×

জাতীয়

নিজভূমে পরবাসী আজমউল্লাহ ও ৬০০ পরিবার!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০১৯, ০১:৫৭ পিএম

নিজভূমে পরবাসী আজমউল্লাহ ও ৬০০ পরিবার!
কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালীরছড়া এলাকার বাসিন্দা আজমউল্লাহ। বয়স ৮৮ বছর। সারা জীবন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন সাজানো গোছানো সংসার। চাষাবাদ, গরু পালন, মুরগির খামার, পানের বরজ ও বাঁশ থেকে ভালো টাকা উপার্জনও শুরু হয়। ভেবেছিলেন শেষ বয়সে এই সুখ নিয়েই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবেন। কবরটিও থাকবে বাড়ির পাশে। কিন্তু বিধিবাম। সারা জীবনের কষ্টের পর শেষ বয়সের শান্তি আর স্থায়ী হলো না। নদীর স্রোতের মতো রোহিঙ্গা ঢলে গত দুই বছরে সব হারিয়ে এখন শুধু বাড়িটাই কোনোমতে অবশিষ্ট আছে তার। তবে তাও কত দিন থাকে জানা নেই তার। কারণ এটিও ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে রোহিঙ্গারা। ফলে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে আজমউল্লাহর পরিবার। এখন মারা গেলেও বাড়ির পাশে কবর দেয়ার জায়গাটি পর্যন্ত নেই। কারণ বাড়ির উঠান থেকে শুরু করে যেদিকে তাকান, যতদূর চোখ যায়, শুধুই রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি। শুধু আজমউল্লাহ নয়, উখিয়া-টেকনাফের এমন প্রায় ৬০০ পরিবার আছে, যারা নিজেদের সব সম্পদ হারিয়ে এখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। কৃষিনির্ভর এ পরিবারগুলো আর্থিক অবস্থাও নাজুক। শেষ ভরসা হিসেবে যারা গরু-ছাগল পালন করতেন তাও লুট করে নিয়ে গেছে রোহিঙ্গা ডাকাতরা। এখানেই শেষ নয়, ক্যাম্প ঘিরে কর্মযজ্ঞ শুরু করা প্রায় দেড়শ এনজিওতে অনেক রোহিঙ্গা কাজ পেলেও চাকরি মিলছে না এদের। যদিওবা দুয়েকজনের মিলছে, তাদের বেতন দেয়া হচ্ছে নামমাত্র, যা দিয়ে পুরো পরিবারের খরচ চালানো সম্ভব নয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এনজিওর পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এ পরিবারগুলোকে সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দেয়া হলেও বাস্তবে কপালে জোটেনি কিছুই। ফলে বর্তমানে এই পরিবারগুলোর অবস্থা এমনই, নিজের দেশেই নিজেদের ‘রোহিঙ্গা’ ভাবতে শুরু করেছে তারা! সরেজমিন বালুখালী এলাকার ৯ নম্বর ক্যাম্প দিয়ে প্রবেশ করতেই দেখা যায়, রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরের মধ্যে পাহাড়ের টিলায় তিনটি ভিন্ন ধরনের বাড়ি। বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িটির চারপাশসহ উঠানেরও দখল নিয়েছে রোহিঙ্গারা। বাড়িতে কেউ আছে কিনা জানতে চাইলে ঘরের সামনে বসে থাকা রোহিঙ্গা শিশুরা জানায়, কেউ নেই। এর কিছুক্ষণ পরে বের হয়ে আসেন আজমউল্লাহ। সংবাদকর্মী পরিচয় দেয়ার পরে ঘরের মধ্যে নিয়ে যান। তবে পিছু ছাড়ছিল না রোহিঙ্গারা। ঘরের সামনে জড়ো হয়ে যায় ৫-৭ জন রোহিঙ্গা। পরে তাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে চলে যেতে বলেন আজমউল্লাহ। তারপর খবর জানতে চাইলেই আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, সব শেষ হয়ে গেছে রে বাবা। আমাদের কষ্ট দেখারও কেউ নেই। আলাপচারিতায় আজমউল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, তার তিন ছেলে সোনা মিয়া, আলী হোসেন ও আবদুল হক। তিন ছেলেরই রয়েছে আলাদা সংসার। ২ বছর আগে রোহিঙ্গা আসার আগ পর্যন্ত বেশ ভালোই ছিলেন তারা। ১০ একর জমিতে ধান চাষ করতেন। ছিল ২০টি গরু ও মুরগির খামার। পাহাড়ের পানের বরজ ও বাঁশ থেকে আয় করতেন বেশ ভালো অঙ্কের টাকা। কিন্তু ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা ঢল শুরু হওয়ার পরে প্রথম ধাক্কাতেই হারান ৯ একর ধানি জমি, পানের বরজ ও