×

সাময়িকী

নজরুলের সৃষ্টিসত্তা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০১৯, ০৯:৫০ পিএম

নজরুলের সৃষ্টিসত্তা

কবি ভবনে কাজী নজরুল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ১৯৭২

কাজী নজরুল ইসলাম বিস্ময়কর এক দ্রোহী সত্তার নাম। রবীন্দ্র প্রতিভার দ্যুতি-দীপ্তিতে যখন বাংলা সাহিত্যের ভুবন ছিল আলোকোজ্জ্বল, ঠিক তখনই বিদ্রোহী কবি নজরুলের ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব। যিনি রবীন্দ্র বলয়ের প্রভাবমুক্ত হয়ে বাংলা সাহিত্যকে প্রথম দেখিয়েছিলেন নতুন পথের দিশা। সৃষ্টি করেছেন এক স্বতন্ত্র ধারা। অমরত্বের আকাক্সক্ষা নিঃসঙ্কোচে পরিহার করে আজীবন সংগ্রামে, প্রেমে নিজেকে উজাড় করেছেন সার্বজনীনতায়। সবার হৃদয়ের অলিন্দে রবীন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার কাজী নজরুল ইসলাম। বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, চেতনা, মননে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বহমান। প্রেম, দ্রোহ, সংগ্রাম, সাম্য, মৈত্রী, অসাম্প্রদায়িকতা এবং মানবতার প্রতিটি বলয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামের শুভবোধ ও অনাবিল প্রতীতি। কবি প্রতিবাদের আগুনে যেমন জ্বেলে দিতেন বিদ্রোহী পূর্ণিমা তেমনি প্রেম ও মানবতায় জেগে উঠতেন বারবার। তিনি ছিলেন দ্রোহ, বিপ্লব, বিধ্বংসী চিন্তা-চেতনায় সমৃদ্ধ এক নতুন ধারার কবি। মাত্র বাইশ বছরের সাহিত্য সাধনায় বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাকে তিনি তাঁর অফুরান সৃজনশৈলীতে সমৃদ্ধ করেছেন। কাব্যধারায় নজরুল সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেই বাংলা সাহিত্যে কিংবদন্তির আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে পরিণত হয়েছেন কালের অগ্নিবীণায়। জন্মেই তিনি অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে নিখাদ দেশচেতনা নিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন। নিজের দুঃখ-দুর্দশার চাইতেও দেশের পরাধীনতা তাঁকে খুব পীড়া দিয়েছিল। সমাজ বাস্তবতার অমানবিক বৈষম্য, পাশবিক সাম্প্রদায়িকতা, নির্মম শোষণ আর ব্রিটিশের নজিরবিহীন অত্যাচার-অপশাসনের বিরুদ্ধে দ্রোহের শব্দাবলিতে সাহিত্যকে করে তুলেছিলেন এক স্বতন্ত্র শক্তিশালী উচ্চকণ্ঠের মাধ্যম। তিনি তাঁর সবটুকু উজাড় করে দিয়ে বৈষম্যহীন এক সর্বাত্মক মানবতাবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার চেতনায় সৃষ্টি করেছেন তাঁর সাহিত্য, গান; প্রেমে এবং দ্রোহে। অগ্নিব্রতী নজরুল দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, ভিনদেশীর শাসনে অত্যাচারিত, উৎপীড়িত ও অসহায়ের জন্য, শোষিত জনগণের জন্য তাঁর সকল বিদ্রোহ জীবনব্যাপী সংগ্রামে প্রকাশ করেছেন বজ্রশপথদীপ্ত নির্মোহ উচ্চারণে। চেতনায় উজ্জীবিত কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতা ও গান দিয়ে জাগিয়ে তুলেছিলেন বাঙালিকে। তিনি একাধারে বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি সর্বোপরি শোষিতের কবি। বোহেমিয়ান জীবনযাপনের পরও নজরুলের পৃথিবী বিবর্ণ হয়ে ওঠেনি। বরঞ্চ নজরুল তাঁর লেখনী দিয়ে জাগরণ সৃষ্টি করেছেন। তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। গভীর