×

মুক্তচিন্তা

পাক-ভারত সংকট ও এশিয়ার পথচলা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০১৯, ০৭:৪৮ পিএম

পাক-ভারত সংকট ও এশিয়ার পথচলা
পাক-ভারত সংকট ও এশিয়ার পথচলা

এশিয়া মহাদেশ তো বটেই, সর্বোপরি দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রঙ্গমঞ্চে অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে চলেছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন এশীয় দেশের যে উন্নয়নের গতিধারা লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে তা যে ব্যাপকভাবে আশা জাগানিয়া সে বিষয়ে কারোর মনেই কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। এশিয়াকে আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের ভরকেন্দ্রে পরিণত করতে হলে চাই সংশ্লিষ্ট এলাকার সব দেশের আন্তরিক ও সম্মিলিত প্রয়াস।

কাশ্মিরকে ঘিরে আবার ধুন্ধুমার কাণ্ড শুরু হয়েছে। ভারত তাদের জম্মু ও কাশ্মিরের ব্যাপারে সংবিধানে প্রণীত বিশেষ মর্যাদাবিষয়ক ৩৭০ বিলটি সম্প্রতি বাতিল করায় উপমহাদেশে- বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে চাঞ্চল্য ও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। লাদাখের ব্যাপারেও ভারত অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করায় পরিস্থিতি যে খানিক ঘোলাটে রূপ ধারণ করেছে তাতো বলাই বাহুল্য! কাশ্মির এতকাল ওই বিলের বদৌলতে একটি বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা পেয়ে আসছিল কিন্তু সেটি বাতিলের ফলে সেই মর্যাদা আর রইল না, যদিও কাশ্মির বিধানসভাটি এ ক্ষেত্রেও বহাল রাখার ব্যবস্থা থাকছে তথাপি রাজ্যটি এখন থেকে সরাসরি কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে ন্যস্ত হলো। কাশ্মির সমস্যা তো সেই উপমহাদেশ বিভাগ-পূর্বকালীন থেকে শুরু। এর সমাধানের ব্যাপারে এ যাবৎকাল কত রকম কথাবার্তাই না শোনা গেল, কিন্তু সমাধান সে যে তিমিরে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামেও এ বিষয়ে সমাধান খোঁজার চেষ্টাও তো কম হয়নি কিন্তু তাতেও লাভের মুখ দেখেনি কেউ। এই কাশ্মিরকে ঘিরে সেখানে ভয়াবহ সব জঙ্গি বাহিনীও গড়ে উঠেছে আর ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে প্রায়ই সহিংস হানাহানিতে জড়িয়ে পড়ছে তারা। এই অবস্থা চলছে সেখানে সে আজ হলো কতকাল! ভারত জঙ্গি দমনে বিভিন্ন সময়ে মারাত্মক নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করায় উভয়পক্ষে তিক্ততা ও শত্রুতা বেড়েই চলেছে। পাকিস্তান কাশ্মিরের একাংশ জয় করে আজাদ কাশ্মির নাম দিয়ে বাকি অংশ দখলের জন্য সদা তৎপর। অন্যদিকে ভারত কাশ্মিরের বাকি অংশের কর্তৃত্ব এই উপায়ে ছাড়তে নারাজ। ফলে উভয় কাশ্মিরেই মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে যাচ্ছেতাইভাবে। উভয় দেশের মধ্যে সাত দশকের বেশি সময় ধরে যে সংকট চলছে তা নিরসনের ব্যাপারে ইতোপূর্বে দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ফোরাম এমনকি কোনো কোনো পরাশক্তিও মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সমাধান আসেনি। কাশ্মিরকে ঘিরে দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকবার যুদ্ধ হলেও সমাধানের পথটি সেই ‘দিল্লি হনু দুরস্ত’-এর মতোই রয়ে গেছে। কাশ্মিরের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় এটিই অধিকাংশ দেশের নির্ণয়। যদিও চীন এ ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করছে এবং কোনো কোনো দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে একত্রে বসে সমস্যাটির সমাধান করতে আহ্বান জানিয়েছে তথাপি এই বরফ খুব সহজে গলবে সে ভরসা বোধকরি মিছে! কেননা, এই সমস্যাটির রয়েছে নানামুখী ডাইমেনশন আর সেসব ডাইমেনশন আমলে নিয়ে সহজ সমাধান খোঁজা খুব সহজসাধ্য নয়। ৩৭০-এর বিলুপ্তি ন্যায়সঙ্গত কিনা তা নিয়ে দীর্ঘ বিবাদ-বিসম্বাদ, যুক্তি-তর্ক ও আলাপ-আলোচনা চালানো যেতে পারে বটে, কিন্তু তাতে করে বিবদমান পক্ষগুলো সহজে সব মেনে নেবে বা নিতে পারবে