×

মুক্তচিন্তা

ভারতের অর্থনৈতিক ডামাডোল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০১৯, ০৭:৫০ পিএম

হাইব্রিড মডেলে সরকার আগে নিজের পয়সায় জমি অধিগ্রহণ করে, তারপর প্রকল্প ব্যক্তিগত পুঁজিকে প্রকল্পে যোগদানের জন্য ডাকে। বাজারে খবর- সরকার এবার পরিকাঠামোর উন্নতিতে আরো জোর দেবে, যাতে মন্দার আশঙ্কা কেটে দেশে স্টিল, সিমেন্টের মতো উৎপাদন শিল্পের চাহিদা তৈরি হয়। প্রজেক ফিন্যান্সিংয়ের মাধ্যমে প্রকল্প রূপায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে পেনশন ফান্ড। প্ল্যান তো ভালোই। দেখা যাক কী হয়!

গরম কেটে গিয়ে কলকাতা ও দেশজুড়ে এখন স্বস্তি। বৃষ্টি এসেছে। এবারের মতো জলকষ্ট থেকে মুক্তি। এখন খবর আসছে বন্যার। দেখার বিষয় কৃষি উৎপাদনের কী হাল হয়। দেশ ও বিদেশের নানা কারণে শিল্প উৎপাদনের হার নিম্নমুখী। গত জুনে শিল্প প্রবৃদ্ধির হার গত বছরের সাত শতাংশ থেকে কমে ছিল দুই শতাংশ হয়েছে। মূল কারণ গাড়ি শিল্পে মন্দা। গত ৯ মাস ধরে গাড়ির চাহিদা কমছে। শ্রমিক ছাঁটাইয়ের খবরও আসতে শুরু করেছে। এর ওপর যদি কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে চিন্তা বাড়বে।

সারা পৃথিবীতেই মন্দার আশঙ্কা আছে। যদিও মার্কিন অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অব্যাহত। প্রায় এক দশক পর আমেরিকান কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ইউএস ফেডেরাল রিজার্ভ) সুদের হার কমিয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে চাহিদা অব্যাহত থাকে। ভারতেও রিজার্ভ ব্যাংক গত এক বছরে রেপো রেটের হার এক শতাংশের ওপর কমিয়েছে। রিজার্ভ ব্যাংক যে সুদে সাধারণ ব্যাংককে টাকা ধার দেয় তাকে রেপো রেট বলে। সুদের হার কমানোর উদ্দেশ্য হলো, বাজারে টাকার জোগান বাড়ানো, যাতে চাহিদা বাড়ে।

মুশকিল হলো টাকার জোগান বাড়েনি, উল্টে গত বছরের সেপ্টেম্বরে আইএলএন্ডএফএস সংকটের পর থেকে বাজারে টাকার জোগান কমেছে। ভারতে মূলত দুধরনের আর্থিক সংস্থা আছে। একটা ব্যাংক। দ্বিতীয়টাকে বলা হয় নন-ব্যাংকিং ফাইন্যান্সিয়াল কোম্পানি বা এনবিএফসি। কিছু বিধিনিষেধ ব্যতিরেকে এরা ব্যাংকের মতোই বাজার থেকে টাকা ধার নেয় আর সেই টাকা নানা উদ্যোগে খাটায়।

নানা দেশি ও বিদেশি আর্থিক সংস্থা দ্বারা গঠিত এবং ভারতের সরকারি আর্থিক সংস্থাগুলোর পরিচালনাধীন আইএলএন্ডএফএস ভারতের সব থেকে বড় এনবিএফসি, যারা মূলত পরিকাঠামো প্রকল্পে টাকা ধার দিত। গত দশকে ভারতের যোগাযোগ পরিকাঠামো উন্নতির পেছনে ছিল এই আইএলএন্ডএফএস। গ-গোল হলো পৃথিবীজুড়েই পরিকাঠামো ক্ষেত্রে টাকা ফেরত পেতে প্রায় ২০-২৫ বছর লাগে, এদিকে ভারতে এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের তেমন বাজার নেই। ব্যাংকগুলো সাত থেকে আট বছরের বেশি মেয়াদি ঋণ দেয় না। ফলে সরকারি মদদে চলা আইএলএন্ডএফএস বাজার থেকে টাকা তুলেছে স্বল্পমেয়াদি ঋণপত্রে আর টাকা লাগিয়েছে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে।

