×

মুক্তচিন্তা

‘এ বোঝা আমার নামাও, বন্ধু নামাও’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৮:৫৫ পিএম

প্রথম বাধা স্বয়ং মিয়ানমার। পরোক্ষ বাধা চীন- অর্থাৎ মিয়ানমারে চীনের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক স্বার্থ। সর্বোপরি মিয়ানমার সর্বতোভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল। কাজেই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীন তুরুপের তাস। অন্য বিদেশি শক্তি রঙের তাস। তাদের সহায়তা ছাড়া বাংলাদেশ কীভাবে একক চেষ্টায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সমস্যার সমাধান করবে? তবে পরিস্থিতি বিচারে যা বোঝা যাচ্ছে তা হলো, আমাদের পূর্ব আশঙ্কাই ঠিক। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দীর্ঘ রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে ঝুলে থাকার সম্ভাবনাই বেশি।

শিরোনামটি রাবীন্দ্রিক ভাষ্যে বলা হলেও এর বাস্তবতা বড় অ্যান্টি-রোমান্টিক। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা সত্যি কক্সবাজার থেকে রামু পর্যন্ত বাংলাদেশি সমাজের জন্য সমস্যা তৈরি করে চলেছে। শুরুতে মানবিকবোধে লাখ লাখ বাস্তুত্যাগী রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছিল বাংলাদেশ। তখনই এক লেখায় ঘটনার আন্তর্জাতিক জটিলতা নিয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলাম। তখন আমার কিছু সংখ্যক বামপন্থি নিকটজন ওই লেখার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছিলেন। আজ আমার প্রশ্ন এখন তারা কী বলবেন?

কী বলবেন ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের সৃষ্ট সমস্যা নিয়ে, আন্তর্জাতিক শক্তির ভূমিকা নিয়ে, বিশেষভাবে চীনের ভূমিকা নিয়ে, মিত্র দেশ ভারতের ভূমিকা নিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের নীরবতা নিয়ে। দ্রুত প্রজননশীল রোহিঙ্গা জনসংখ্যার বাংলাদেশের ভবিষ্যতের ওপর সম্ভাব্য চাপ সৃষ্টি নিয়ে। বিহারি-মোহাজেরদের সৃষ্ট করাচির সমস্যার উদাহরণ না হয় না-ই টানি।

সম্প্রতি সৃষ্ট রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সংবাদপত্রগুলোর খবর শিরোনাম, সম্পাদকীয় নিবন্ধ, উপসম্পাদকীয় নিবন্ধের আলোচনার দিকে তাকালে বোঝা যায় গণমাধ্যমের এ বিষয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার দিকটি। আপাতত নিরপেক্ষ একটি দৈনিকপত্রেও দেখছি একই ধরনের প্রতিক্রিয়া।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সংবাদে যে রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে যেতে অসম্মতি প্রকাশ করেছে। অবশ্য তাদের দিক থেকে যুক্তিও আছে। তারা তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চায়। আর আমাদের কথা হলো, এ নিরাপত্তা একমাত্র দিতে পারে চীন, তার ওপর নির্ভরশীল মিয়ানমারের ওপর সত্যিকার চাপ সৃষ্টি করে।

ইতোপূর্বে চীন বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছিল রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট সময়ের ভূমিকা নিয়ে, তা কাজে আসেনি রোহিঙ্গাদের অসম্মতিতে। সম্প্রতি ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বাংলাদেশ সফরে এসে এ বিষয়ে আমাদের আশ^স্ত করেছেন তাদের পক্ষ থেকে ইতিবাচক ভূমিকা সম্পর্কে। কিন্তু হাল ধরবে কে?

দিন যাচ্ছে, মাস যাচ্ছে, বছর যাচ্ছে, মিয়ানমারের পক্ষ থেকে নানান ইতিবাচক কথাবার্তা- সবই ভেস্তে যাচ্ছে। বাংলাদেশি সমাজে রোহিঙ্গা সমস্যা কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, একের পর এক ঘটনায়। দু-চারটে সংবাদ শিরোনাম আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে। যেমন- ‘কক্সবাজারে উদ্বাস্তু হওয়ার আতঙ্কে স্থানীয়রা’। আমার মতে, আপাত বিচারে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যার ইঙ্গিত বহন করছে। ইঙ্গিত ভবিষ্যৎ সামাজিক সংঘাতের। বেশ কিছুদিন আগে এমন কয়েকটি খবর পড়েছিলাম উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরকে কেন্দ্র করে স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়ার। বাংলাদেশ সরকারকে সচেতন হওয়ার জন্য এ জাতীয় সংবাদগুলো যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

অন্য একটি সংবাদ শিরোনামে দেখছি আমাদের ইতোপূর্বেকার আশঙ্কার প্রতিফলন : ‘চীনের ওপর কতটা ভরসা করতে পারে বাংলাদেশ’ (২৫ আগস্ট, ২০১৯)। বিবিসি বাংলার এ প্রতিবেদনটি তথ্যে-বক্তব্যে যথেষ্ট বস্তুনিষ্ঠ। আমরা ইতোপূর্বে বলেছি মিয়ানমারে রয়েছে চীনের প্রভূত ভূ-সাগর ও রাজনৈতিক স্বার্থের গুরুত্ব। সেসব জলাঞ্জলি দিয়ে চীন মিয়ানমারের অমতে রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশকে কতটা সাহায্য করবে বা করতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না যে, চীন রাখাইন এলাকায় সমুদ্র বন্দরসহ একাধিক ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগ করে চলেছে। সেখানে কোনো প্রকার অশান্তি, অস্থিরতা তার কাম্য হওয়ার কথা নয়। রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি যে পুরোপুরি সামাজিক শান্তির আবহ নিশ্চিত রাখবে এমন কোনো নিশ্চয়তা কে দিতে পারে তাদের? চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক শিল্পোদ্যোগ সম্পর্ক বিচার ব্যাখ্যা করে সৈয়দ মাহমুদ আলী একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন এই বলে যে, ‘রোহিঙ্গা সমস্যা সামলে দিতে বাংলাদেশকে আরো বাস্তবসম্মত নীতিমালা গ্রহণ করার পাশাপাশি স্বনির্ভর হয়ে ওঠা প্রয়োজন। ... অন্য দেশের ওপর অতিনির্ভরশীলতা কমাতে বাংলাদেশের উচিত হবে অর্থনৈতিক নীতিমালা শক্তিশালী করা। দেশের অভ্যন্তরে সমর্থনের যে ঘাঁটি রয়েছে সেটা গড়ে তোলা।’

