের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে মোটরসাইকেল থেকে রাস্তায় পড়ে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারান ঝিনাইদহ বঙ্গবন্ধু কলেজের শিক্ষক সানজিদা সুমি (৩২)। এর কদিন পর রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে একটি কারের চালক উচ্চশব্দে হর্ন বাজালে পাশে থাকা এক শিশু দুকানে হাত দিয়ে সড়কে বসে পড়ে। পাশেই রিকশাযাত্রী এক সংবাদকর্মী হর্ন বাজাতে নিষেধ করলে চালক তাকে পিষে মারার হুমকি দিয়ে পালিয়ে যায়। রাজধানীসহ বাইরের জেলাগুলোতে এভাবেই মূর্তমান আতঙ্ক হয়ে উঠেছে যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্ন (উচ্চমাত্রার শব্দ সৃষ্টির যন্ত্র)। অসহনীয় মাত্রার এ শব্দদূষণে বধির ও শ্রবণশক্তি নষ্টসহ নানা স্বাস্থ্য জটিলতার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও আমেরিকান স্পিচ এন্ড হেয়ারিং এসোসিয়েশনের (আশা) মতে, শ্রবণযোগ্য শব্দের সহনীয় মাত্রা সর্বোচ্চ ৪০ ডেসিবেল। আর হাইড্রোলিক হর্ন সেখানে ১২০ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ ছড়ায়। এর স্থিতি ৯ সেকেন্ডের বেশি হলেই ক্ষতিকর। ডা. প্রাণ গোপালের মতে, ৭১-৯০ ডেসিবেল শব্দে শ্রবণক্ষমতা নষ্ট হলে তা ফেরানো যায় না। এমন অবস্থায় শ্রবণযন্ত্রও কাজ করে না। অথচ রাজধানীতে শব্দের মাত্রা ১৩৫ ডেসিবেলেরও বেশি। ঢাকা মহানগর পুলিশ ২০০৭ সালে রাজধানীর বিমানবন্দর, মিরপুর, গুলশান, ধানমন্ডিসহ বেশ কিছু এলাকার সড়কে হর্ন বাজানো পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছিল। হর্ন জব্দ ও জরিমানাও করা হয়েছিল। তবে কিছুদিন পরই তা থেমে যায়। দীর্ঘদিন পর ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট রাজধানীতে প্রাণঘাতী হর্ন বন্ধে নির্দেশনা চেয়ে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম হাইকোর্টে রিট করেন আইনজীবী মুনজিল মোরশেদ। পরদিন হাইকোর্ট ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধের নির্দেশনা জারি করেন। সেই সঙ্গে আমদানি বন্ধ ও বাজারে থাকা হর্ন সাতদিনের মধ্যে জব্দ ও তিনদিনের মধ্যে হাইড্রোলিক হর্ন বাজানো গাড়ি জব্দ করতে বলা হয়। এর প্রায় চার মাস পর আইনজীবী মুনজিল মোর্শেদ হাইড্রোলিক হর্নের উৎপাদন বন্ধেও হাইকোর্টের নির্দেশনা চান। আদেশে হাইকোর্ট আবাসিক ও ভিআইপি এলাকায় রাত ১০টার পর সব হর্ন বাজানো বন্ধ ও ২০ কিলোমিটার বেশি গতিতে গাড়ি চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন। একই নির্দেশনায়, কাকরাইল-মগবাজার হয়ে ময়মনসিংহ রোড, শাহবাগ-সায়েন্স ল্যাবরেটরি রোড হয়ে গাবতলী পর্যন্ত হর্ন তদারকি টিম গঠন করতে বলা হয়। এসব নির্দেশনার পর তৎপর হয়ে ওঠা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কয়েক দফায় অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু গাড়ি জব্দ ও কয়েক হাজার হাইড্রোলিক হর্ন খুলে নষ্ট করে। তবে গত দেড় বছরে হর্ন বন্ধে আর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ময়মনসিংহ রোড কিংবা গাবতলী পর্যন্ত সড়কে কোনো তদারকি টিমও নেই। রাত ১০টার পর এসব সড়কে গতি কমানো তো দূরের কথা দানবের মতো বিকট শব্দে একটানা হর্ন বাজিয়ে রাতের নীরবতা ভেঙে ঝড়ের গতিতে চলতে থাকে ট্রাকসহ অসংখ্য যানবাহন। এতে সারাদিনের কর্মক্লান্ত মানুষের ঘুম নষ্ট হয়ে শারীরিক নানা জটিলতার শিকার হচ্ছেন। এর ওপর দিনের বেলায় মূল সড়কসহ অলিগলি পর্যন্ত শত শত গাড়ির হাইড্রোলিক হর্নে অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। চালকদের যুক্তি, হর্নের শব্দ কম হলে পথচারীরা শুনতে