নিট ফল হলো সরকার যত ব্রিজ, হাইওয়ে বানিয়েছে, আইএলএন্ডএফএস তত ধার বাড়িয়েছে; যার একটা অংশ ব্যবহার হয়েছে পুরনো ঋণ মেটাতে। রোজ রোজ ধারের পয়সায় বিরিয়ানি খেলে যা হয় শেষে তাই হয়েছে। আইএলএন্ডএফএস প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার দেনা নিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে, সঙ্গে সঙ্গেই ডুবেছে অন্যান্য আর্থিক সংস্থা ও বিনিয়োগকারী। এখন জানা যাচ্ছে ডোবার আগের চার বছর আইএলএন্ডএফএস রিজার্ভ ব্যাংকের কাছে নিয়মমাফিক হিসাবও জমা দেয়নি। ব্যাংকের বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদরা তখন কী করছিলেন কে জানে? তবে ঘটনার পরে তারা সব এনবিএফসিকে ধরে এমন টান মেরেছেন যে তারা ঋণ দেয়ার বদলে ঋণ ফেরত আনায় বেশি মনোযোগ দিয়েছে। ফলে টাকার জোগান কমেছে। এতে মার খেয়েছে মূলত ছোট উদ্যোগ, বাস-ট্রাক বা ট্যাক্সির মালিকরাও এর মধ্যে পড়েন। এরা ব্যাংকের কাছে ঋণ পান না। ফলে এনবিএফসি ছাড়া গতি নেই।

সব মিলিয়ে আইএলএন্ডএফএস অপরিশোধ্য ঋণের পরিমাণ চার বিলিয়ন ডলারের মতো। ভারতের মতো বড় জিডিপির একটা দেশ এতে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে না। মুশকিল হলো ভারতের ব্য্যাংকগুলো আগে থেকেই কাড়ি কাড়ি অপরিশোধ্য ঋণের বোঝায় ধুঁকছিল।

তারও গোড়ায় সেই ধার করে ঘি খাবার গল্প। গত দশকে ভারতের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ডবলের বেশি বেড়েছে। তাতে ৭০ শতাংশ টাকাই ব্যাংকের ঋণ। জমির ও কয়লার দাম বেশি হওয়ার কারণে নতুন প্রকল্পের বিদ্যুতের দাম সবসময়েই বেশি হয়। এদিকে ভারতের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা রাজ্যসরকারগুলোর হাতে। এবং ভোটের লোভে তারা কিছুতেই বিদ্যুতের দাম বাড়াবে না। আইন অনুযায়ী রাজ্যসরকার তাতে কাগজে-কলমে ভর্তুকি দেয় বটে কিন্তু সে টাকা হাতে পেতে পেতে জোয়ানমদ্দ লোক বুড়ো হয়ে যাবে। অর্থাৎ বিতরণ সংস্থার কাছে টাকা নেই। তার গোটা ব্যবসাটাই ধারে চলে। ২০১২ অবধি বিতরণকারী সংস্থাগুলো সরকারি প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকের কাছ থেকে এন্তার দেনা করে গেছে, তাতে টান পড়তেই তারা প্রথমে বিদ্যুৎ কেনা কমিয়েছে। একেই বাজারে জোগান বেশি তাতে বিদ্যুতের চাহিদা না বাড়াতে বেসরকারি উৎপাদন সংস্থাগুলো হয় লোকসানে বিদ্যুৎ বেচেছে কিংবা কারখানা বন্ধ করেছে। যাই করুন তার দায় গিয়ে শেষে পড়েছে সেই ব্যাংকের ঘাড়ে। মাঝে অনেক উদ্যোগের নাভিশ্বাস উঠেছে। এই মুহূর্তের হিসেবে বিতরণ সংস্থাগুলোর কাছে উৎপাদকদের পাওনা ৪৬ হাজার কোটি টাকা, এমনকি মিটার উৎপাদক সংস্থাগুলোর অনাদায়ীর পরিমাণ প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। এরপরে আরেকটা ব্যাপার আছে। গত দশকের ভারতের অর্থনীতি যখন প্রায় ১০ শতাংশ হারে বাড়ছিল তখন চলতি হাওয়ার সুযোগ নিয়ে বহু কোম্পানি স্রেফ ঋণের ওপর নির্ভর করে ব্যবসা বাড়িয়েছে। ঋণ নেয়া খারাপ নয়। কিন্তু পুঁজির তুলনায় ঋণ যদি অনেক বেশি হয় তাহলে হিসাবের একটু গ-গোল হলেই বিপদ হবে। ব্যাংকরা যে এটা জানত না তা নয়, কিন্তু লাভের নেশায় ছুটে হাত খুলে ঋণ দিয়েছে। ২০১৩ সালের পর থেকেই সেই ফোঁড়া বিষফোঁড়ার আকার নিয়েছে। অনাদায়ী ঋণ বেড়েছে হুড়মুড়িয়ে।

আলোচনা থেকেই পরিষ্কার যে রোগ সুবিধের নয়। দু-চারটে ট্যাবলেটে সারবে না। লম্বা চিকিৎসা দরকার। আশার কথা হলো যে, সরকার লম্বা চিকিৎসাটা শুরু করেছে। বড় কোম্পানিরা এর আগে মেজাজে ধার করত কারণ সম্পত্তি ক্রোক করে অনাদায়ী আদায় করে ব্যাংকের এমন ক্ষমতা ছিল না। ২০১৬ সালে আনা দেউলিয়া আইনে সে ব্যবস্থা বদলেছে। গত বছর খানেকে বেশ কিছু কোম্পানি এভাবে হাত বদল হয়েছে। বাকি অনেকেই ভয় পেয়ে সম্পত্তি বিক্রি করে ঋণ কমিয়েছে। এতেই না থেমে সরকার এখন বড় কোম্পানিগুলোকে ধারের পরিমাণ কমাতে চাপ দিচ্ছে। আগামী মাস ছয়েকে এই চাপ আরো বাড়বে। ব্যাংকে সরকার নতুন করে কিছু পুঁজিও বিনিয়োগ করেছে।