মানবতাবোধই ছিল তাঁর অন্তর্গত দায়বদ্ধতা। জাতিভেদকে তিনি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করতেন। নজরুলের বিশ্বাসের গভীরে ছিল মানুষ। মানুষকে দেখেছেন সবার উপরে। আর সে কারণেই তিনি মানুষের বিভেদ সৃষ্টিকারী দেয়াল ভাঙতে চেয়েছিলেন। তিনি নিপীড়িত সাধারণ মানুষের প্রগতি চেয়েছেন, পিছিয়ে পড়াদের জাগাতে চেয়েছেন, চেয়েছেন ইংরেজ শাসকদের হটিয়ে দিয়ে উপমহাদেশের মানুষের স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করতে। তিনি ছিলেন সকল সংগ্রামে, সকল সংগ্রামীর অন্তরে, অত্যাচারিতের এবং দুর্বলের পাশে। তিনি গেয়েছেন মানুষের জয়গান। মানবতাবাদে নিখাদ বিশ্বাস ছিল বলেই সমকালীন ভারতের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় তিনি ব্যথিত হয়েছেন। তাঁর প্রাণে ছিল তারুণ্যের স্পর্ধিত উল্লাস। নজরুল হয়ে উঠেছিলেন গণমানুষের কণ্ঠস্বর। তাঁর কবিতা, গানে কিংবা যে কোনো লেখায় প্রকাশ পেয়েছে সাম্যের কথা, অসাম্প্রদায়িক এবং বৈষম্যহীন এক সমাজের কথা। মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। তিনি সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে অসাম্প্রদায়িক কবিতা লিখেছেন। সাম্যবাদী বলেই কবি অসাম্প্রদায়িক হতে পেরেছিলেন সাম্প্রদায়িকতা আর ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে মুক্তির উৎস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন তিনি। সকল মানুষকে শুধু মানুষ পরিচয়ে তিনি দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি বলেছিলেন- ‘সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি/এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শুন এক মিলনের বাঁশী’। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ও তাদের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। যা বজ্রের ন্যায় কঠিন। তাঁর লেখনীর মূলে ছিল মানুষ ও মানবতার জয়গান, স্বাধীনতা ও মুক্তির চেতনা। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করেননি তিনি। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার-অনাচার কখনো সহ্য করেননি। শোষিতের ওপর শাসকের শোষণ-নিপীড়ন প্রতিহত করার লক্ষ্যে সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে সোচ্চার ছিলেন। তাঁর দ্রোহ ছিল বুকের গহীন গভীর থেকে উৎসারিত। অবহেলিত-অপমানিত, নির্যাতিত-বঞ্চিত মানুষ তাঁর দ্রোহের অনির্বাণ শিখায় জ্বলে উঠেছে বজ্রশপথে। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কূপমণ্ডূকতা, রক্ষণশীলতা, কুসংস্কার এবং ধর্মীয় আচার-আচরণ সর্বস্বতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ছিলেন নজরুল। তাঁর আবির্ভাবের সময়টা ছিল মধ্যবিত্তের জাগরণের কাল। এই জাগরণে একটি স্বপ্ন, মুক্তি ও আত্ম উন্নয়নের আকাক্সক্ষা থাকে। নজরুলের জীবনে ও কর্মে এই বাসনা ও আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। তিনি মুক্তির বাসনায় ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, বিদ্রোহ করেছেন সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে। নজরুল সাহসের উচ্ছ্বাসে বলেছিলেন- আমি সূর্যের আলো হয়ে এসেছি। আমি