এমন পরিস্থিতি দৃশ্যমান নয় এখনো। এ জন্য উভয়পক্ষেরই যে ঔচিত্যবোধ, আন্তরিকতা, পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার পরিচয় দেয়া দরকার তা দিতে কোনো পক্ষই খুব একটা প্রস্তুত নয়। সুতরাং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই এ জন্য আরো কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে বৈকি! এশিয়ার সবাই মিলে একটি সমৃদ্ধ ও অর্থপূর্ণ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে এই জাতীয় বিবাদের যে অবসান হওয়া উচিত সেই উপলব্ধি বিবদমান সব পক্ষের মধ্যে আন্তরিকভাবে সঞ্চারিত না হওয়া পর্যন্ত এই সংকটের প্রকৃত সমাধান দুরূহ, দুষ্কর ও অসম্ভবপ্রায়ও বটে! ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিক থেকেই পাকিস্তানভিত্তিক নানামুখী সশস্ত্র গ্রুপগুলো ভারতের জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যে সক্রিয় এবং এদের পরিচালিত ব্যাপক সহিংসতার প্রামাণ্য দলিল-দস্তাবেজ রয়েছে প্রচুর। এরা অপহরণ, বেসামরিক লোকদের হত্যা ও ধর্ষণসহ বিভিন্ন প্রকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ৪টি প্রধান সশস্ত্র গ্রুপ ওই অঞ্চলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করা হয়। এগুলো হলো : লস্করে তৈয়বা, জয়েশে মোহাম্মদ, হিজবুল মুজাহিদীন ও হারকাত উল মুজাহিদীন। এসব ক’টি সন্ত্রাসী গ্রপের অবস্থানই পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মিরে। ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলুয়ামায় ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর যে আত্মঘাতী বোমা হামলাটি চালানো হয় তার দায়দায়িত্ব স্বীকার করেছিল ‘জয়েশে মোহাম্মদ’। যাহোক, ওই প্রতিবেদনটিতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পাকিস্তান সম্ভবত দা’য়েশ, আলকায়েদা, জামাত উদ দাওয়া, ফালাহ-ইনসানিয়াত ফাউন্ডেশন, লস্করে তাইয়েবা, জয়েশে মোহাম্মদ, হাক্কানি নেটওয়ার্ক এবং তালিবানের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের অর্থ জোগানের বিষয়টিকে খুব আমলে নেয় না অথচ এই বিষয়টিকে বিশেষভাবে আমলে নেয়াটা তাদের নিজেদের স্বার্থেই অত্যন্ত জরুরি। সে যাক, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের বিষয়ে নতুন নতুন এক একটি মাত্রা যোগ হওয়ার যে প্রবণতা সদা বিদ্যমান তাতে করে এই উভয় দেশের অর্থনীতি ও সমৃদ্ধির পথে তা বিশেষ বাধার কারণ হয়ে দেখা দেয় সর্বদা। কিন্তু এরপরও এই অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি লাভের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ- বিশেষ করে পাকিস্তানের তরফ থেকে নিতে দেখা যায় না, বরঞ্চ বৈরিতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখাটাই যেন তাদের একান্ত কাম্য! এ ক্ষেত্রে এখানে আরো উল্লেখ করা দরকার যে, পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে যে সমস্যা চলছে তার পেছনে ভারতীয়দের হাত থাকার অভিযোগ তুলে কতিপয় পাকিস্তানি বন্দুকধারী গ্রুপ বেশ কিছুকাল আগে ভারতীয় নাগরিক কুলভূষণ যাদবকে জোরপূর্বক পাকিস্তানে নিয়ে যায় এবং গোপনে সামরিক আদালতে সংক্ষিপ্ত বিচার করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। ইতোমধ্যে অবশ্য পাকিস্তান ২০১৭ সাল থেকে এ অবধি এই জাতীয় প্রহসনমূলক সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে বিচারের মাধ্যমে কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরও করেছে। ভারত তার একজন বেসামরিক নাগরিকের বিচার সামরিক আদালতে এবং অতি সংগোপনে করে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করার অভিযোগ উত্থাপন করে পাকিস্তানকে আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে এমনি একতরফা বিচার ও মৃত্যুদণ্ড প্রদানের পথ রুদ্ধ করতে সক্ষম হয়। প্রথমত পাকিস্তান কুলভূষণের আটকের বিষয়টি ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করে ও তাকে ভারতীয় কনস্যুলেট দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগের কিংবা কোনো প্রকার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশনে উল্লিখিত বাধ্যবাধকতার এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক রীতিনীতির চূড়ান্ত বরখেলাপ করে। উল্লেখ্য, পাকিস্তান সেখানে তার ইরান সংলগ্ন সীমান্ত এলাকায় নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। সেখানে তারা জইশ আল আদি নামক উগ্রবাদী গ্রুপকে ইরানের বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়ে যাচ্ছে। ইরানি কর্তৃপক্ষ ওই সীমান্তবর্তী এলাকায় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালানোর অভিযোগ করে আসছে। এদিকে সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জানায় যে, জৈয়শ আল আদি হচ্ছে বিশেষভাবে গড়ে তোলা কুখ্যাত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী দল জুন্দুল্লাহর একটি ফ্রন্ট। যাই হোক, ভারত কুলভূষণের বিষয়টিকে আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের পক্ষে সমর্থন আদায়ের ব্যাপারে সম্প্রতি সফল আইনি লড়াই ও কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে। ওদিকে আবার ভারতের সঙ্গে নতুন করে হানাহানি ও সহিংসতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে পাকিস্তান সব সময়ই এক পায়ে যেন খাড়া হয়ে থাকে! পাক-ভারত সম্পর্কের এই টানাপড়েনের পেছনের ইতিহাস খুবই জটিল। কাশ্মির যেমন এর অন্যতম প্রধান একটি উপাদান তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সক্রিয় সহযোগিতা, পাকিস্তানে জঙ্গিবাদের প্রবল-প্রচণ্ড উত্থান, আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানি এজেন্ডা বাস্তবায়নের নানাবিধ জারি-জুরি দেশ দুটির মধ্যে এমনই তিক্ত সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে যা কিনা এক কথায় কর্তব্যই নয়! যাহোক, কাশ্মিরের এই নতুন পরিস্থিতি নিয়ে পরে অন্য একটি নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছে রইল। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামগ্রিক সম্ভাবনাময় পরিস্থিতির ওপর খানিক আলোকপাত করা যাক। এশিয়া মহাদেশ তো বটেই, সর্বোপরি দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রঙ্গমঞ্চে অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে চলেছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে চীন, ভারত, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন এশীয় দেশের যে উন্নয়নের গতিধারা লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে তা যে ব্যাপকভাবে আশা জাগানিয়া সে বিষয়ে কারোর মনেই কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু এই সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন ধারাকে স্থিতিশীল ও টেকসই করে তোলার পথে পথে আবার ছড়িয়ে রয়েছে নানাবিধ বাধাবিপত্তি। দেশে দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান, প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির পোয়া বারো অবস্থা এবং হানাহানি, হিংসাদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তর বিস্তার ইত্যাদি ওই বাধা-বিপত্তিরই নামান্তর! বিশ্বের ক্ষমতার ভারসাম্যও যে আজ এশিয়া অভিমুখী এ সত্যকেও আর অস্বীকার করা যাবে না নিশ্চয়ই! বিশ্বের মোট জমির ৩০ শতাংশই এশিয়ায়। আর এখানেই বাস করে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ। আবার এই ষাট ভাগের মধ্যে ৩৬ শতাংশের বাস চীন ও ভারতে। এই ৩৬ শতাংশের ৬৫ শতাংশেরই বয়স ৩৫ বছরের নিচে। অর্থাৎ তারুণ্যে টগ বগ করা এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে যদি দক্ষ জন-শক্তিতে রূপান্তরের কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যায় এবং এতদঞ্চলের সংশ্লিষ্ট দেশসমূহ থেকে সাম্প্রদায়িকতা, ভেদাভেদ, হিংসা-হানাহানির পথ রুদ্ধ করা যায় তাহলে সর্ববিচারেই তা হয়ে উঠবে বিশ্বের সবচাইতে আকর্ষণীয় ও সমৃদ্ধ এলাকা। এশিয়াকে আর তখন পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। আর এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এশিয়ার দেশে দেশে চলছে ব্যাপকভিত্তিক কর্মযজ্ঞ। বাংলাদেশের দ্রুতলয়ে সমৃদ্ধির সোপান বেয়ে উপরে যাওয়ার যে ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে তা নস্যাতের জন্য একদিকে যেমন মৌলবাদী তথাকথিত ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি ও জঙ্গিবাদী তৎপরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে অন্যদিকে তেমনি আবার বস্তাপচা পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল ধারাটিকে ফিরিয়ে এনে রাজনীতি ও সমৃদ্ধির পথকে কণ্টাকীর্ণ করার নিরন্তর প্রয়াস দেখা যায় বিএনপি, জামায়াত ও তাদের সঙ্গী-সাথীদের রাজনীতিতে। স্বাধীন বাংলাদেশে কীভাবে যে বাংলাদেশবিরোধী রাজনীতি করা যায় এ এক পরম বিস্ময়- যদিও এর পেছনের কারণগুলোকে আমলে নিলে এর একটি যৌক্তিক মাত্রা খুঁজে পাওয়া যাবে বটে, কিন্তু ওই অপশক্তির এ হেন তৎপরতা বন্ধ করে দিতে আমাদের গা ছাড়া ভাব এবং তৎক্ষণিকভাবে কিছু প্রাপ্তির আশার যূপকাষ্ঠে নিজেদের বলি চড়ানোর মানসিকতা এর জন্য কম দায়ী নয়। এশিয়ায় সমৃদ্ধির জন্য ভারত ও চীনের মধ্যে সমঝোতাসূচক পথ চলা একান্তই বাঞ্ছনীয় আর এই উপলব্ধিবোধ ঐ উভয় দেশের মনে সাম্প্রতিককালে উদিত হওয়ায় অতীতের শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্কের স্থলে সখ্য গড়ে তোলার দিকেই ইদানীং যথেষ্ট মনোনিবেশ করেছে তারা। ভুললে চলবে না যে, চীন হচ্ছে এশিয়ার উৎপাদন কারখানা আর ভারত তথ্য প্রযুক্তির প্রাণ কেন্দ্র; সুতরাং এশিয়ার তথা ওই দেশদ্বয়ের উন্নতি অগগ্রতির চাকাকে নিরন্তর ঘূর্ণায়মান রাখতে সখ্য গড়ে তোলার বিকল্প নেই তাদের। সবাই জানে, পাকিস্তান বরাবরই পাক-ভারত সংঘাতে চীনের সহায়তা পেয়ে এসেছে। এ ছাড়া, পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক অনেক অনেক সমীকরণের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল এতকাল। কিন্তু পাকিস্তানে চীনা ঋণ এবং তার বিনিয়োগ ও পরিণতি বিষয়ে পাক-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্ষাণিক মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়েছিল সাম্প্রতিককালে ফলে উভয় দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটু শ্লথগতি দৃশ্যমান হচ্ছে। এদিকে আবার চীনের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে এশিয়া-আফ্রিকার বেশ কিছু দেশই আজ নানামুখী সংকট ও বিপত্তির মুখে পড়েছে। আর এ কারণে চীনা ঋণের ফাঁদে ধরা দেয়ার আগে তাই এখন ঋণ গ্রহণেচ্ছুদের নতুন করে ভাবনা-চিন্তাও করতে দেখা যাচ্ছে। ঋণ প্রদানের ব্যাপারে চীনের দিল দরিয়া মনোভাব যে কেবলমাত্র সংশ্লিষ্ট দেশের উন্নয়ন-উন্নতি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যেই পরিচালিত এমনটি এখন অনেকেই মেনে নিতে নারাজ! কেননা, এই ঋণ প্রদানের পেছনে চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ ছাড়াও ভূ-রাজনৈতিক তথা কৌশলগত স্বার্থটিও এখন বেশ খোলাসা হয়ে উঠছে বিধায় এ ব্যাপারে নানা মহলে নানা জল্পনা-কল্পনা চলতে দেখা যাচ্ছে। মোদ্দাকথা, এশিয়াকে আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের ভরকেন্দ্রে পরিণত করতে হলে চাই সংশ্লিষ্ট এলাকার সব দেশের আন্তরিক ও সম্মিলিত প্রয়াস। চীন-ভারত, পাকিস্তান-ভারত, বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান-চীন-মিয়ানমার-ভিয়েতনাম-লাওস-কম্পুচিয়া-শ্রীলঙ্কা-নেপাল-ভুটানসহ সবার জন্য অপেক্ষা করছে মহামহিমান্বিত, উন্নত, আনন্দময় ও ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধতর অনেক অনেক শুভ দিন। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমার বাংলাদেশের জন্য গোদের ওপর একটি বিষফোঁড়া হয়ে রয়েছে আর এই ফোঁড়া অপসারণের ব্যবস্থা ওই সব দেশসহ বিশ্বের পরাশক্তিসমূহকে নিতে হবে যদি সত্যি সত্যি একটি সুখময় বিশ্ব আমাদের সবার আরাধ্য হয়!

শাহীন রেজা নূর : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App