তার এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের সুযোগ নেই। আমার বহু লেখায় ইতোপূর্বে পরনির্ভরতা পরিহার করে স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টার কথা বলেছি। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটা বহুদেশমাত্রিক, বহু স্বার্থ নির্ভর। শুধুমাত্র নিছক শরণার্থী সমস্যা নয়। যেমন আমরা দেখেছি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে। তাই সেক্ষেত্রে যুদ্ধশেষে শরণার্থীরা ভারত ছেড়ে স্বদেশ বাংলাদেশে ফিরে এসেছে কোনো সমস্যা তৈরি না করে।

কিন্তু এখানেই খোদ মিয়ানমারই তো সমস্যা। তারা একের পর এক মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে, কথা দিয়ে কথা না রেখে বাংলাদেশকে প্রতারিত করছে। আর এ মিয়ানমারে রয়েছে চীনসহ একাধিক বিশ^রাষ্ট্রের স্বার্থ। কাজেই এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একক চেষ্টায় অর্থাৎ বাংলাদেশ নিজে এ সমস্যার সমাধান করতে পারবে না।

প্রথম বাধা স্বয়ং মিয়ানমার। পরোক্ষ বাধা চীন- অর্থাৎ মিয়ানমারে চীনের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক স্বার্থ। সর্বোপরি মিয়ানমার সর্বতোভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল। কাজেই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীন তুরুপের তাস। অন্য বিদেশি শক্তি রঙের তাস। তাদের সহায়তা ছাড়া বাংলাদেশ কীভাবে একক চেষ্টায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সমস্যার সমাধান করবে?

এসব কারণেই আমরা দেখছি সংবাদপত্রে আরো শিরোনাম : ‘রোহিঙ্গাদের ফেরা নিয়ে মিয়ানমারের নাটক।’ অনুশিরোনাম : ‘প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা’, ‘এখন উল্টো বাংলাদেশকে দোষ দিচ্ছে মিয়ানমার’। এ ক্ষেত্রে আমরা প্রতিবেদনের বিশদ বিবরণ উদ্ধৃত করছি না। কারণ এসব ঘটনা, সমস্যা কম-বেশি বহু আলোচিত।

তবে পরিস্থিতি বিচারে যা বোঝা যাচ্ছে তা হলো, আমাদের পূর্ব আশঙ্কাই ঠিক। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দীর্ঘ রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে ঝুলে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। ইতোমধ্যে নাফ নদে অনেক পানি বয়ে যাবে। রাখাইন রাজ্যের সামাজিক দৃশ্যপট ইতোমধ্যে তাৎপর্যপূর্ণভাবে পাল্টে যাবে যাতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সেখানে ফিরে যেতে না পারে।

দুই. সে জন্যই আমরা এ নিবন্ধের শিরোনামে বাংলাদেশের কাঁধ থেকে রোহিঙ্গা বোঝা নামাতে জাতিসংঘকে উদ্দেশ্য করে কাব্য পঙ্ক্তিটি উদ্ধৃত করেছিলাম। ভরসা যেমন চীন, ভরসা তেমন জাতিসংঘ, বিশেষ করে তাদের নিরাপত্তা পরিষদ। সেইসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাদের তাৎপর্যপূর্ণ নীরবতার ভূমিকাটিকে সপক্ষে আনা বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতার পক্ষে জরুরি।

বড় কথা বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা সংকটের গুরুত্ব সম্পর্কে আরো সচেতন হওয়া খুবই জরুরি। বিশেষ করে রোহিঙ্গা উপস্থিতির সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অভিঘাতের নেতিবাচক গুরুত্বের কারণে। ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য গলার কাঁটা হয়ে উঠতে পারে।

তাই বাংলাদেশের এখন লক্ষ্য হওয়া দরকার তাদের সবগুলো ঘনিষ্ঠ দেশকে একটি অর্জনে ঐকমত্যে নিয়ে আসা আর তা হলো রাখাইনে প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গাদের জানমাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সে নিশ্চয়তা অর্জিত না হলে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে চাইবে না, বাংলাদেশের সমস্যা-সংকটেরও সমাধান হবে না। এ বিষয়টিই এখন সুস্পষ্টভাবে বাংলাদেশের সব তৎপরতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে হবে।

এখন বাংলাদেশকে ভাবতে হবে, কীভাবে, কোন পথে তারা এ সমস্যা সমাধানের নীতিমালা প্রণয়ন করবেন। আমরা আমাদের বুদ্ধি বিবেচনামাফিক আভাস-ইঙ্গিত, এমনকি সুস্পষ্ট বক্তব্যও উত্থাপন করেছি বাংলাদেশের সামাজিক সুস্থতার স্বার্থ বিবেচনায়। শেষ কথা, যেভাবে হোক, যতদিনে হোক রোহিঙ্গা বোঝা বাংলাদেশের কাঁধ থেকে নামাতেই হবে। না হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক ভবিষ্যতের জন্য সমূহ বিপদ।

আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App