×

সাময়িকী

সলিমুল্লাহ খান সঞ্জীবনী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০১৯, ০৬:২৬ পিএম

সলিমুল্লাহ খান সঞ্জীবনী
সলিমুল্লাহ খান সঞ্জীবনী

বিকেল সাড়ে তিনটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ি ধানমন্ডির উদ্দেশ্যে। আগেই সময় ঠিক করা ছিল। চারটার ভেতর ক্লাস শেষ হয়ে যাবে। আর আমি চারটার ভেতর পৌঁছাবো। গত ১৮ আগস্টের কথা বলছি। আমার শিক্ষক সলিমুল্লাহ খানের জন্মদিন। তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। তো আমি বিকেলে সেখানে সশরীরে উপস্থিত থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবো, এমনটাই আমার ইচ্ছা।

হাতে নিলাম দুটি বই : দীপেশ চক্রবর্তী ও রণজিৎ দাশগুপ্তের ‘উনিশ শতকের বাংলার শ্রমিক ইতিহাসের কয়েকটি দিক’ এবং হিতেশরঞ্জন সান্যালের লেখা ও মহুয়া দাশগুপ্ত অনূদিত ‘বাংলার ভক্তি আন্দোলনে পরিবর্তনের ধারা’, সঙ্গে আরো নিলাম এস এম সুলতানের মুখচ্ছবি সংবলিত একটি খেরোখাতা। জন্মদিনের উপহার। স্যারের কক্ষ পঞ্চম তলায়, সেখানে ঢুকেই দেখি বসে আছেন আনিসুর রহমান, তিনি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইম্যানের শিক্ষক। উপহারগুলো হাতে তুলে দিলে স্যার বললেন, আপনি তো আমাকে বই উপহার দিয়েই চলেছেন। কলকাতার অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত বইদ্বয়ের আকৃতি পছন্দ করলেও বইয়ের ভেতরকার বাংলাকে তিনি পছন্দ করলেন না। সাথে সাথেই একটি বই খুলে বাংলা বানানের যে দফারফা করা হয়েছে সেটার প্রমাণ দিলেন। এ-কারের বদলে ‘-এর’ লেখা স্যার একদম পছন্দ করেন না। তাঁর এই নাপছন্দ যুক্তিসঙ্গত। তাছাড়া বাক্যগঠনের দীনতাও নির্দেশ করলেন বইগুলোর ভেতর। একটি বাক্য দেখিয়ে স্যার বললেন, দেখুন এখানে লিখেছে ‘তাঁর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ’, এটা ইংরেজির ঢং, কারণ ইংরেজিতে ‘টু’ লেখা হয়। বাংলায় আপনাকে লিখতে হবে তাঁর কাছে বা নিকটে আমি কৃতজ্ঞ।

বই নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে আরো বলছিলেন, উনিশ শতকের বাংলা লেখকদের কাছ থেকেও যদি এরা শিখতো তাহলে এদের বাংলা এমন হতো না। উদাহরণ হিসেবে তিনি ভূদেব মুখোপাধ্যায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এঁদের কথা বললেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে বাংলা ভাষাকে কৃত্রিম বানানোর চেষ্টা করেছেন সেটার সমালোচনা করলেন। বললেন, দেখুন তিনি আরাম কেদারার জায়গায় প্রস্তাব করেছিলেন লঘুখট্বিকা। ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব’ বইতে রবীন্দ্রনাথ এমন প্রায় এক হাজারটি প্রতিশব্দ প্রস্তাব করেছিলেন, কিন্তু বেশিরভাগ শব্দই এখন ঝরে গেছে, টেকেনি। স্যার বলেন, সমস্যা শব্দের নয়, ধারণার। তত্ত্ব ভুল ধারণাপ্রসূত হলে তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতন মহাপুরুষকেও ক্ষমা করে না।

এ সময় স্যার লেখকের দায়িত্ব নিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বললেন। লেখকের কাজ হচ্ছে মানুষের মুখের ভাষাকে তার লেখার মাধ্যমে, লেখ্যভাষায় গড়ে নেয়া। বই দুটি উল্টেপাল্টে বললেন, যাক তারপরও কলকাতা থেকে এরকম বইপত্র বেরুচ্ছে, হাতি মরলেও লাখ টাকা। এটা বলে হাসলেন স্যার।

