×

মুক্তচিন্তা

ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের আদর্শ ও প্রত্যয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৮:৫৯ পিএম

ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের আদর্শ ও প্রত্যয়

ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম

সব সৃজনশীলতায় এমন একটা ভাবদর্শন থাকে, যা অয়োময় প্রত্যয় ও প্রতীতির নেপথ্য নায়ক হিসেবে অনির্বচনীয় ভূমিকা পালন করে। সেই বলিষ্ঠ বোধ ও বিশ্বাস, সেই অনুভব-অনুপ্রেরণা, সেই সুকৃতির সুষমা ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে আর ব্যষ্টি হয় সমষ্টির শক্তি। যে মহৎ কর্মোদ্যোগ দেশ ও জাতির সীমানা পেরিয়ে মানব সমাজ ও সভ্যতার জন্য অনুপম আস্থা ও সেবার আদর্শ হিসেবে প্রতিভাত হয় তা আবার নিজেই একটা ভাবাদর্শ নির্মাণ করে থাকে। জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম (জন্ম ৩১ ডিসেম্বর ১৯১১-মৃত্যু ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯) এমন এক ভাবাদর্শের সাধক এবং উদগাতা, যা বিশ-একুশ শতকের বাংলাদেশে এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানবভাগ্যে আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচ্য। ৬ সেপ্টেম্বর জাতীয় অধ্যাপক ইব্রাহিমের মৃত্যু দিবসকে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি ডায়াবেটিক সেবা দিবস হিসেবে পালন করে। মানবতাবোধ দ্বারা তাড়িত গতিশীল জীবনের অধিকারী জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম ছিলেন বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে এমন একজন প্রতিভাধর ব্যক্তি যার মধ্যে নিহিত ছিল বহুমুখী মানবীয় গুণের সমাহার। তিনি আজীবন নিজেকে জড়িত রেখেছিলেন মানব কল্যাণমূলক বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে। একই সঙ্গে স্বপ্ন দেখা ও সর্বাঙ্গসুন্দরভাবে সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার মোহনীয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম। মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত এই মহানুভব মানুষটি মানবতার মহান উচ্চ আদর্শের প্রতি ছিলেন আজীবন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং নিবেদিতচিত্ত। বাস্তবতায় দেখা যায় অনেক সময় এই জাতীয় মানুষের মধ্যে বাস্তববুদ্ধির কিছুটা ঘাটতি থাকে, যার ফলে তাদের আদর্শবাদ জাগতিক উপযোগিতার ক্ষেত্রে আপাত সাংঘর্ষিকতায় তারা হয়তো কাক্সিক্ষত কোনো অবদান প্রত্যক্ষভাবে রাখতে পারেন না। বিস্ময়ের ব্যাপার ডা. ইব্রাহিম ছিলেন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি সেবার যে উচ্চ আদর্শ তার সহকর্মীদের মধ্যে প্রতিনিয়ত সঞ্চারিত করতে সচেষ্ট ছিলেন, তা ছিল বাস্ততার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। ‘শুধু উপদেশ, আদেশ, নির্দেশ নয় আপন দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি তার স্বপ্ন, কল্পনা ও আদর্শকে বাস্তব রূপ দিতেন। কর্তব্য পালনে, শৃঙ্খলা রক্ষায়, ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করায়, সময় মেনে চলায়, স্নেহ-মমতা ও সহানুভূতিতে তার মতো বড় মাপের মানুষ যে কোনো দেশে, যে কোনো সমাজে বিরল। বস্তুত অদম্য প্রাণশক্তি, ইস্পাত কঠিন সংকল্প এবং সাংগঠনিক বিচক্ষণতার সঙ্গে শ্রম ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যোগ্যতার মহামিলন ঘটেছিল, একসঙ্গে এই বহুমুখী প্রতিভাশালী ব্যক্তিত্বের