×

মুক্তচিন্তা

বাংলাদেশে আসাম ভীতির ভিত্তি নেই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৯:২২ পিএম

বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক যে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে, সেটাকে নষ্ট করার ঝুঁকি কেন নেবে ভারত? আসামের মুসলিমদের সীমান্তের এপাশে ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কই বা নষ্ট করার অপরিণামদর্শী পথে যাবে কোনো দুঃখে? ধর্মীয় কারণে হিন্দুদের একটি অংশ যেমন ভারতে গেছে, তেমনি মুসলমানদের একটি অংশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এসেছে। শুধু সাম্প্রদায়িক কারণে আসামের মুসলিমদের সীমান্তের এপাশে ঠেলে দেয়ার পথে পা বাড়ানোর মতো কাঁচা কাজ করার দেশ নয় ভারত।

আসামের একজনকেও রাষ্ট্রহীন না করতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। রাজ্যটিতে জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন-এনআরসির চূড়ান্ত তালিকায় ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন মানুষ বাদ পড়ার জেরে এ আহ্বান বিশ্বসভার। ভারত বলছে, সমস্যাটি তাদের অভ্যন্তরীণ। প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশও তাই বলছে। কিন্তু বিশ্বায়নের যুগে একের সমস্যা অন্যের জন্যও সমস্যা। এর তাপ-চাপ ভুগতে হয় প্রতিবেশীসহ অন্যদেরও। রবিবার জেনেভায় জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রানদির বিবৃতির মধ্যেও একই উদ্বেগের ছাপ। তার বিবৃতির বাংলা তরজমা দাঁড়ায় : কোনো প্রক্রিয়ায় বিপুলসংখ্যক মানুষ জাতীয়তাহীন হয়ে পড়লে তা হবে বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রহীনতা নির্মূল করার প্রক্রিয়ার ওপর বিশাল আঘাত। এর আলোকেও দেশ, ঘটনা, সময়, প্রেক্ষিত ভিন্ন হলেও রাখাইনের রোহিঙ্গা এবং আসামে নাগরিক তালিকার মধ্যে একটা মিল খোঁজার মানসিকতা রয়েছে। বোধটা একেবারে অমূলক-অপ্রাসঙ্গিকও নয়। মিয়ানমারে ১৯৮২ সালের সংবিধানে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার সময় বলা হয়েছিল, তাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ নেই। শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকা রোহিঙ্গারা সেখানে কেবল কৃষিকাজ করেছে। মাছ ধরেছে। নাগরিকত্বের ধার ধারেনি। বংশপরম্পরায় বসবাসের প্রমাণ রাখারও দরকার মনে করেনি। আসামের চিত্রের সঙ্গে এর বেশ মিল। আর অমিল হচ্ছে, আসামের ঘটনা আকস্মিক নয়। মিয়ানমারের মতো হামলাও নয়। ঘোষণা দিয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দিকে যাচ্ছে ভারত সরকার। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন এবং ২০১৬ সালের আসাম বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই বিজেপি অভিযোগ করে আসছে- আসামে মুসলিম ‘অনুপ্রবেশকারী’ বাড়ছে। ক্ষমতায় গেলে নাগরিকপঞ্জি বাস্তবায়ন করে কথিত অনুপ্রবেশ ঠেকানোর অঙ্গীকারও ছিল বিজেপির। কিন্তু সমস্যা-সংশয় জোরালো হচ্ছে কিছু বাড়তি এবং আগবাড়ানো কথায়। তালিকায় বাদ পড়াদের মধ্যে আসাম তথা ভারত থেকে বিতাড়িত হওয়ার আতঙ্ক ভর করেছে। এমনটাই স্বাভাবিক। আবার আশাহত না হওয়ার বার্তাও রয়েছে। ভারত সরকার তালিকার বাইরের ১৯ লাখ মানুষকে আইনের হাওলা হওয়ার সুযোগ রেখেছে। তাদের ১২০ দিনের মধ্যে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে বলা হয়েছে। তাদের ফ্রিতে আইনি পরামর্শ দেবে ২০০ আইনজীবীর একটি দল। এ বিষয়ে শুনানির জন্য রাজ্যজুড়ে এক হাজার ট্রাইব্যুনাল গড়ে তোলা হবে। এরই মধ্যে ১০০ ট্রাইব্যুনাল খোলা হয়েছে। এ সপ্তাহেই খোলা হবে আরো ২০০টি ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালে হেরে গেলে হাইকোর্টে যাওয়ার সুযোগও রয়েছে। সেখানেও হারলে যাওয়া যাবে সুপ্রিম কোর্টে। এরই মধ্যে আতঙ্ক কাটাতে হোম গার্ড, টাস্কফোর্স ও ভিলেজ ডিফেন্স পার্টি মোতায়েন করা হয়েছে আসামে। কোনো রকম বিপদে পড়লে মানুষ জানাতে পারবেন পুলিশকে। সার্বিক এ হাল অবস্থায় আসামের নাগরিকদের একবাক্যে রোহিঙ্গা বলা যায় না। বাংলাদেশের উদ্বেগে কাহিল হয়ে যাওয়া জরুরি নয়। এরপরও কেউ উতলা হয়ে উঠলে এটা হবে তার একান্ত তাড়না বা দুর্বলতা। