×

সাময়িকী

সর্বমানবিক কবি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০১৯, ১০:০৭ পিএম

সর্বমানবিক কবি
কেননা নজরুল তুলনীয় কেবল নজরুলের সঙ্গেই। তার আগে তার মতো বিদ্রোহ ছিল না, তার মতো কাব্যভাষা ছিল না, তার মতো নান্দনিকতা ছিল না, তার মতো সর্বমানবিকতা ছিল না, তার মতো জাতি ও সর্বজাতির মধ্যে ন্যায়ভিত্তিক সম্পর্কের ধারণা ছিল না? অন্তত এই বাঙালিসমাজে। নর নয়, নারী নয়, নজরুলের পক্ষপাত মূলত অভিন্ন মানবসম্প্রদায়।
জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বপ্ন, সংগ্রাম, জন্ম, বিকাশ ও ভবিষ্যৎ আলোকযাত্রার কথা বিবেচনায় রেখে যদি একজন মাত্র বাঙালি কবির নাম বলতে হয়, তাহলে তিনি নিঃসন্দেহে কাজী নজরুল ইসলাম। এই গাঙ্গেয় অববাহিকায় ইতিহাস-পূর্ব কাল থেকে যে জনগোষ্ঠীর উদ্ভব, মিশ্রণ ও বিবর্তন, তাদেরই ইতিহাসবাহিত নাম বাঙালি। বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশ এই বিবেচনায় অবিচ্ছেদ্য। এ এমন এক চেতনাশ্রয়ী বিবেচনা যা অনাদিকালের উৎস থেকে ভবিতব্যের দূরতম মুহূর্ত পর্যন্ত এক অবিভাজ্য বৃত্তীয় পরিধিতে বিবর্তিত ও পরিভ্রমণরত। এই চেতনার শুরু আছে, শেষ নেই। এই আদি-অন্তহীন বাঙালি চেতনার সঙ্গে অবিকৃতভাবে সমীকৃত হয়ে আছে যার দৃষ্টি ও সৃষ্টি, তিনি শুধু অমিত-তারুণ্যের প্রতীক বিদ্রোহী কবিযোদ্ধা মাত্র নন, বরং তিনি ‘বাঙালির বাংলা’-র স্রষ্টা এক ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, যিনি ত্রিকালদর্শী টাইরেসিয়াসের চেয়ে কম প্রাজ্ঞ নন। তাই বলতেই হয়, ব্যক্তি, সমষ্টি, স্বজাতি ও সমগ্র মানবজাতির মুক্তি, কল্যাণ আর ভারসাম্যময় অবস্থানসহ বিশ্ব শান্তির লক্ষ্যে এমন অঙ্গীকৃত আস্থা ও নান্দনিক বিশুদ্ধতা নিয়ে কম কবিরই আবির্ভাব ঘটেছে আমাদের এই দ্বন্দ্ব-ক্ষুব্ধ গ্রহটিতে। মনে রাখা প্রয়োজন, পলাশীর আম্রকাননে উপমহাদেশের স্বাধীনতা-সূর্য অস্তমিত হওয়ার ১৪২ বছর পর তার জন্ম, কিন্তু তবুও তিনি জন্ম-স্বাধীন। জন্মের দুই দশকের পরপরই তিনি ঘোষণা করলেন তার মাতৃভূমি বাংলাদেশসহ গোটা উপমহাদেশের স্বাধীনতার কথা। তার মাত্র সিকি শতাব্দী পরে ঔপনিবেশিক প্রভুর ষড়যন্ত্রপ্রসূত দেশ-বিভক্তির পথ ধরে এলো উপমহাদেশের স্বাধীনতা। তবে তার পরের ইতিহাস আরো নাটকীয়। কেননা অতঃপর সিকি শতাব্দীরও কম সময়ের ব্যবধানে স্বাধীনতা লাভ করল তারই স্বপ্নধৃত বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এমন একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতার জন্যই তিনি ডাক দিয়েছিলেন ১৯৪২ সালে : ‘বাংলা বাঙালির হউক, বাংলার জয় হউক।’ বাঙালিকে মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে যুদ্ধাস্ত্র হাতে নিতে হবে আর তাড়াতে হবে ভিনদেশি দখলদারদের, যাদের তিনি ‘রামা’ বা ‘গামা’ বলেছেন। তার উক্তি : “এই পবিত্র বাংলাদেশ/বাঙালির?