এরই ফাঁকে শরীফ সবুজ চা এনে দিলেন। মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম, সাইক্লিস্ট এবং সম্প্রতি সাইকেলে চড়ে বাংলাদেশ ভ্রমণের রোজনামচা লিখে বেশ নাম কুড়িয়েছেন। শরীফ স্যারের একান্ত সচিবের কাজ করেন। তিনি এই বিকেলেই সদ্য একটি লেখা কম্পোজ করে শেষ করেছেন। স্যার বললেন, আমাকে লেখাটি দিতে। আহমদ ছফাকে নিয়ে স্যার লেখাটি লিখেছেন একটি দৈনিক পত্রিকার জন্য। ক’দিন পর ছাপা হবে। তিনি আমাদের দুজনকে এক কপি করে দিলেন, অন্য আরেকটি কপি নিজের হাতে রেখে পড়তে শুরু করলেন।

প্রবন্ধের নাম ‘আহমদ ছফার গব্যপুরাণ’। ছফার ‘পুষ্প বৃক্ষ বিহঙ্গ পুরাণ’ ও বাংলা ‘গব্যঘৃত’ কথাটি থেকে স্যার এই ‘গব্যপুরাণ’ তৈরি করেছেন বললেন। যেহেতু রচনাটিতে ছফার ‘গো-হাকিম’ নিয়ে আলোচনা ছাড়াও ‘গাভী বিত্তান্ত’ ও ‘গাভীর জন্য শোক প্রস্তাব’ নিয়েও আলাপ আছে, সেহেতু এই রকম শব্দ তৈরি করেছেন স্যার। লেখাটি তিনি পড়ে শোনাচ্ছেন আর ব্যাখ্যা করছেন, কোথাও শানে নুজুল বলছেন। যেমন এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, ‘গাভী বিত্তান্ত’ নিয়ে “এক জগদ্বিখ্যাত বিদূষী নারীধর্ম-ব্যবসায়ী আমাকে শোনাইয়াছিলেন : “অশ্লীল, অশ্লীল, পাশে নাঙ্গ নিয়ে বসে পড়ে যায় না।” এই নারীর নাম তিনি প্রবন্ধে উল্লেখ না করলেও আমাকে বললেন। সত্যিই তিনি জগদ্বিখ্যাত পণ্ডিত। দেরিদার শিষ্য।

এভাবে তফসির করতে করতে স্যার নিজের লেখা পাঠ করতে লাগলেন। পাশে দেখি আনিসুর রহমান হাতঘড়ি দেখছেন। স্যার বোধহয় সেটা খেয়াল করলেন। বললেন, আমার যখন বয়স কম ছিল তখন আহমদ ছফা আমাকেও জোর করে বসিয়ে, ফাউস্টের অনুবাদ শোনাতেন। আমি যেমন করে আপনাদের জোর করে প্রবন্ধ পড়ে শুনাচ্ছি। বলে একচোট হাসলেন। ওদিকে, আনিসুর রহমানের বলাকা সিনেমা হলে ছবি দেখার তাড়া ছিল, তিনি চলে গেলেন। আনিসুর রহমানের প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গেই প্রবেশ করেন স্যারের অনুজ সাদাত উল্লাহ খান ও তাঁর এক বন্ধু। এক তোড়া ফুল নিয়ে এলেন তাঁরা। কুশলাদি বিনিময়ের পর সাদাত উল্লাহ খান আমাকে তাঁর মেয়ে আয়াত মোস্তফা খানের লেখা একটি শিশুতোষ ভ্রমণের বই উপহার দিলেন। আয়াত মোটে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। সলিমুল্লাহ খানের ভাস্তি বলে কথা!

স্যার এ সময় আমার আনা বই দুটি সাদাত উল্লাহ খানকে দিলেন দেখতে। তিনি প্রকাশনা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। দেখে বইগুলোর প্রশংসা করলেন। তখন আমি স্যারকে বললাম, কলকাতার অক্সফোর্ডের মতো করে তো আপনারও সিরিজ বই বেরুতে পারে এখানে। যেমন আপনার রবীন্দ্রনাথের বানান প্রসঙ্গ নিয়ে একটি এমন বই হতে পারে। তৎক্ষণাৎই স্যার বললেন, আপনি দায়িত্ব নিন সম্পাদনার। আমিও রাজি হয়ে গেলাম।

এরই মধ্যে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে চকোলেট নিয়ে হাজির হলেন, স্যারের অধিকাংশ বইয়ের যোগ্য সম্পাদক ও আমার বন্ধু আতিকুজ্জামান রাসেল এবং কবি তুষার হাসান মাহমুদ। তুষার স্যারের স্বাস্থ্যের খবর জিজ্ঞেস করলেন। লক্ষ করলাম স্যার ওই বিষয়ে ততোটাই অনাগ্রহ প্রকাশ করলেন, যতোটা তিনি আগ্রহ দেখান সাহিত্য, দর্শন কিংবা ইতিহাস আলোচনায়। ভাবলাম মানুষটি কি নিবিড় সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন।

