×

মুক্তচিন্তা

ডেইরি শিল্প ও খাদ্য নিরাপত্তা প্রসঙ্গে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৮:৫৪ পিএম

পরিকল্পনা মেয়াদে বেশ কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হচ্ছে যেমন ডেইরি খাতে সমবায়ের উপস্থিতি, ডেইরি চাষিদের উন্নত প্রযুক্তি সরবরাহ, গবাদি পশুর খাদ্য উৎপাদন, প্রাণী স্বাস্থ্য রক্ষায় ভেটেরিনারি সেবা বৃদ্ধিকরণ ও ক্ষুদ্রকায় খামারিদের লোন সুবিধা প্রদানসহ বিপণন ব্যবস্থা জোরদারকরণ। এই বিষয়গুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়নে প্রয়োজন সরকারের নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতা ও বাজেট বরাদ্দ। দুগ্ধ থেকে তৈরি বিভিন্ন সামগ্রীর বিশাল বাজার সারাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে, যার চাহিদা অফুরন্ত যদি তা ভেজালমুক্ত হয়।

বাংলাদেশের দুগ্ধ শিল্প দেশের মানুষের পুষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখছে, যা অনস্বীকার্য। আমাদের জনসংখ্যা বাড়ছে, যার সঙ্গে দুগ্ধ সামগ্রীর চাহিদাসহ উৎপাদন বাড়ছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের (২০১৮) তথ্য মতে, দেশে প্রতি বছর ৯০ লাখ ২৪ হাজার টন দুধ উৎপাদন হচ্ছে কিন্তু চাহিদা রয়েছে ১ কোটি ৫৮ লাখ টন অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ টনের কিছু বেশি। এর মানে হলো বাংলাদেশ তার মোট প্রয়োজনের মাত্র ৬৩ শতাংশ উৎপাদন করছে এবং বাকি ৩৭ শতাংশ ঘাটতি পূরণের জন্য প্রতি বছর প্রায় ১ হাজার পাঁচশ কোটি টাকার দুধ আমদানি করছে। বিজ্ঞজনসহ সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা গুঁড়োদুধ আমদানিতে ব্যয় হয় তা যদি স্থানীয় দুগ্ধ উন্নয়নে ঋণ কিংবা প্রণোদনা হিসেবে ব্যবহৃত হতো তাহলে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে চাহিদার ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হতো। কিন্তু দেশে দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধির পথে প্রধান অন্তরায়গুলো হলো- জমির দুষ্প্রাপ্যতা, গবাদি পশুর পর্যাপ্ত খাবারের স্বল্পতা ও গরুর উৎপাদন ক্ষমতা। সার্বিক ব্যবস্থাপনা তথা নীতিসহায়তা পেলে বাংলাদেশ যে দুগ্ধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বর্তমান সময়ে খাদ্যে নিরাপত্তায় ভেজাল একটি বহুল আলোচিত বিষয় এবং পত্রিকার পাতায় কিংবা টেলিভিশনের টকশোতে একটি জনপ্রিয় ফিচার বলে আলোচিত। বর্তমান সময়ে মানুষ খুবই স্বাস্থ্য সচেতন বিশেষত ভোজালমুক্ত খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে এবং গত মে মাসে সরকার ৫২টি কোম্পানির পণ্যকে ভেজাল পণ্য হিসেবে নিষিদ্ধ করে। উল্লেখ্য, রমজান মাস এলেই এসব ভেজালবিরোধী অভিযানের নিবিড়তা বেড়ে যায় এবং বিভিন্ন কোম্পানিকে ভেজাল খাদ্যের জন্য লাখ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। বাংলাদেশ দুধ সংকট ২০১৯ এই নামে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন তাদের জারিকৃত প্রত্যয়নের আওতায় দেশের যে ১৪টি কোম্পানি পাস্তুরিত দুধের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের উৎপাদিত দুধের নমুনা সংগ্রহ করে দেশের চারটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেমন জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগার, বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের গবেষণাগার, আইসিডিডিআরবির গবেষণাগার ও বাংলাদেশ পানি সম্পদ ইনস্টিটিউটের