হিন্দু-মুসলমানের জন্য আসিনি। আমি এসেছি মানুষের জন্য। নজরুলের মানবতাবাদী ভাবনায় তাঁর জীবনাদর্শের ভিত্তি গড়েছেন। মানবিক চেতনাতেই তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মানব মৈত্রী, সম্প্রীতির মেলবন্ধন গড়তে চেয়েছেন পরম ঔদার্যে। বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষকে নিয়ে তিনি নির্মাণ করতে চেয়েছেন বাঙালির এক বৃহত্তর সমাজ। নজরুল সময়কে ধারণ করে বৈশ্বিক পরিবর্তনের ঘটনাপ্রবাহে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন এবং তাঁর কবিতায়, গানে, প্রবন্ধে, উপন্যাসে প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তাই নজরুল অসাধারণ নৈপুণ্যে বাঁধনহারার মতো কালজয়ী উপন্যাস সৃষ্টি করেছেন অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, ভাঙ্গার গান ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে ব্রিটিশের ভিত কাঁপিয়ে দিতে রাজবন্দির জবানবন্দি এবং বিদ্রোহী কবিতার মতো কালজয়ী সাহিত্যকর্ম। নজরুল নান্দনিক সৃষ্টিসত্তা দিয়ে শোষিত-নিপীড়িত মানুষের আর্তি ও আর্তনাদকে কবিতার ছন্দের মাঝে প্রকাশ করেছেন। অগ্নিযুগের দাহ তাঁর কলমকে ক্রমাগত উদ্দীপিত করছে আগুন ঝরানোয়। সে জন্যই হয়তো লিখেছিলেন- ‘রক্ত ঝরাতে পারিনে তো একা,/তাই লিখে যাই এ রক্ত লেখা/অমর কাব্য তোমরা লিখিয়ো,/বন্ধু যাহারা আছ সুখে।’ তাঁর সৃষ্টিতে প্রতিবিম্বিত হয় কালের বয়ান। নজরুলের প্রতিভা অতিক্রম করেছে কালের সীমানা। নজরুল হয়ে আছেন কালোত্তর। বিদ্রোহী কবিতায় কাব্যিক অভিপ্রকাশ ঘটেছে তাঁর আত্মবোধনের উন্মাদনায় স্বাধীনসত্তার। এ কবিতাতেই চিরবিদ্রোহীর মহাউত্থান ঘটেছে, কাউকে কুর্নিশ না করার কথা বলা হয়েছে এবং এভাবে স্বাধীনসত্তার চিরকালীন মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নজরুল অগ্নিযুগের কবি, স্বাধীনতার বিপ্লবে বিদ্রোহী মন্ত্রের সৈনিক। আগুন নিয়েই তাঁর খেলা। আগুন নিয়েই তাঁর কাজ। কবিতার পথে হাঁটবেন তিনি ওই আগুনের ঝান্ডা হাতে। নজরুলের দৃষ্টিতে ধূমকেতু হলো আগুনের পতাকা। নজরুল কাব্যে আগুনের ব্যঞ্জনা লক্ষ করার মতো। প্রচণ্ডতা, ভয়ঙ্করতা, তীব্রতা, ধ্বংস, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং অবশ্যই বিদ্রোহ, সহজেই আগুনের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। তাই বিদ্রোহীর আত্ম-উদ্বোধনে অগ্নিকেতন উড়িয়েছেন অনায়াসে- ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু/ ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন’.... আমি হোম শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,/আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।/আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ববহ্নি, কালানল;/আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার-কলরোল-জল-কোলাহল। ভাঙ্গার গানেও তাঁর অগ্নিবীণা বাজে। পরাধীনতার কারাগারকে লাথি মেরে ভেঙে ফেলার জোর ঘোষণায় কবিতাটি শেষ হয় বটে, কিন্তু আমাদের চেতনায় তা চির অগ্নি-উন্মাদনা জাগিয়ে দেয়- ‘লাথি মার, ভাঙরে তালা।/যত সব বন্দী-শালা/আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা, .........।’ স্বদেশানুভূতি, চিন্তা, ভাবনা, কর্তব্যকর্ম, মুক্তির শপথ, উজ্জীবন, জাগরণ সবই তো অগ্নিবীণার সুর। বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে নজরুলই ছিলেন অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ। প্রকাশ করেছেন বিদ্রোহীর মতো অতুলনীয় কবিতা ও ভাঙ্গার গানের মতো বিখ্যাত কাব্য, ধূমকেতুর মতো জ্বালাময়ী সাময়িকী। ব্রিটিশ শাসকের কারাবন্দি হয়ে লিখেছেন রাজবন্দির জবানবন্দির মতো নির্ভীক ও সাহসী সাহিত্যকর্ম। তার সৃষ্টিকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল যেমন প্রবল, তেমনি পরাধীন ভারতবাসীর স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাক্সক্ষা ছিল দুর্বার। ন্যায় ও সাম্যের আবাহনে তিনি ছিলেন অক্লান্ত-অবিরাম। তাঁর অগ্নিঝরা কবিতা প্রজ¦লিত করেছে সাম্যবাদী চেতনা, কখনো জুগিয়েছে ন্যায্য অধিকারের প্রেরণা। নজরুল তাঁর জীবদ্দশাতেই পেরিয়ে গেছেন অমরত্বের শিখর। সীমিত কর্মময় জীবনে একক হাতে সঙ্গীত ও সাহিত্য উভয় শাখাকে সমৃদ্ধ করেছেন নজরুল। অথচ নজরুলের উত্থান হয়েছিল রবীন্দ্রযুগে। তারপরও কী অপূর্ব দক্ষতায় আর স্বকীয়তায় গান রচনা করেছিলেন এই স্রষ্টা! রবীন্দ্রনাথ-নজরুল নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক না, বাস্তবে তাঁদের দুজনের মাঝে ছিল প্রগাঢ় পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার সম্পর্ক। নজরুল তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘সঞ্চিতা’ উৎসর্গ করেছিলেন তাঁরই শ্রদ্ধাভাজন পরমপ্রিয় কবিগুরুকে। আবার কবিগুরুও তৎকালীন কবি-সাহিত্যিকদের মাঝে সবচেয়ে স্নেহভাজন এই পরম ভক্ত নজরুলকে আদর করে ডাকতেন ‘উন্মাদ’ বলে। এমনি ভালোবাসার অচ্ছেদ্য বাঁধনে বাঁধা ছিল দুই কবি-হৃদয়। বাংলা সাহিত্যে নজরুলের অবস্থান ও দানকে রবীন্দ্রনাথ যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মানসলোক তাঁর একটি গানে চমৎকারভাবে প্রকাশ পেয়েছে। গীতবিতানের প্রকৃতি পর্যায়ের একটি গানে তাঁর অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে- ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,/তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান...।’ ‘কান পেতেছি, চোখ মেলেছি, ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি,/ জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান/বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বসন্ত’ কাব্যনাট্যখানি কবি কাজী নজরুল ইসলামকে উৎসর্গ করেন। বসন্ত কাব্যনাট্যখানির একটি কপি আলীপুর জেলে বন্দি নজরুলের হাতে পৌঁছে দেয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ উদগ্রীব ছিলেন এবং অবশেষে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়ে পৌঁছান। নজরুলের হাতে বসন্ত কাব্যনাট্যখানা পৌঁছালে নজরুল তা কপালে ঠেকিয়ে বুকে চেপে ধরেন। রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে কবিপ্রতিভার স্বীকৃতি পাওয়াটা ছিল নজরুলের জন্য এক দুর্লভ প্রাপ্তি। এই প্রাপ্তি তাঁর জেল জীবনের জ্বালা-যন্ত্রণা এবং অনশন-ক্লেশ দূর করে দেয়। এরই প্রেরণায় নজরুল রচনা করেন তাঁর অমর কবিতা আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। বিশ্বকবির প্রতি নজরুলের শ্রদ্ধা-ভালোবাসার খবর রবীন্দ্রনাথের অজানা ছিল না। রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই নজরুলকে কবি হিসেবে সম্মান দিয়েছেন। তাঁর কলম থেকে যা বেরিয়েছিল তা তাঁর অন্তরের উপলব্ধি- জীবন সংগ্রামে পোড় খাওয়া আত্মার অকৃত্রিম অনুভব। নজরুলের আত্মার ভেতরে সত্য ও সুন্দর গল্প হয়ে, কবিতা হয়ে, গান হয়ে, সুর হয়ে, ছন্দ হয়ে শিল্পরূপ লাভ করেছিল। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈনিকের সাজে কলকাতায় এসে নবযুগে, ধূমকেতুতে, লাঙলে, গণবাণীতে নজরুলের লেখায় সত্য, সুন্দর ও ন্যায় রুদ্র তেজে বিপ্লব ও বিদ্রোহের বাণী হয়ে প্রকাশ পায়। সাহিত্য যে নতুন দিকে বাঁক নিতে যাচ্ছে; সমাজ ও সভ্যতার যে রূপান্তর ঘটতে চলেছে তার সুস্পষ্ট আভাস টের পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর নজরুল যে সেই অনাগত কালের সাহিত্যধারার প্রতিভূ হতে চলেছেন সেটাও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তাঁর ভক্তরা কে কি মনে করল না করল সেসব উপেক্ষা করে তিনি নজরুলকে তাঁর আশীর্বাদের মালা পরিয়ে হৃদয়ের বিশালত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। অনুজের প্রতি অগ্রজের এই ভালোবাসা আজো ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। নজরুলের প্রেম ছিল মানুষের মানবিক প্রেম। নজরুল ভালোবেসেছিলেন মাটি আর মানুষকে। এই ধরণীর মাটি-মানুষের প্রতি গভীর প্রেমকে ঘিরেই নজরুলের সারা জীবনের সব আয়োজন আবর্তিত। জীবনের সর্বশেষ অভিভাষণে অভিমান ক্ষুুব্ধ নজরুল ঘোষণা করেছেন, বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি। আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম। নজরুল আজো মিশে আছেন আমাদের জীবনের প্রতিটি ছন্দে, সাহিত্যের ভাঁজে ভাঁজে, সম্প্রীতির গভীরতায়। প্রবল স্বাধীনতা প্রত্যাশী আবেগ-উদ্দীপ্ত নজরুল যে পটভূমি ও প্রেরণায় কবিতা নির্মাণ করেছেন এবং জ্বালাময়ী গদ্য, নিবন্ধ, রচনা লিখেছেন তাতে অগ্নিই হয়ে উঠেছে তাঁর মুক্তিমন্ত্র দেশের গণমানুষের জন্য। সৃষ্টি আর চেতনার মিশেলে বিদ্রোহী নজরুল যে দ্রোহের অগ্নিবীণা বাজাবেন এটা স্বতঃসিদ্ধ এবং নিজেও আমাদের মাঝে কালের অগ্নিবীণা হয়ে সুখের উল্লাসে দীপ্যমান থাকবেন। ১৯২০ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত নজরুলের সাহিত্যকর্মের ব্যাপ্তিকাল। এ স্বল্প পরিসরে তিনি যে সাহিত্যকর্ম উপহার দেন তা কালোত্তীর্ণ। সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতিটির মাধ্যমে কবি নজরুল চিরভাস্বর। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেন তাঁর কবিতা, গানের কথার মতোই আমাদের কাছে প্রেরণার আধার, চেতনার সূতিকাগার। বিপ্লবে শক্তি জোগাতে, সংগ্রামে এগিয়ে যেতে হতাশাগ্রস্তদের মনে আশার আলো জ্বালান কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি যতদিন থাকবে ততদিন কবি নজরুল চির অমর চির অক্ষয় হয়ে থাকবেন। তাঁর কবিতা ও গানের পঙ্ক্তিমালার ভেতর দিয়ে আজো জাতির ক্রান্তিকালে অশুভবিনাশী শক্তিরূপে তিনি আমাদের মাঝে উপস্থিত হন। সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতিটির মাধ্যমে কবি নজরুল আজো চির ভাস্বর, চির অম্লান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App