বলয়ে। যে দেশ ও সমাজে সীমাহীন সার্বিক (অর্থনৈতিক, চিন্তা-চেতনার, সহনশীলতার, সাধনার) দারিদ্র্যের কারণে বড় কিছু করা যায় না, মহৎ কিছু গড়ে ওঠে না এবং যেখানে চিন্তার দৈন্যতা, উদ্যম-উদ্যোগের অভাব এবং ত্যাগ স্বীকারের অনীহা অন্যতম প্রতিবন্ধকতা সে দেশে জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম প্রমাণ করে দিয়েছেন উদ্দেশ্য যদি মহৎ হয়, লক্ষ্য যদি স্থির থাকে, প্রচেষ্টা যদি আন্তরিক হয়, তবে স্বল্পোন্নত দেশেও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি তথা বারডেমের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়। ১৯৫৬ সালে তার প্রতিষ্ঠিত ডায়াবেটিস চিকিৎসাকেন্দ্রের প্রথম বছরে মাত্র ৩৯ জন রোগীর চিকিৎসা করা সম্ভব হয়েছিল। সেখানে এখন শুধু বারডেমই চিকিৎসাধীন নিবন্ধিত রোগীর সংখ্যা পাঁচ লাখের কাছাকাছি। শুধু ঢাকা শহর এবং এর উপকণ্ঠে নয়, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ডায়াবেটিস চিকিৎসাকেন্দ্র আজ দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সততা থাকলে অঙ্কুর কি করে মহা মহিরুহের রূপ লাভ করতে পারে, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠান শাহবাগের বারডেম এটির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বারডেম এখন শুধু দেশে নয়, বিদেশেও বিস্ময়করভাবে সমাদৃত, এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক এর একটি সহযোগী কেন্দ্র (Collaborating Centre) হিসেবে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন বাংলাদেশের ডায়াবেটিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাকে বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিক চিকিৎসার মডেল বা অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে গণ্য করে। আর ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসার সঙ্গে আমেরিকার জসলিন, ইংল্যান্ডের লরেন্স ও বাংলাদেশের ইব্রাহিমের নাম জড়িয়ে রয়েছে। জাতীয় অধ্যাপক ইব্রাহিম চিকিৎসা মানবসম্পদ তৈরির স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য বারডেম একাডেমি এবং নার্সিং ইনস্টিটিউট, আরভিটিসি ও বারটান গড়ে তোলেন। এরই সূত্র ধরে বা ভিত্তিতে পরবর্তীকালে সমিতির ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, নর্থবেঙ্গল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতি মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস (বিইউএইচএস), বারডেম নার্সিং কলেজসহ বহু প্রতিষ্ঠানে গবেষণা ও চিকিৎসা ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। কেননা তিনি মনে করতেন মানবিক গুণ এবং সামাজিক দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন দক্ষ চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ান না থাকলে বা গড়ে না উঠলে কার্যকর ডায়াবেটিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম ডায়াবেটিক চিকিৎসা কার্যক্রমের শুরু থেকেই পুষ্টিবিদ এবং স্বাস্থ্যশিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করেন। তিনি মনে করতেন ডায়াবেটিক রোগীকে তার লাইফ স্টাইল নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অর্ধেক চিকিৎসা শেষ। উপযুক্ত পরামর্শ পেলে খাদ্যমান বজায় রাখা এবং শৃঙ্খলা সহজসাধ্য হয়। ওষুধপত্র দেয়ার সঙ্গে রোগীকে খাদ্যের তালিকা- কোন খাদ্যে কী পরিমাণ শর্করা ও ক্যালরি বা প্রোটিন আছে তার একটা সচিত্র