গবেষণাগার ইত্যাদিতে পাঠিয়ে নির্ধারিত বিষয়ে আদালতে প্রতিবেদন দিতে হবে যে এসব কোম্পানির দুধে অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যাকটিরিয়া, ফরমালিন, ডিটারজেন্ট, কলিফর্ম, অম্লতা ও স্টেফাইলোকক্কাস- এসব ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি রয়েছে কিনা। এই কারণে বাজারে প্রচলিত পাস্তুরিত প্যাকেটজাত দুধের বিশুদ্ধতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দেয়। সেই সময়ে বিভিন্ন ধরনের সন্দেহ ও নৈতিকতার প্রতি অবিশ্বাস থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টার ও ঔষধ প্রযুক্তি বিভাগ একটি গবেষণা শুরু করে গত জুন মাসে। এই গবেষণা দল কয়েকটি বিশিষ্ট পাস্তুরিত দুধের ব্র্যান্ডের এবং খোলাবাজার থেকে অপাস্তুরিত দুধের নমুনা বিশ্লেষণ শুরু করে। পাস্তুরিত ৭টির সবগুলোতেই অ্যান্টিবায়োটিক যেমন- লেভোফ্লক্সাসিন ও সিপ্রোফ্লাক্সাসিন পাওয়া যায়। আর ৬টিতে মিলে এজিথ্রোমাইসিনস। পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত চারটিতে মিলে ডিটারজেন্ট ও অপাস্তুরিত একটিতে মিলে ফরমালিন। এই ফলাফলের ভিত্তিতে হাইকোর্ট ১৪টি দুধ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানির ওপর তাদের কার্যক্রম বন্ধের নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সরকারের পক্ষ থেকে নির্ধারিত প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইয়ের সক্ষমতা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন রয়েছে যেমন উপাদান সূচকে দুধের বিশুদ্ধতার প্রত্যয়ন করা যায়, যা বিএসটিআইয়ে অনুপস্থিত রয়েছে। এসব ফলাফল প্রকাশের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের গবেষকরা নতুন করে একটি গভীর বিতর্কে জড়ায় এবং দুগ্ধ কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা বন্ধের কারণে ভীষণভাবে এসব ফলাফলের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এই বলে যে, এই শিল্পের সঙ্গে অনেকের কর্মসংস্থান যেখানে জড়িত তাদের কী হবে এবং অর্থনীতিতে তার একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করছে। আবার বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টার পাস্তুরিত দুধে প্রাপ্ত অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতির বিতর্কের কারণে দ্বিতীয়বার গবেষণা শুরু করে এবং ১৩ জুলাই ফলাফল প্রকাশ করে। উল্লেখ্য, পরীক্ষিত নমুনায় সবটিতেই অ্যান্টিবায়োটিক শনাক্ত হয়। এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশের পর দুধের মানবিষয়ক জরিপের ফল নিয়ে সরকারি মহলে ও ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানির মালিকরা নড়েচড়ে বসে, যা পরবর্তী সময়ে সংসদে আলোচনায় স্থান পায়। তার পরপরই ৯ জুলাই প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর নিরাপদ তরল দুধ উৎপাদন শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গবেষণার ফলাফলকে নাকচ করে দেন। এর ফলে গবেষক মহলের মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা-নিরুৎসাহ ও ভয়-ভীতির সৃষ্টি হয়, যা স্বাধীন গবেষণা ও জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার জগতে বড় অন্তরায়। সরকারি ব্যক্তিদের দায়িত্ব জনস্বার্থে কাজ করা, কায়েমি স্বার্থবাদী ব্যবসায়ী মহলের স্বার্থ রক্ষা করা নয়। কোনো গবেষণা চ্যালেঞ্জ করতে হলে আরো একটি গবেষণার ফলাফল দিয়ে তা করতে হয় কারণ বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফলকে সহজে খারিজ করা যায় না। মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল এই গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। বাজারে যেসব কোম্পানির দুধ বিক্রি হচ্ছে সেগুলোতে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান যে রয়েছে তা পরীক্ষিত সত্য। তাই সরকারের দায়িত্ব সেই দুধ কোম্পানিগুলোকে নজরদারিতে রাখা, যাতে করে জনগণের জন্য মানসম্পন্ন দুধের প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা দিল উল্টোটা। মিল্ক ভিটা কোম্পানি হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রিট করে এবং সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মিল্ক ভিটার পক্ষে রিটটি পরিচালনা করে ওই কোম্পানির পক্ষে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে সহায়তা করে এবং পর্যায়ক্রমে পূর্বে ঘোষিত সব কোম্পানির ওপর থেকে হাইকোর্ট তাদের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। যার ফলে গবেষণার ফলাফলের কোনো কার্যকারিতা স্থান পায়নি। এমতাবস্থায় দেশের জনস্বাস্থ্য এখন হুমকির সম্মুখীন। সবার জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর দুধ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যকরভাবে দুধ দোহন, সংগ্রহ সংরক্ষণ ও পাস্তুরিত করার বিষয়ে যত্নবান হতে হবে। এ ছাড়া পানের জন্য দুধকে নিরাপদ রাখতে উৎপাদন স্থান থেকে ভোক্তার টেবিল পর্যন্ত প্রত্যেকটি পর্যায়ে পাস্তুরিত দুধকে নিরবচ্ছিন্নভাবে শীতল রাখার পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এখন যেসব প্রতিষ্ঠান এই কাজটির সঙ্গে জড়িত তাদের ব্যবসায়িক নৈতিকতা এখন সবচেয়ে বড় বিষয়। অথচ এই বিষয়টি ব্যবসায়িক মুনাফার কাছে প্রতিনিয়তই হার মানছে, যা মানুষ সৃষ্ট সমস্যা। কারণ পুষ্টিমানের বিচারে দুগ্ধ পণ্যের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হলেও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এই স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এখন সরকার তাদের সপ্তম বার্ষিক পরিকল্পনায় প্রাণিসম্পদের সংখ্যা উল্লেখ করেছে যথাক্রমে- দুগ্ধবতী গাভী ২৩.৬৪ মিলিয়ন, মহিষ ১.৪৬ মিলিয়ন এবং ছাগল ২৫.৬০ মিলিয়ন। এসব প্রাণী থেকে বছরে দুগ্ধ উৎপাদন হয় ৬.৯৭ মিলিয়ন টন, যা চাহিদার তুলনায় কম। এর প্রধান কারণ বাজেটে অপর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ ও বেসরকারি খাতে উদ্যোক্তার অভাব। পরিকল্পনা মেয়াদে বেশ কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হচ্ছে যেমন ডেইরি খাতে সমবায়ের উপস্থিতি, ডেইরি চাষিদের উন্নত প্রযুক্তি সরবরাহ, গবাদি পশুর খাদ্য উৎপাদন, প্রাণী স্বাস্থ্য রক্ষায় ভেটেরিনারি সেবা বৃদ্ধিকরণ ও ক্ষুদ্রকায় খামারিদের লোন সুবিধা প্রদানসহ বিপণন ব্যবস্থা জোরদারকরণ। এই বিষয়গুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়নে প্রয়োজন সরকারের নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতা ও বাজেট বরাদ্দ। দুগ্ধ থেকে তৈরি বিভিন্ন সামগ্রীর বিশাল বাজার সারাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে, যার চাহিদা অফুরন্ত যদি তা ভেজালমুক্ত হয়। তাই আসুন আমরা সবাই মিলে এই ভেজালবিরোধী অন্দোলনের শরিক হই এবং একটি পুষ্টিকর জাতি বিনির্মাণে এগিয়ে আসি।

ড. মিহির কুমার রায় : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App