বাঁশের বাগান। রাতারাতি সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠে রোহিঙ্গারা। এরপর জোরপূর্বক তাদের মুরগির খামার লুট করে সেখানে থাকতে শুরু করে রোহিঙ্গারা। বাড়ির উঠানের ওপরই ঘর তৈরি করে ২টি রোহিঙ্গা পরিবার। অবস্থা বেগতিক দেখে আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধার নিয়ে পৃথক নতুন একটি ঘর তোলেন তার ছেলে আবদুল হক। এরই মধ্যে একদিন গরুগুলো লুট করে নিয়ে যায় রোহিঙ্গা ডাকাতরা। সবশেষে যে বিঘা তিনেক ধানি জমি অবশিষ্ট ছিল, সেটিও এখন রোহিঙ্গাদের ময়লা অবর্জনা, মলমূত্র ও পাহাড়ি বালুর ভাগাড়। কোনোভাবেই সেখানে চাষাবাদ করা সম্ভব নয়। ফলে আয়ের সব উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চোখে অন্ধকার দেখছেন তারা। সংসার কীভাবে চলছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সামনে তারা দুটি দোকান দিয়েছেন, সেখানে আয় খুবই কম। কারণ রোহিঙ্গারা তাদের নিজেদের লোকজনদের দোকান ছাড়া বাঙালিদের দোকান থেকে কিছু কেনে না। কীভাবে যে আমরা দিন কাটাচ্ছি তা কেউ খোঁজ নেয় না, বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। আজমউল্লাহর ছোট ছেলে আবদুল হকের স্ত্রী নুরুন্নাহার ভোরের কাগজকে বলেন, ২ বছর আগেকার অনেক শান্তির সংসারে আজ সব শেষ। চারদিকে শুধু রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গা। ভয়ে ঘর থেকে বের হতে পারি না। সেই সঙ্গে রয়েছে মারাত্মক দুর্গন্ধ। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের কোনো কথা রোহিঙ্গারা শোনে না। সব জমি দখলের পরে উঠানেও ঘর তুলেছে। এখন বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে। কোথায় যাব আমরা। কেউ আমাদের কথা ভাবছে না। এমনকি জমি দখলের বিষয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেও কোনো পরিত্রাণ পাইনি। একটি এনজিও আমার এক মেয়েকে চাকরি দেয়ার কথা বলে জায়গা দখল করলেও এখন আর পাত্তা দেয় না। জানি না ভবিষ্যতে আমাদের কপালে আরো কী লেখা আছে? সোনা মিয়ার স্ত্রী জোছনা বেগমের অভিযোগ, রোহিঙ্গাদের দখলের পরে যে জমিটুকু অবশিষ্ট ছিল সেখানে স্লাব তৈরির কথা বলে রোহিঙ্গা ডাকাতদের সহায়তায় দখলে নিয়ে নিয়েছে স্থানীয় ফুরকান নামে এক প্রভাবশালী। এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তারা। রোহিঙ্গাদের ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারেন না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য চোখের জ্বলে আকুতি জানান তিনি। তবে এসব অভিযোগ খারিজ করে দিয়ে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিকারুজ্জামান চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর মধ্যে প্রায় ৬০০ স্থানীয় পরিবার রয়েছে। ফলে রোহিঙ্গাদের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পাশাপাশি স্থানীয়দেরও বিভিন্ন সহযোগিতা করছে এনজিওগুলো। এই পরিবারগুলোর কেউ যদি অভিযোগ করে যে কিছুই পায়নি, তাহলে সে তথ্য ঠিক না। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরো বলেন, ওই পরিবারগুলো যে জমির কথা বলছে সেগুলো সরকারি জমি। দীর্ঘদিন ধরে তারা নিজেদের দখলে রেখেছিল। পরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প করার সময় খুবই সতর্কতার সঙ্গে তাদের ভিটেমাটি রক্ষা করা হয়েছে। এরপরও যেহেতু ওই দখলি জমিই ছিল তাদের প্রধান অবলম্বন, সেহেতু তারা একটু বিপাকে পড়বেন এটাই স্বাভবিক। এনজিওর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত এই পরিবারগুলোর তালিকা করে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা দেয়া হয়েছে, যদিও এ ক্ষেত্রে সফলতার হার খুব বেশি নয় বলে স্বীকার করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App