হুট করেই আমাদের কক্ষের পেছনের দরজা খুলে গেলো। দেখা গেলো উজ্জ্বল মুখ। মার্কিন মুলুকের নামজাদা শিক্ষক ও পণ্ডিত আজফার হোসেন। তিনি বছরের একটা সময় স্যারের বিশ্ববিদ্যালয়েই ইংরেজি সাহিত্য পড়ান। তো তিনি ভেতরে ঢুকে স্যারকে জন্মদিনের দিল খোলা শুভেচ্ছা জানালেন। বললেন, ফেসবুকে তো আপনার জন্মদিন বেশ ঘটা করে পালিত হচ্ছে। যেহেতু স্যারের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই, তাই তিনি বললেন, আমি তো লেফট আউট, তবে এখনো রাইট আউট হইনি। আজফার হোসেন বললেন, বেশ ভালো বলেছেন।

স্যার আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে গেলেন, তখন আজফার হোসেন বললেন, গ্রেট বিধান, ওর সাথে আমার পরিচয় আছে। আজফার হোসেন আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েই স্যারের সাথে কথা বললেন। দুজনই বেশ উৎফুল্ল হয়ে পরস্পরের সাথে আলাপ করলেন। এ সময় স্যার বললেন, একটা বই তিনি খুঁজছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না, যেহেতু স্বল্প পরিমাণে সেটি ছাপানো হয়েছে, বইটি হলো ফ্রানৎস ফানোঁর ‘ডিকলোনাইজিং ম্যাডনেস : দ্য সাইকিয়াট্রিক রাইটিংস অব ফ্রানৎস ফানোঁ’। এই বইয়ের ইতালি ও ফরাসি সংস্করণ থাকলেও স্যারের কাছে ইংরেজি সংস্করণটি নেই। আজফার হোসেন বললেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে অবশ্যই এই বইয়ের খোঁজ করবেন। স্যার জানালেন, বইটিকে কেন্দ্র করে তিনি একটি কোর্স ডিজাইনের কথা ভাবছেন।

আজফার হোসেন বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের ভেতরেই আমি বেরিয়ে যাই। আমার শরীরটাও ভালো ছিল না, তার ওপর ছেলেকে নিয়ে যেতে হবে থেরাপি সেন্টারে। ফিরতি পথে ভাবছিলাম, স্যারের লেখালেখি সংক্রান্ত কথা, তিনি বিকেলেই বলছিলেন, হাতে লিখতেই তাঁর সুখানুভূতি হয়। আরো বলছিলেন, যেসব লেখা পড়ে তাঁর ঈর্ষা হয় না, সেসব লেখা তিনি পড়তে চান না। আর নিজের লেখালেখি প্রসঙ্গে স্যার বলেন, লেখার প্রক্রিয়ার ভেতর থাকতেই যা সুখ, লেখা একবার শেষ হয়ে গেলে সেটি নিয়ে তাঁর আর আগ্রহ থাকে না, সে কারণে অনেক লেখা আজ হারিয়ে গেছে।

সকলেই জানেন সলিমুল্লাহ খান বহুদিন ধরেই সাধু ভাষায় লিখছেন এবং তাঁর লেখার ধরন চিন্তার কোলাজের মতো। অনেকটা চলচ্চিত্রের জাক্সটাপোজের মতো করে তিনি একের পর এক চিন্তা সাজিয়ে যান, অন্যের ও নিজের। এভাবেই তিনি পৌঁছতে চান পাঠকের মগজে। কিন্তু এটিকে অনেকেই পছন্দ করে না। তারা বলে, সাধু ভাষা কেন লিখছেন উনি, আর কেনইবা এতো রেফারেন্স তাঁর লেখায়? তাদের এই সম্মিলিত বিরক্তির জবাবে জোনাথন সুইফটের কাছ থেকে কথা ধার নিতে চাই। কথাগুলো সলিমুল্লাহ খানই অনুবাদ করেছিলেন ছফা প্রসঙ্গে ‘আহমদ ছফার গব্যপুরাণ’ প্রবন্ধে। কথাগুলো এমন : “দুনিয়ায় যখন কোনো বড় মাপের প্রতিভার আবির্ভাব হয়, আপনি তাহা এই আলামত দেখিয়াও বুঝিতে পারিবেন: দেখিবেন দুনিয়ার সকল গো-শাবকই তাঁহার বিরুদ্ধে মহাজোট বাঁধিয়াছে।”

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App