অন্যদিকে বিতরণ সংস্থাগুলোকে অর্থনীতি বদলাতে চাপ দেয়া হচ্ছে। এ মাসের শুরু থেকে নতুন নিয়ম হয়েছে যাতে উৎপাদক সংস্থাগুলোর বকেয়া আর না বাড়ে। পয়সা না দিলে বিতরণ সংস্থা বিদ্যুৎ পাবে না। বিজেপি চালিত রাজ্যগুলোও এ নিয়মের বাইরে নয়। দুদিন আগেই বিদ্যুৎ কেনাবেচা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা উত্তর প্রদেশে বিদ্যুতের জোগানে রাশ টেনেছে। কেন্দ্রের বিদ্যুৎমন্ত্রী প্রায় প্রতিদিন পাখি পড়ার মতো বলে চলেছেন, ‘আগে পয়সা তারপর বিদ্যুৎ’।

ব্যাংকে অনাদায়ী কমতে শুরু করেছে। যদি চাপ বজায় থাকে তাহলে আগামী অর্থবর্ষের শুরুতে আর্থিক সংস্থাগুলোর হাতে টাকার জোগান বাড়বে। দুর্বল আর্থিক স্বাস্থ্যের কারণে, রিজার্ভ ব্যাংক রেপো রেট কমালেও ব্যাংকগুলো এতদিন সুদের হার তেমন কমায়নি। আবার ভয় পেয়ে নতুন ঋণেও রাশ টেনেছিল। টাকার জোগান বাড়লে ব্যাংক সুদের হার কমিয়ে ঋণ বাড়াতে সচেষ্ট হবে। কিন্তু এতেই ভারতের অর্থনীতি দৌড়াবে না। সিআইএ ফ্যাক্ট বুকের মতে, ভারতের জিডিপিতে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের অবদান ২৩ শতাংশ (২০১৬), চীনে ৪০ শতাংশ। ব্যাংক ধারটা দেবে কাকে? সরকার নিয়মকানুনের জটিলতা কমিয়ে, পরিকাঠামো ভালো করে, দেশে শিল্পের প্রসার ঘটাতে চাইছে। বিদেশি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহকারীদের চাপ দেয়া হচ্ছে দেশে কারখানা তৈরির জন্য। এতে কাজ হচ্ছে না তা নয়। কিন্তু এর ফল পেতে সময় লাগবে। এদিকে এতদিন ধরে ধার করে ঘি খাওয়া উদ্যোগেরা নতুন ব্যবস্থায় মানাতে সময় নেবে। দক্ষতার কারণে কিছু বন্ধও হবে। জিএসটি আসার পর কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ কমে যাওয়াতেও অনেকের বারোটা বেজেছে।

অর্থাৎ শিল্পে ঋণের চাহিদা বাড়তে আরো সময় লাগবে। তার মাঝে অর্থনীতি চাঙ্গা না হলে নির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবি হবে। সেটা আটকানোর উপায় হিসেবে সরকার আবার পরিকাঠামোকেই হাতিয়ার করেছে। এবার অবশ্য আরেকটু আটঘাট বেঁধে।

কয়েক বছর ধরে ইউরোপীয় পেনশন ফান্ডদের ভারতে বিনিয়োগ বাড়ছে। পেনশন ফান্ড দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের সুযোগ খোঁজে। ভারত সরকার এটাকে কাজে লাগিয়ে হাইব্রিড ফাইন্যান্সিং মডেলে পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ নিচ্ছে। পরিকাঠামো প্রকল্পের সব থেকে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা হলো জমি অধিগ্রহণ। হাইব্রিড মডেলে সরকার আগে নিজের পয়সায় জমি অধিগ্রহণ করে, তারপর প্রকল্প ব্যক্তিগত পুঁজিকে প্রকল্পে যোগদানের জন্য ডাকে। গত পাঁচ বছরে ভারতে যে বিপুল পরিমাণ হাইওয়ে তৈরি হয়েছে তার বড় অংশই এই হাইব্রিড মডেলে।

বাজারে খবর- সরকার এবার পরিকাঠামোর উন্নতিতে আরো জোর দেবে, যাতে মন্দার আশঙ্কা কেটে দেশে স্টিল, সিমেন্টের মতো উৎপাদন শিল্পের চাহিদা তৈরি হয়। প্রজেক ফিন্যান্সিংয়ের মাধ্যমে প্রকল্প রূপায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে পেনশন ফান্ড। প্ল্যান তো ভালোই। দেখা যাক কী হয়!

প্রতিম বসু : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App