×

জাতীয়

উখিয়া-টেকনাফে মগের মুল্লুক গড়েছে রোহিঙ্গারা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০১৯, ১১:০৪ এএম

উখিয়া-টেকনাফে মগের মুল্লুক গড়েছে রোহিঙ্গারা
মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করে রোহিঙ্গারা। বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে এ দেশে। কিন্তু এ দুবছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠাতে পারেনি বাংলাদেশ। উল্টো বাংলাদেশে অবস্থান করে উখিয়া-টেকনাফে পরিবেশ, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসহ সর্বক্ষেত্রে বিপর্যয় ডেকে এনেছে তারা। দখল করে নিয়েছে হাজার হাজার একর জমি, জড়িয়ে পড়ছে খুনসহ বিভিন্ন অপরাধে। এসব নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও অস্থিরতা বিরাজ করছে স্থানীয়দের মধ্যে। যেকোনো সময় আইনশৃঙ্খলা খাতে বড় বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, রোহিঙ্গারা আসার পরে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার জন্য তারা নিজেদের খেয়াল-খুশি মাফিক সব কিছু করে যাচ্ছে। বনাঞ্চলের পাশাপাশি দখলে নিয়েছে হাটবাজার। মানবিকতার দোহাই দিয়ে প্রায় ২০০ এনজিও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তৎপরতা শুরু করায় মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে বিভিন্ন ধরনের গাড়ির চলাচল। ফলে এক ঘণ্টার রাস্তা যেতে সময় লাগছে পাঁচ ঘণ্টার বেশি। এখানেই শেষ নয়, রোহিঙ্গাদের কারণে জায়গা মিলছে না গণপরিবহনে। জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকলে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে চেকপোস্টে। সব মিলিয়ে চরম দুর্দশার মধ্যে পড়ে গেছে স্থানীয়রা। উধাও হয়েছে অভয়ারণ্য, জনমানুষের শান্তি : সূত্র জানায়, রোহিঙ্গারা ৬ হাজার একর জমি দখল করে ঘরবাড়ি তৈরি করেছে। তাদের নিয়ে কাজ করা প্রায় দুই শ এনজিও নিজেদের অফিস স্থাপনার নামে দখল করেছে আরো দুই হাজার একর জমি। পাশাপাশি আরো ৫০০ একর জমিতে দোকান ও সেমিপাকা ঘর তুলেছে স্থানীয়রা। ফলে রাতারাতি উধাও হয়ে গেছে উখিয়া ও টেকনাফ এলাকার এক সময়ের অভয়ারণ্য। ধ্বংস হয়ে গেছে উঁচু উঁচু পাহাড়। উজাড় হয়ে গেছে বনাঞ্চল। উল্টো রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো থেকে উৎপন্ন বর্জ্যে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাড়ছে বিভিন্ন রোগব্যাধিও। এদিকে, বনাঞ্চল ধ্বংসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উখিয়া টেকনাফের অপরাধ। স্থানীয়রা জানায়, বছর দুই আগেও চুরি-ছিনতাই কিংবা এ জাতীয় অপরাধের তেমন কোনো ঘটনা ঘটত না ওই এলাকায়। অথচ এখন প্রায়ই ঘটছে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যানুযায়ী, রোহিঙ্গারা আসার পর গত দুই বছরে ২৩টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। চুরি ডাকাতিসহ অন্যান্য ঘটনা ঘটেছে ২৩৫টি। ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে মাদক চোরাচালান। মূলত রোহিঙ্গা আসার পরে কয়েকগুণ বেড়েছে ইয়াবার চালান। মিয়ানমারে থাকা স্বজনদের সহযোগিতায় রাতের আঁধারে ইয়াবা চালান নিয়ে ফিরছে তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির ফাঁক গলে সেগুলো পৌঁছে দিচ্ছেন ইয়াবা গড ফাদারদের হাতে। প্রতিটি ক্যাম্পেই গড়ে উঠেছে সশস্ত্র রোহিঙ্গা ডাকাত দল : স্থানীয় সূত্র আরো জানায়, রোহিঙ্গারা আসার পরে যতই দিন যাচ্ছে ততই প্রভাব বিস্তার করে চলেছে তারা। প্রতিটি ক্যাম্প ঘিরে গড়ে উঠেছে সশস্ত্র ডাকাত দল। যাদের মধ্যে সেলিম, নুর মোহাম্মদ, জহির আহম্মেদ জকির, আবদুল করিম ধইল্যা, মো. নুর ও নেসার আহমেদের আছে আলাদা ডাকাত গ্রুপ। এরা স্থানীয়দের জমি দখল থেকে শুরু করে রোহিঙ্গাদের স্বার্থে স্থানীয়দের খুন করতেও পিছপা হচ্ছে না। গভীর জঙ্গলে আস্তানা গড়ে তোলায় ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে তারা। টেকনাফের শালবাগান এলাকার বাসিন্দা জামাল হোসেন শিকদার ভোরের কাগজকে বলেন, রোহিঙ্গারা আমাদের জমি দখল করছে। আগে কখনো চুরি ডাকাতি না হলেও বর্তমানে তা বেড়ে গেছে। দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে। আয়-উপার্জনের উপায়গুলিও চলে গেছে রোহিঙ্গাদের দখলে। ফলে স্থানীয় খেটে খাওয়া মানুষ চরম দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। আমরা