স্পষ্ট ধারণা দেয়া হয়। গাইডবইয়ে প্রতিটি রোগীর কী ধরনের খাবার কী পরিমাণ খেতে হবে তার নির্দেশনা চার্ট দেয়া আছে। সমিতির প্রতিটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে হেলথ এডুকেটরের পদ রয়েছে এবং রোগীকে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম ডায়াবেটিক রোগীর পুনর্বাসনের বিষয়ে তার চিন্তা-ভাবনাকে জাগ্রত রেখেছিলেন। তিনি জুরাইনে নিজের পারিবারিক সম্পত্তি সমিতিকে দান করে সেখানে ডায়াবেটিক রোগীদের পুনর্বাসন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করেন। ডায়াবেটিক রোগীরা যাতে সংসারে ও সমাজে বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়, কর্মজীবনে অকেজো না হয়ে পড়ে সে জন্য তাদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে যারা টাইপ-১ ডায়াবেটিক রোগী তাদের সংসারের এবং সমাজের যাতে বোঝা হয়ে না দাঁড়াতে হয় সেজন্য সমিতির সিডিআইসি প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে ২০-২১ বছর বয়স অবধি তাদের বিনামূল্যে ইনসুলিন সরবরাহসহ তাদের মানসিক, শারীরিক বিকাশের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। ডা. ইব্রাহিম চিকিৎসার ক্ষেত্রে ‘ইম্পেথি’ শব্দটির ওপর অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করতেন। ইংরেজি ‘ইম্পেথি’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো স্বীয় সত্তা অন্যের সত্তায় বিলীন করে দিয়ে, অন্যের শোক, দুঃখ ও ব্যথার অভিজ্ঞতা কল্পনায় নিজে অনুভব করার শক্তি। আর ‘সিম্পেথি’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো অন্যের শোক-দুঃখের সঙ্গে সমবেদনা বা সমব্যথিত হওয়া। অন্যের শোক, দুঃখ এবং অন্যান্য অভিজ্ঞতা মনে না করলে যেমন দুঃখী বা অন্তর্হিত ভাবকে নিজের মনে প্রতিফলিত করে সেবা দানে মনোনিবেশ করতে। এরূপ মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে যখন কোনো সেবাদানকারী কোনো আর্তপীড়িতের সেবায় নিজেকে প্রয়োগ করবে সে সেবাদানকারীই আর্তপীড়িতের সত্তার সঙ্গে বিলীন হতে পারবে আর সেবাদান তখনই পূর্ণাঙ্গ হবে। এই মানবীয় গুণ আয়ত্ত করার জন্য তিনি সবাইকে সব সময় অনুপ্রাণিত করার জন্য বলতেন- ‘আপনাদের সেবা করতে আমাদের সুযোগ দেয়ার জন্য আমরা আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ।’ রোগীদের সেবা প্রদানকারীর এরূপ ধারণাই থাকা উচিত যে, তারা বিনা পয়সায় সেবা গ্রহণ করতে এসেছে এবং এর জন্য তাদের সেবাদানকারীর কাছে কৃতজ্ঞ থাকার চেতনাবোধ থাকতে হবে। পক্ষান্তরে ডা. ইব্রাহিম তার সেবাদানকারী সহকর্মীদের বলতেন, তারা যেন রোগীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এজন্য যে, তারা (রোগীরা) এখানে আমাদের সেবা গ্রহণ করতে এসেছে এবং তারা না এলে আমাদের কাজ থাকত না। নীতি ও নৈতিকতার প্রশ্নে আপসহীন প্রফেসর ইব্রাহিম মনে করতেন ডাক্তারের প্রতি রোগীর আস্থা একটি বড় অনুষঙ্গ। ডাক্তার ইব্রাহিম John Ruskin (8 February 1819-20 January 1900)-এর অর্থনৈতিক দর্শনবিষয়ক প্রবন্ধাবলি Unto This Last (1860) বইটির ছাঁচে তার সেবাদর্শন স্থির করেছিলেন এবং সেভাবেই সমগ্র কর্মজীবন গড়ে নিয়েছিলেন, যে বইয়ে রাসকিন দেখিয়েছেন অর্থ ও বিত্ত মানুষের সত্যিকারের মূল্যায়ন করে না, মানুষের মূল্যায়ন হয় অন্য মানুষের তার ওপর আস্থার ভিত্তিতে।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সরকারের সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App