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এ ইস্যুতে যথেষ্ট সংযত এবং কৌশলী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, ভারত জানতে চাইলে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেবে বাংলাদেশ। একাত্তরের পর বাংলাদেশিরা ভারতে যায়নি বলে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তিনি। কিঞ্চিৎ প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, কোনো বাংলাদেশি ভারতে থাকলে তারা ১৯৪৭ বা ১৯৭১ সালের আগে গিয়ে থাকতে পারেন। একই অর্থ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথার। অভিন্ন বার্তাই দিয়েছেন তারা। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারত সরকার আপাতত ভালো সমস্যায় পেঁচিয়ে গেছে ইস্যুটিতে। এ ইস্যুতে ভারতে বিরোধীদের তোপের মুখে পড়েছেন বিজেপি নেতারা। শনিবার এ তালিকা প্রকাশ হতেই কেন্দ্র ও রাজ্য বিজেপিকে একহাত নিয়েছেন আসামের বিধায়ক আব্দুল খালেক। এনআরসি ইস্যুতে বিজেপি নেতা ও আসামের অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশকে অপমান করেছেন বলে তার পদত্যাগ দাবি করেন তিনি। তিনি হিমন্ত বিশ্বশর্মা ও বিজেপির আরেক নেতা শিলাদিত্য দেবকে পরিবেশদূষণকারী হিসেবেও কটাক্ষ করেছেন। মমতা বলেন, রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চেয়েছিল তারা। এবার তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছে এনআরসি। তালিকায় বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে স্বল্পসংখ্যক মুসলিম বাদ পড়ায় পুরো এনআরসি প্রক্রিয়াটিকেই ত্রুটিপূর্ণ দাবি করে নতুন সমীক্ষার দাবি জানিয়েছে বিজেপি। বিপরীতে বাদ পড়াদের বেশির ভাগই হিন্দু হওয়ায় বিরোধীদের তোপের মুখে পড়েছেন কেন্দ্রে ও আসাম রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি ও দলটির নেতারা। অন্যদিকে এনআরসিকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে যে কৌশল নিয়েছিল বিজেপি, তা বুমেরাং হওয়ায় রাজ্য ও জাতীয় রাজনীতিতে মারাত্মক চাপের মুখে পড়েছে বিজেপি। আসামের বাংলা দৈনিক যুগশঙ্খ স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে গতকাল পত্রিকাটির গুয়াহাটির প্রিন্ট সংস্করণের এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাদ পড়া ১৯ লাখের মধ্যে ১২ থেকে ১৩ লাখই হতে পারে হিন্দু বাঙালি। এ তথ্যেই এনআরসি প্রক্রিয়ার ওপর বেজায় ক্ষেপেছে রাজ্য বিজেপি। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো থেকে বলা হচ্ছে, বিজেপির প্রত্যাশা ছিল নাগরিক তালিকা থেকে মুসলিমদের বড় একটি অংশ বাদ পড়বে। এখন উল্টো ফল হওয়ায় সুপ্রিম কোর্ট নিয়োজিত রাজ্য এনআরসি সমন্বয়ক প্রতীক হাজেলার ওপর তোপ দাগাতে হচ্ছে বিজেপি নেতাদের। আসাম বিজেপির সভাপতি রণজিৎ কুমার দাস জানিয়েছেন, তারা এই এনআরসিতে আর আস্থা রাখছেন না। ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে অনেকে তালিকায় ঢুকে গেছে। অথচ দুই লাখ ‘প্রকৃত ভারতীয়’ বা ভূমিপুত্র তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে খারাপ ফল এলে তারা বিষয়টি পার্লামেন্টে নিয়ে যাবেন। মূলত মুসলিম অভিবাসী অধ্যুষিত বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সামান্য হারে বাদ পড়ার বিষয়টিকেই এনআরসির ত্রুটি হিসেবে তুলে ধরতে চাচ্ছে বিজেপি। রাজ্য বিজেপি নেতা ও অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার মতে, ১৯৭১ সালের আগে বাংলাদেশ থেকে আসা অনেক ব্যক্তি ‘শরণার্থী সার্টিফিকেট দাখিল করেও তালিকায় ঢুকতে পারেনি। অথচ পরে এসেও অনেকে উত্তরাধিকার তথ্য দাখিল করে তালিকায় ঢুকে গেছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে ২০ শতাংশ এবং অন্য জেলাগুলোতে ১০ শতাংশ হারে তালিকা পর্যালোচনার বিষয় সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। অল আসাম স্টুডেন্ট ইউনিয়ন-আসু এবং ও আসাম পাবলিক ওয়ার্ক-এপিডব্লিউও সুর মিলিয়েছে বিজেপির সঙ্গে। আসামে এনআরসি প্রধান কর্মকর্তা তথা এনআরসির আসাম রাজ্য সমন্বয়ক প্রতীক হাজেলা বলেছেন, ৫২ হাজার সরকারি কর্মকর্তার সমন্বয়ে প্রণীত এই এনআরসি হালনাগাদ করা ছিল একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। তালিকা রাখা ও না রাখার সব সিদ্ধান্তই নেয়া হয়েছে বিধিবদ্ধ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে। ঘোষিত তালিকায় রয়েছে তিন কোটি ১১ লাখ মানুষের নাম। বাদ পড়েছে ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭। তালিকা থেকে বাদপড়াদের মধ্যে প্রায় সবাই বাঙালি। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই মুসলমান। রয়েছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীও। তারা নাগরিকত্ব হারিয়ে ফেলে রাষ্ট্রহীন হয়ে গেছেন- এমন কথা এখনই বলা যায় না। কিন্তু শঙ্কা বা ভয় জাগিয়ে তুলছে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির কিছু নেতা ও মন্ত্রীর অতিকথন। কথার ভাবভঙ্গিতে তারা আমাদের কোনো নেতা-মন্ত্রীর মতো। খিস্তিখেউর করেন। আস্তিন গুটান। অপ্রাসঙ্গিকভাবেই প্রসঙ্গ করেন বাংলাদেশকে। তালিকায় বাদপড়াদের বাংলাদেশি নাগরিক সম্বোধন করছেন। দিচ্ছেন খেদানোর মেঠো এবং নোংরা হুঙ্কার। চার বছর ধরে যাচাই-বাছাই শেষে প্রকাশ করা হয়েছে তালিকাটি। নাগরিকত্বের জন্য আবেদন পড়েছিল তিন কোটি ৩০ লাখের বেশি। খসড়া তালিকায় বাদপড়াদের এ সংখ্যা ছিল প্রায় ৪১ লাখ। চূড়ান্ত তালিকায় তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এটা আসামবাসীর জন্য অবশ্যই স্বস্তিদায়ক। তাদের আটক করা হবে না বলে জানানো হয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত তাদের সব ধরনের রাষ্ট্রীয় অধিকার ভোগের নিশ্চয়তাও দেয়া হয়েছে। তালিকায় জায়গা পেতে আসামের বাসিন্দাদের প্রমাণ করতে হয়েছে তাদের পূর্বপুরুষদের নাম ১৯৫১ সালের এনআরসিতে বা ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের আগের কোনো ভোটার তালিকায় ছিল। এ সংক্রান্ত কাগজপত্র জোগাড় বা তৈরি করতে তাদের বহু ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক যে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে, সেটাকে নষ্ট করার ঝুঁকি কেন নেবে ভারত? আসামের মুসলিমদের সীমান্তের এপাশে ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কই বা নষ্ট করার অপরিণামদর্শী পথে যাবে কোনো দুঃখে? ধর্মীয় কারণে হিন্দুদের একটি অংশ যেমন ভারতে গেছে, তেমনি মুসলমানদের একটি অংশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এসেছে। শুধু সাম্প্রদায়িক কারণে আসামের মুসলিমদের সীমান্তের এপাশে ঠেলে দেয়ার পথে পা বাড়ানোর মতো কাঁচা কাজ করার দেশ নয় ভারত।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App