×

জাতীয়

হাক্কানির বই বিক্রির জাল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১০:৩৪ এএম

হাক্কানির বই বিক্রির জাল
সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বই বিক্রির এক অদ্ভুত ‘জাল’ বিস্তার করেছে হাক্কানি পাবলিশার্স নামের একটি প্রকাশনা সংস্থা। ওই জালের মাধ্যমে গত কয়েক বছরে তারা কোটি কোটি টাকা পকেটে ঢুকিয়েছে। এ জন্য বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংবলিত বই প্রকাশকে খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে তারা। অথচ হাক্কানি পাবলিশার্স কোনোকালেই মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশনা সংস্থা ছিল না। অতীতে এর নজিরও দেখা যায়নি। মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরই বোল পাল্টে তারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের প্রকাশক বনে যায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বই প্রকাশ করার পর সর্বশেষ এই হাক্কানি পাবলিশার্স গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে মাত্র একটি বই বিক্রি করে লাভ করেছে ৮ লাখ টাকারও বেশি। শুধু এই একটি আইটেমের বই-ই নয়, দুটি টেন্ডারে ৪৭৯টি আইটেমের ৭ হাজার ৯৫০টি বই কিনেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এসব বইয়ের মূল্য বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৬ কোটি ৮৯ লাখ ৩৪ হাজার ২৪৩ টাকা। এ বছরের ১৯ জুন টেন্ডার দুটির ওয়ার্ক অর্ডার পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হাক্কানী পাবলিশার্স। তারাই বাজার থেকে বইগুলো কিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে বেচেছে। হাক্কানি পাবলিশার্সের এমন কর্মকাণ্ড নিয়ে দেশের পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতিও উষ্মা প্রকাশ করেছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে হাক্কানি পাবলিশার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মোস্তফার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পরে হাক্কানি পাবলিশার্সের বিক্রয়কেন্দ্র পরমা পাবলিশার্সে ফোন করে গোলাম মোস্তফার অবস্থান জানতে চাইলে এক বিক্রয়কর্মী জানান, ‘স্যার কোথায় আছেন তা বলতে পারছি না।’ পরে তিনি প্রতিবেদকের মোবাইল নম্বর রেখে বলেন, ‘স্যার আসলে বলব আপনার সঙ্গে কথা বলতে’। এদিকে সরকারি মেডিকেল কলেজের জন্য সাড়ে ৫ হাজার টাকা দামের প্রতিটি বই ১৭ গুণ বেশি দামে সাড়ে ৮৫ হাজার টাকা করে কেনার অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেনকে প্রধান করে গঠিত ওই কমিটি গতকাল সোমবার প্রথম বৈঠক করেছে। জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, কী কী বিষয়ে তদন্ত হবে তার কার্যপত্র তৈরি করা হয়েছে বৈঠকে। শুধু বই কিনতেই দুর্নীতি হয়েছে, না আরো কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে তাও খুঁজে বের করবে তদন্ত কমিটি। তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, মেডিকেল কলেজের বই কিনতে এবারই প্রথম দুর্নীতি হয়নি। বছর বছর এ খাতে দুর্নীতি হয়ে আসছে। ২০১৪ সালে নোয়াখালীর একটি মেডিকেল কলেজের জন্য ‘ভিনসেন্ট টেক্সট বুক অব ক্রিটিক্যাল কেয়ার’ বইটির ষষ্ঠ সংস্করণের একটি কপি কেনা হয়েছিল ২১ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ টাকায়। অথচ বইটির প্রকৃত দাম ছিল ছয় হাজার ৬৫৬ টাকা। শুধু তাই নয়, সাড়ে আটশ’ টাকার একটি বই কেনা হয়েছিল চার লাখ টাকায়, চার হাজার টাকার বই কেনা হয়েছিল ৯ লাখে। সবমিলিয়ে এমন দর দিয়েই প্রতিষ্ঠানটি কিনেছিল ছয় কোটি টাকার বই। গত কয়েক বছরে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা পঙ্গু হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে একইভাবে অরবিটাল ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে বই কেনাকাটা করা হয়েছিল। দেশে সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ১০৫টি। সরকারি মেডিকেল কলেজে প্রথম থেকে পঞ্চম বর্ষ পর্যন্ত শিক্ষার্থী ৩০ হাজারের মতো। বেসরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী প্রায় ২৫ হাজার। এসব শিক্ষার্থীর পাঠ্য প্রায় সব বই-ই আমদানি করতে হয়। এ খাতে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর ব্যয় হয় ৫০০ কোটি টাকারও বেশি। সংশ্লিষ্টরা জানান, এই কেনাকাটা নিয়ে প্রতি বছরই অনিয়ম হয়। অর্থাৎ ডাক্তারির বই কিনতে রীতিমতো ডাকাতি হয়। ধরা পড়লে কয়েক দিন চেঁচামেচি হয়, তদন্ত হয়, কিন্তু কারো শাস্তি হয় না। ফলে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন নেই। সেই সুযোগে এবারো একই অনিয়ম হয়েছে। আগের কয়েক বছর এসব অনিয়ম করেছিল ‘অরবিটাল ইন্টারন্যাশনাল ইনকরপোরেশন’ নামের একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এবার হাক্কানী পাবলিশার্সের মাধ্যমে গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজের সার্জারির ছাত্র ও শিক্ষানবিশদের জন্য টেক্সট বই হিসেবে ‘প্রিন্সিপাল এন্ড প্র্যাকটিস অব সার্জারি’র ১০ কপি কিনেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বইটির বাজারমূল্য সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা হলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিটি বই কিনেছে ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা করে। সেই হিসাবে ১০ কপি বইয়ের মোট দাম পরিশোধ করা হয়েছে ৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ বাজার দামের তুলনায় ৮ লাখ টাকা বেশি খরচ করে এই বই কিনেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজের জন্য ৩১৭টি আইটেমের ২ হাজার ৪৫৪টি বই ২ কোটি ৫০ লাখ ৯১ হাজার ২৮৫ টাকায় কেনা হয়েছে। এ ছাড়া সারাদেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের জন্য ১৬২টি আইটেমের ৫ হাজার ৪৯৬টি বই কেনা হয়েছে ৪ কোটি ৩৮ লাখ ৪২ হাজার ৯৫৮ টাকায়। প্রশ্ন উঠেছে, যে হাক্কানী পাবলিশার্স এতদিন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বই প্রকাশ করে সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে, তারা হঠাৎ মেডিকেলের বই বেচতে গেল কেন? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুব কম সময়ে মেডিকেলের বই বেচে কম পুঁজিতে বেশি মুনাফা পাওয়া যায় শুধু এই একটি মাত্র লোভেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ভিড়েছে হাক্কানী পাবলিশার্স। জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুস্তক ব্যবসায়ী বলেন, হাক্কানী পাবলিশার্সের মালিক গোলাম মোস্তফা কখনোই আওয়ামী লীগের অনুসারী ছিলেন না। সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানকে নিয়ে প্রথম বই ছেপে বিএনপি সরকারের নজরে আসেন তিনি। সেই নজরকে আরো পোক্ত করার জন্য ড. রেজোয়ান সিদ্দিকীকে কাজে লাগানো হয়। এভাবেই বিএনপি সরকারের সময় মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র বই আকারে ছাপানোর কাজ পায় সংস্থাটি। এরপর থেকে হাক্কানী পাবলিশার্সের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সরকার পরিবর্তন হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই খোলস পাল্টে ফেলেন সুবিধাবাদী গোলাম মোস্তফা। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কয়েকটি বই ছেপে সরকারের ‘নেকনজরে’ পড়ে যান তিনি। এরপর সেটাকে পুঁজি করে নানামুখী ধান্দায় মেতে ওঠেন। মেডিকেলের বই বেচাও তার সে রকম একটি ধান্দা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি বলেছিল মাত্র ৫ হাজার টাকায় স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ছাপানো সম্ভব। কিন্তু হাক্কানী পাবলিশার্স কৌশলে বাংলা একাডেমিকে বাদ দিয়ে নিজেরাই সেটি ছাপিয়ে বিক্রি করেছে ১৫ হাজার টাকায়। এ জন্য হাক্কানী পাবলিশার্স আদালত পর্যন্ত গিয়েছিল। সে সময় প্রশ্ন ওঠেছিল সরকারি প্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে কেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে ১৫ খণ্ডের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ছাপানো হয়েছিল। কিন্তু কৌশলে সেই বিতর্ককে গিলে ফেলে হাক্কানী পাবলিশার্স। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর এক শীর্ষস্থানীয় প্রকাশক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি চিঠি নিয়ে হাক্কানী পাবলিশার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মোস্তফা সাবেক তথ্য সচিব হেদায়েত উল্লাহ আল মামুনের কাছে গিয়ে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন বিষয়টি বাস্তবায়ন করে দেয়ার জন্য। চিঠি দেখেই রেগে আগুনমুখো হয়ে সচিব গোলাম মোস্তফাকে বলেছিলেন, চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী কোনো নির্দেশ দেননি। অথচ আপনি বলছেন নির্দেশ। এটি অন্যায়। আমি আপনার কাজ করব না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন প্রকাশক বলেন, হাক্কানী পাবলিশার্সের মালিক প্রকাশনা জগতের একজন ‘দস্যু’। কোনোদিনই তিনি আওয়ামী ঘরানার ছিলেন না। তিনি মূলত সুবিধাবাদী। দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে তার সংস্থাটি ব্যবসার নামে সরকারের কাছ থেকে কত টাকা নিয়েছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, দুদকের তদন্তও ধামাচাপা দিয়ে দেবে হাক্কানী পাবলিশার্স।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App