এ জিম্মি দশা থেকে মুক্তি চাই। আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পরিবেশ চাই। টেকনাফ রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মোজাম্মেল হক ভোরের কাগজকে বলেন, রোহিঙ্গা আসার পরে সব ধরনের অপরাধ বেড়ে গেছে। কোনো রোহিঙ্গাকে খারাপ কাজ থেকে দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সঙ্কট দেখা দিবে। সুতরাং যত দ্রুত সম্ভব তাদের নিজ দেশে পাঠাতে হবে। সেটি সম্ভব না হলে অতিসত্ত্বর ভাষানচরে স্থানান্তরের দাবি জানাচ্ছি। উখিয়া উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফখরুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, রোহিঙ্গা আসার পরে উখিয়া এলাকার বনাঞ্চল প্রায় ধ্বংসের মুখে। কারণ পাহাড়ের গাছ কেটে তৈরি করা হয়েছে ঘরবাড়ি। ধ্বংস হয়ে গেছে কৃষি জমি। সব মিলিয়ে পরিবেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের শঙ্কা করা হচ্ছে। বিপর্যয়ের মুখে স্থানীয় শিক্ষার্থীরা : কক্সবাজার জেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোস্তফা কামাল চৌধুরী মুসা ভোরের কাগজকে বলেন, রোহিঙ্গারা আসার পরে প্রথমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেয়। পরে তাদের ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হলে অনেক প্রতিষ্ঠানে সশস্ত্র বাহিনীর ক্যাম্প করা হয়। এসব কারণে প্রায় ৫ মাস ক্লাস করতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। এখনো রোহিঙ্গাদের কারণে যানজট সৃষ্টি হওয়ায় বিড়ম্বনায় পড়ছে শিক্ষার্থীরা। এই কারণে মাধ্যমিক পরীক্ষাতে অংশ নিতেও দেরি হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীর। পাশাপাশি এসএসসি ও এইচএসসি পাসের পরপরই শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন এনজিওতে যোগদান করায় ডিগ্রি ও অনার্সের লেখাপড়া হুমকির মুখে পড়েছে। দ্রুত সরকারের এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া উচিত। ক্যাম্পভিত্তিক ইয়াবা সিণ্ডিকেট : টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স্রের মেডিকেল অফিসার ডা. মো. আতাউর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, একসঙ্গে এত মানুষ কোনো এলাকায় আশ্রয় নিলে সেখানে বিভিন্ন রোগব্যাধি দেখা দিবে এটাই স্বাভাবিক। তবে, আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক আছি। ইতোমধ্যে টেকনাফ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৫১ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উত্তীর্ণ করা হয়েছে। টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস ভোরের কাগজকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক ইয়াবা সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। বর্তমানে যেসব চালান ধরা পড়ছে সবই আনছে রোহিঙ্গারা। মিয়ানমার বর্ডার কাছাকাছি হওয়ায় কিছুতেই তাদের থামানো যাচ্ছে না। পাশাপাশি অন্য অপরাধও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছি। আজ পালন হচ্ছে রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস : মিয়ানমারের আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সেদেশের সেনারা হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ২৫ আগস্ট দিনটিকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা ঘোষণা দিয়েছে রোহিঙ্গারা। এজন্য জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। ফেস্টুন, ব্যানার ও টি-শার্ট নিয়ে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে মিছিল এবং আলোচনা সভা করার কথা রয়েছে। এজন্য ইতোমধ্যে ক্যাম্প ইনচার্জ (সিআইসি)-এর কাছ থেকে মৌখিক ও লিখিত অনুমতিপত্র নিয়েছে রোহিঙ্গারা। শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্প ইনচার্জ মো. খালেদ হোসেন এ বিষয়ে জানান, ২৫ আগস্ট উপলক্ষে রোহিঙ্গা নেতাদের (মাঝি) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। শুধুমাত্র ক্যাম্পের ভেতর এই কর্মসূচি পালন করা যাবে। এদিকে, গত বৃহস্পতিবার রাতে রোহিঙ্গাদের গুলিতে যুবলীগ নেতা ওমর ফারুক হত্যার ঘটনায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। এদিন রোহিঙ্গাদের আনাগোনাও কম দেখা গেছে। ভয়ে কার্যক্রমও বন্ধ রেখেছে এনজিও অফিসগুলো। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App