আমাদের/ দিয়া প্রহারেণ ধনঞ্জয়/তাড়াব আমরা, করি না ভয়/যত পরদেশী দস্যু ডাকাত/ ‘রামা’দের, ‘গামা’দের।” আরো স্মরণ করা যেতে পারে, ‘জয় বাংলা’ শীর্ষক বাঙালির চিরকালের জয়ধ্বনিও প্রথম তার কণ্ঠেই উত্থিত। তার ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থের ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘জয় বাংলা-র পূর্ণ চন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তহীন’। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার দশক পরে আজ পুরো বিষয়টিকে কেমন যেন অভাবনীয় মনে হয়। কিন্তু সেই অভাবিত-পূর্ব ধারণা ও তাকে বাস্তবে রূপদানের কর্ম-ভিত্তি প্রণয়ন করেছিলেন একজন কবি। সেই কবি জন্ম-স্বাধীন, জন্ম-যোদ্ধা ও জন্ম-বিজেতা এক ব্যক্তিমানুষ, জাতিমানুষ ও বিশ্বমানুষ। এভাবেই মাত্র ২২ বছর বয়সের এক বিদ্রোহী কবি তিরিশ বছর বয়সেই ‘বাঙালির জাতীয় কবি’। আর ৭২ বছর বয়সে জাতিরাষ্ট্র ‘বাংলাদেশের জাতীয় কবি’। অতঃপর জন্মশতবর্ষে এসে ‘বিশ্ব বাঙালির কবি’। আর সেই একই কবি একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে এসে পৃথিবীব্যাপী ভারসাম্যময় মানবমুক্তির প্রবক্তা হিসেবে সর্বমানবিক এক বিশ্বকবির অভিধায় নন্দিত ও বরিত। কিঞ্চিদধিক চার দশক তার সচেতন ও সৃষ্টিশীল জীবন। যতই দিন যাচ্ছে সাহিত্য-সঙ্গীতসহ তার এই বহুমাত্রিক সৃষ্টির নানাকৌণিক বিশ্লেষণ পরিব্যাপ্ত হচ্ছে। উন্মোচিত হচ্ছে তার বিরোধহীন মানবসাধনার প্রতিকৃতি। আর তিনিও উত্তরোত্তর শনাক্ত হয়ে চলেছেন আমাদের কালের সর্বাধিক অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি, আপসহীন যোদ্ধা ও নান্দনিক স্রষ্টা হিসেবে। বাংলার সব সম্প্রদায়, ভাষিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, আচার-বিশ্বাসের বিভিন্নতা ও বহুমুখিনতাকে মাঠ পর্যায়ে বীক্ষণ, অনুধাবন ও ঐক্য সূত্রে গ্রন্থনের কাজটি তার মতো আর কোনো বাঙালি কবি আজ অবধি সম্পন্ন করেছেন কিনা আমাদের জানা নেই। বলা বাহুল্য, নজরুল তার এই ব্যক্তিক ও সামষ্টিক ভূমিকা সম্পর্কে বরাবরই সচেতন ছিলেন। পৃথিবীব্যাপী সর্বমানবিক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকৃত এই কবির কাছে মানব ঐক্যের আরেক নাম অভেদ-সুন্দর। ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র জুবিলি উৎসবে সভাপতির ভাষণে তিনি এই প্রসঙ্গটি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। এটিই ছিল তার সর্বশেষ ভাষণ। নিজের ভূমিকা সম্পর্কে তার স্পষ্ট স্বীকারোক্তি : “আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি?আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম নিতে এসেছিলাম?সেই প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম। হিন্দু-মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব?অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তূপের মতো জমা হয়ে আছে? এই অসাম্য এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম, আমার কাব্যে, সঙ্গীতে, কর্মজীবনে অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম? অসুন্দরকে ক্ষমা করতে, অসুরকে সংহার করতে এসেছিলাম? তোমরা সাক্ষী আর সাক্ষী আমার পরম-সুন্দর।” নজরুল যে ১৯৪২ সালের পর অসুস্থ হয়ে দীর্ঘ ৩৪ বছর নীরব ছিলেন তার একটি ব্যাখ্যাও এখানে আভাসিত হয়ে আছে। এই নীরবতার কারণ একদিকে তার অসুস্থতা, অন্যদিকে অভিমান ও স্থায়ী প্রতিবাদ। বাঙালি এমন কবি আগে দেখেনি। না, কোনো তুলনা নয়। কেননা নজরুল তুলনীয় কেবল নজরুলের সঙ্গেই। তার আগে তার মতো বিদ্রোহ ছিল না, তার মতো কাব্যভাষা ছিল না, তার মতো নান্দনিকতা ছিল না, তার মতো সর্বমানবিকতা ছিল না, তার মতো জাতি ও সর্বজাতির মধ্যে ন্যায়ভিত্তিক সম্পর্কের ধারণা ছিল না? অন্তত এই বাঙালিসমাজে। নর নয়, নারী নয়, নজরুলের পক্ষপাত মূলত অভিন্ন মানবসম্প্রদায়। জগদব্যাপী শোষিত মানুষের জয়গান গেয়েছেন তিনি, সেই সঙ্গে বন্দনা করেছেন নারী স্বাধীনতার। তার ‘নারী’ শীর্ষক কবিতাটি পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ ফেমিনিস্ট টেক্সট। ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ মানবিক মুক্তির এমন ঘোষণা সহজলভ্য নয়। বলা যেতে পারে, এমন মুক্তমানবও আজ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ করেনি এই বাঙালিসমাজ। সে কারণে আজো তিনি বাঙালিত্বের অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত। আমাদের প্রতিটি ব্যক্তিক ও সামষ্টিক সংকটে তিনিই আমাদের সম্ভাব্য উদ্ধার। নজরুলকে সরকারি-বেসরকারি তাবৎ আনুষ্ঠানিকতা ও বাকবিলাসিতা থেকে মুক্ত করে গণবাঙালির কল্যাণে নবায়ন ও অনুসরণযোগ্য করে তোলাই আজকে আমাদের পবিত্র কর্তব্য। এজন্য প্রয়োজন নজরুলকে প্রতিনিয়ত পাঠ, পুনর্পাঠ ও অনুধাবন। ভুললে চলবে না, দারিদ্র্যের মধ্যে যার জন্ম, আর দারিদ্র্য যাকে খ্রিস্টের সম্মান দিয়েছে, সেই নজরুল এই বাংলার হতদরিদ্র মানুষেরই নিকটতম স্বজন। ক্ষমতা নয়, তার লক্ষ্য সদাচার ও সুবিচারবাহিত মানব-মমতা। তার পক্ষপাত দেশজাতি ও বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত জনতা। জয় হোক সেই জনতার। জয় হোক সেই মমতার। জয় হোক নজরুলের সেই সর্বমানবিক কবিসত্তার। আর এই জয়ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ুক ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে। পরিপূর্ণ নান্দনিক ও মাঙ্গলিক হয়ে উঠুক তারা। তারা যেন নজরুলের কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘আমি হব সকালবেলার পাখি,/সবার আগে কুসুমবাগে উঠব আমি ডাকি।’ এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে পুনর্জন্ম নিক নজরুলের অভেদ-সুন্দর।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App