×

মুক্তচিন্তা

সহজ জীবনের কঠিন কমরেড

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০১৯, ০৯:০৩ পিএম

কমরেড মোজাফফর আহমদ পরিণত বয়সে কি আশা বুকে ধারণ করে চলে গিয়েছেন জানি না। তবে এটুকু জানি তার স্বপ্ন আদর্শ কিংবা চেতনার স্বদেশ এখনো অনেক দূরের তারার মতো। যদি পথ খুঁজে পাওয়া না যায় যদি অন্ধকার ঘনীভূত হতে হতে সবকিছু ঢেকে দেয় তখন এরাই আমাদের আলোকবর্তিকা। সহজ জীবনের সবল নেতা কমরেড মোজাফফর আহমদ আপনাকে সালাম।

তিনি ছিলেন প্লেইন লিভিং আর হাই থিংকিং যুগের মানুষ। ছবি দেখলেই বুঝবেন সারল্য আছে, আছে প্রাণখোলা ভাব। কথাও বলতেন জমিয়ে। বাংলাদেশে যে ক’টি রাজনৈতিক দল থাকলে মানে মাঠে থাকলে আমরা লাভবান হতাম ন্যাপ তার একটি। আমাদের যৌবনে ইনি এবং তার সহকর্মী পঙ্কজ ভট্টাচার্য ছিলেন আদর্শ আর অনুপ্রেরণার প্রতীক। তখনকার সময়ে মৌলানারা কেমন ছিলেন এখন ভাবতেও পারবেন না। চট্টগ্রামের ন্যাপ নেতা প্রয়াত আহমেদুর রহমান আজমীর মতো অসাম্প্রদায়িক মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। তিনি ছিলেন মৌলানা। আমি বলছি কমরেড মোজাফফর আহমদের কথা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আওয়ামী লীগের একক নেতৃত্বে হলেও মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বহুদলীয় মতের ভিত্তিতে। সে যুদ্ধে অংশ নিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন অনেক দলের নেতাকর্মী। ন্যাপ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘেঁষা কমিউনিস্ট পার্টি ছিল তাদের অন্যতম। এরা সপ্রাণ অংশগ্রহণ আর ত্যাগে মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করেছিল। আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বড় গুণ ছিল মানুষ চেনা। চিনতেন বলেই তাকে উপদেষ্টা হিসেবে রেখেছিলেন। এবং যিনি ও যার দল শেষ দিন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের মূলধারার প্রতি অনুগত ছিল। ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোভনীয় অধ্যাপনা পেশা ছেড়ে রাজনীতি করার শুরুটা আগে জানুন। এরা স্বার্থ আর গদির জন্য রাজনীতি করতে আসেননি। ১৯৩৭ সাল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে আছেন ভারতের মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী। আদর্শবাদী সাধু পুরুষ। সবার কাছে তিনি পরিচিত মহাত্মা গান্ধী নামে। তিনি দেশ সফরে বেরিয়েছেন। আসবেন পূর্ববঙ্গের কুমিল্লায়। চান্দিনায় তার জনসভা। পার্শ্ববর্তী উপজেলা দেবীদ্বারের কিশোর মোজাফফর আহমদ হেঁটেই রওনা দিলেন জনসভার উদ্দেশে। কিন্তু জনসভাস্থলে পৌঁছার আগে সভা শেষ হয়ে গেল। কিশোর মোজাফফর পথিমধ্যে এ কথা শুনে সভা ফেরত লোকদের কাছে জানতে চাইলেন, মহাত্মা গান্ধীজী কী বলেছেন? লোকেরা উত্তর দিল, তিনি বক্তৃতা নয়, বাণী দিয়েছেন। বাণীতে বলেছেন, হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে যাও। ব্রিটিশ তাড়াও। নিজেরা ভেদাভেদ করলে ইংরেজ তাড়াতে পারবে না। কৌতূহলী মোজাফফর জানতে চাইলেন, আর কী বলেছেন? লোকেরা উত্তর দিল, গান্ধীজী আর কিছু বলেননি। এটুকু বলেই রওনা দিয়েছেন। মুগ্ধ হয়ে গেলেন পনেরো-ষোলো বছরের বালক মোজাফফর। এমন নেতাই তো চাই। যারা কথা কম বলেন তারা কিন্তু কাজ বেশি করেন। সে দিনের সেই কিশোর পরবর্তী সময় সারাজীবন মহাত্মা গান্ধীর আদর্শকেই অনুসরণ করেন। তাকে দেশবাসী গ্রামে-গঞ্জে, মাঠে ময়দানে, জনসভায় মিছিলে লুঙ্গি পরে ছুটতে দেখে। হ্যাঁ, প্রথাবিরোধী রাজনীতিবিদ মোজাফফর আহমদের রাজনৈতিক জীবনের শুরুটা এমনই। মোজাফফর আহমদ যে আদর্শের জন্য লড়েছিলেন তার প্রতি আমাদের আস্থা থাকলেও স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের সরকার তা রাখতে পারেনি। আজ সত্য বলতে হলে বলতে হয় ১৯৭৩-এর নির্বাচনে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া কেন্দ্রে জেতা ন্যাপ প্রার্থীকে জোর করে হারিয়ে দেয়া হয়েছিল। অথচ সে দিন যদি এই পরাজয় মেনে নেয়া হতো