পান না। কিন্তু হাইড্রোলিক হর্ন একবার চাপলেই তারা রাস্তা ছেড়ে দেন। মালিকরা তাই গাড়িতে উচ্চমাত্রার শব্দের হর্র্ন-ই লাগান। আর পথচারীদের অভিযোগ, কোনো কারণ ছাড়াই বিকট হর্ন বাজিয়ে চলে চালকরা। কানে তালা লেগে গেলেও তারা তোয়াক্কা করে না। মানবশরীরে শব্দদূষণের প্রতিক্রিয়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিভাগের অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু বলেন, সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ মানুষকে মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ করে ফেলে। ক্রমাগত শব্দদূষণে কানের টিস্যুগুলো বিকল হতে থাকলে স্বাভাবিক শব্দ শোনা যায় না। একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, শব্দদূষণের এ ভয়াবহতা চলতে থাকলে ২০২১ সালের মধ্যে রাজধানীর দেড় কোটি বাসিন্দার মধ্যে ৫০ লাখই শ্রবণশক্তি হারাবে। এক পর্যায়ে পুরোপুরি বধির হয়ে যাবে। ১৯৮৩ সালের মোটরযান আইন অনুযায়ী হাইড্রোলিক হর্ন বাজানোয় সর্বোচ্চ যে ১০০ টাকা জরিমানা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা বাড়ানোর দাবি তুলেছেন পরিবেশবাদীরা। তারা বলছেন, এ জন্য বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগসহ শাস্তির মাত্রাও বাড়াতে হবে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান ভোরের কাগজকে বলেন, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তৎপরতা আরো জোরদার করা না হলে উচ্চমাত্রার শব্দ সৃষ্টিকারী হর্নের ব্যবহার বন্ধ হবে না। তিনি এ জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের নেতৃত্বে পুলিশ, বিআরটিএ ও অংশীজনদের নিয়ে সমন্বিত রোডম্যাপ তৈরির পরামর্শ দেন। এদিকে, হাইকোর্টের নির্দেশনার বাস্তবায়ন না থাকায় গত দেড় বছরে হাইড্রোলিক হর্নের উৎপাদন, আমদানি যেমন বেড়েছে তেমনি অবাধে বিক্রিও হচ্ছে। রাজধানীর বাংলামোটর, ইস্কাটন, বিজয়নগর, নবাবপুর, ধোলাইখাল এলাকায় মোটর পার্টসের দোকানগুলোতে সহজেই পাওয়া যাচ্ছে নিষিদ্ধ হাইড্রোলিক হর্ন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ক্রেতাদের চাহিদামতো পাঁচশ থেকে দেড় হাজার টাকায় অবাধে বিক্রি হচ্ছে এসব হর্ন। পুলিশের নজরদারির বিষয়ে জানতে চাইলে কয়েকজন বিক্রেতা বলেন, দুয়েক একবার তারা এসেছিল। হাইড্রোলিক হর্ন বিক্রি করতে নিষেধ করেছে। তবে তাদের প্রশ্ন, ক্রেতারা চাইলে আমাদের করার কী আছে? জানতে চাইলে ঢাকা মোটর পার্টস ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি সাহিদুর রহমান সাহিদ ভোরের কাগজকে বলেন, পুলিশ আর র‌্যাবের গাড়িতেই তো অবাধে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার হচ্ছে। তারা বাধা দিলে তো আমরা হাইড্রোলিক হর্ন বিক্রি করতে পারব না। তবে তিনি হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার কথা জানেন না বলে স্বীকার করেন। যদিও বিআরটিএর রোড সেফটি শাখার পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানীর জোর দাবি, হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। একই রকম দাবি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক উত্তর ও দক্ষিণের যুগ্ম কমিনশনার মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ও মফিজ উদ্দিন আহম্মেদের। লোকবল সংকটের বিষয়টি উল্লেখ করে তারা ভোরের কাগজকে বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার ও উৎপাদন বন্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। তবে পুরোপুরি বন্ধ করতে সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App