ন্যাপের রাজনীতি ওই এলাকায় বৃদ্ধি পেত। তাতে কী হতো? অন্তত আজকের মতো ওই এলাকা জামায়াত ও স্বাধীনতা বিরোধীদের শক্ত ঘাঁটি হতে পারত না। যেমনি করে দাউদকান্দিতে পরাজিত খন্দকার মোশতাককেও জিতিয়ে আনা হয়েছিল। আর সে ফিরে আসার মাসুল আমরা গুনেছি পঁচাত্তরে। মোজাফফর আহমদ সত্য বলতেন সাহস করে। সে কারণে আইয়ুব আমলে যেমন হুলিয়া থাকায় আত্মগোপন করেছিলেন একইভাবে আত্মগোপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর। প্রলোভনে মন্ত্রী হওয়ার খায়েশ ছিল না বলেই চলে গিয়েছিলেন লোকজনের চোখের আড়ালে। সম্বল কেবল রিকশা ভাড়া। মন্ত্রী তিনি বঙ্গবন্ধু আমলেও হতে পারতেন। সে প্রস্তাব বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কেন? স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু তার বাল্যবন্ধু মোজাফফর আহমদকে আমন্ত্রণ জানালেন মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে। যদিওবা রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন ছিল, তথাপি তাদের বন্ধুত্ব ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন, বিরোধী দলে থেকেই আমি স্বস্তি পাব। ‘ইগো প্রবলেম?’ তিনি কী ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বে ভুগছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তার স্ত্রী আমিনা আহমদ বলেছিলেন, তা নয়। তখন বঙ্গবন্ধুর আশপাশে এমন কিছু সুবিধাবাদীর দাপট, তিনি (মোজাফফর আহমদ) সেখানে গেলেও কোনো কাজ করার সুযোগ পেতেন না। আবার এই মানুষ ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের লৌহকঠিন শাসন আমলে নির্বাচন করে মানুষকে ভরসা জুগিয়েছিলেন। ১৯৮১ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কুঁড়েঘর মার্কায় প্রার্থী হন। আমার নাম মোজাফফর, মার্কা আমার কুঁড়েঘর এই স্লোগানে দোকানে দোকানে তাকে সহজ-সরলভাবে ভোট চাইতে দেখা যায়। যদিওবা পাতানো সেই নির্বাচনে তার প্রাপ্ত ভোট দেখানো হয়েছিল মাত্র ১ শতাংশ তথাপি বন্দুকের নলের দিকে বুক তাক করে করা সেই সাহসী রাজনীতি ইতিহাসে দাগ রেখেছে। আরো একটা ঘটনার কথা বলি। খালি চাই আর চাইয়ের সমাজে আমরা কি এমন কাউকে দেখি যিনি কিছু চান না? বা পেয়েও বলেন আমি নেব না? চোখ মেলে দেখুন কবি-সাহিত্যিক, নায়ক-গায়ক, নেতা-অভিনেতা সবাই কেমন করে চায়। কত আকুল হয়ে মোসাহেবি করে যদি একটা পদক জুটে যায়। যদি মেলে আনুকূল্য। আর তিনি? ২০১৫ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পদক পেয়েও নিলেন না। আর না নিয়ে হয়ে উঠলেন সংবাদ শিরোনাম। কোনো কোনো সময় জীবনে না পাওয়া বা না নেয়াটাও যে গৌরবের আমরা তা ভুলে যাই। বিশেষ করে যখন তিনি বলেন আমি তো পদকের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি। এমন কথা বলার মানুষ দেশে আর ক’জন আছেন? চাঁদের কলঙ্কের মতো দুয়েকটা ভুল তারও ছিল। যেমন কেন তিনি খাল কাটাকে সমর্থন করেছিলেন আজো তা বুঝে উঠতে পারিনি। আর একটি হচ্ছে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে ধর্ম কর্ম ও সমাজতন্ত্র যোগ করা। এই স্লোগান যে ব্যর্থ হয়েছিল তাও দেখেছি আমরা। তারপরও তিনি আদর্শবান। সে কারণেই জাসদ বাসদ কিংবা চৈনিক বামদের মতো সেনানায়ক খালেদা জিয়া কিংবা আওয়ামী লীগের হাতে পায়ে ধরে বা আঁতাত করে মন্ত্রী হননি। মন্ত্রী হওয়া এখন যে আর কোনো গৌরবের ব্যাপার না সেটা তিনি ঠিকই বুঝে গেছিলেন। তার এককালের নেতা কমরেড মনি সিংহ বলতেন মানুষ বাঁচে আশা নিয়ে আর কমিউনিস্টরা মারা যায় আশা বুকে ধারণ করে। কমরেড মোজাফফর আহমদ পরিণত বয়সে কি আশা বুকে ধারণ করে চলে গিয়েছেন জানি না। তবে এটুকু জানি তার স্বপ্ন আদর্শ কিংবা চেতনার স্বদেশ এখনো অনেক দূরের তারার মতো। যদি পথ খুঁজে পাওয়া না যায় যদি অন্ধকার ঘনীভূত হতে হতে সবকিছু ঢেকে দেয় তখন এরাই আমাদের আলোকবর্তিকা। সহজ জীবনের সবল নেতা কমরেড মোজাফফর আহমদ আপনাকে সালাম।

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App