×

সাময়িকী

সব ক্ষেত্রেই এখন গভীরতাহীন চমক দেখা যায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০১৯, ০৬:৩৫ পিএম

সব ক্ষেত্রেই এখন গভীরতাহীন চমক দেখা যায়
সব ক্ষেত্রেই এখন গভীরতাহীন চমক দেখা যায়

সদ্য প্রয়াত কথাশিল্পী রিজিয়া রহমানের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর, কলকাতার ভবানীপুরে। বাবা আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিক ও মা মরিয়াম বেগম। পৈতৃক বাড়ি ছিল কলকাতার কাশিপুর থানার নওবাদ গ্রামে। ’৪৭-এ ভারতভাগের পর পরিবারের সঙ্গে তিনি চলে আসেন বাংলাদেশে। ষাটের দশক থেকে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা ও শিশুসাহিত্যে ছিল তাঁর বিচরণ। প্রকাশিত প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অগ্নিস্বাক্ষরা’। উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে- হল ঘর ভাঙা ঘর, উত্তর পুরুষ, রক্তের অক্ষর, বং থেকে বাংলা, অলিখিত উপাখ্যান, শিলায় শিলায় আগুন, চিরকাল, প্রাচীন নগরীতে যাত্রা। লিখেছেন ‘অভিবাসী আমি’ ও ‘নদী নিরবধি নামে’ দুটি আত্মজীবনীও। উপন্যাসে অবদানের জন্য লাভ করেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ভূষিত হন একুশে পদকেও। তাঁর লেখালেখি, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সাহিত্য চর্চা, উপন্যাসের নানা প্রসঙ্গ, গল্প ও সাহিত্যের নানাবিষয় উঠে এসেছে এই সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকার গ্রহণ : স্বকৃত নোমান

প্রশ্ন : আপনার স্মৃতিকথাধর্মী বই ‘নদী নিরবধি’ দিয়ে শুরু করতে চাই। এর আগের বইটি ছিল শৈশবের স্মৃতিকেন্দ্রিক। দ্বিতীয়টিতে কোন সময়কালকে প্রাধান্য দিলেন? রিজিয়া রহমান : আগের বইটাতে, ‘অভিবাসী আমি’, ছিল শৈশবের শুরুটা। ‘নদী নিরবধি’ও শৈশব-কৈশোর নিয়ে। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত আমরা যে শহরে ছিলাম সেই পর্যন্ত আমি লিখব। এত বছর পর আমি লিখতে গিয়ে দেখছি, এ জীবনটা, মানে পরিণত জীবনের চাইতে শৈশব জীবনটাই আসল, খাঁটি। কারণ ওই সময় পৃথিবীতে সব নতুন। চোখের সামনে পর্দার পর পর্দা খুলে যাচ্ছে। সব কিছু জানা, চেনা, বোঝা- এটা একটা বিশাল অভিজ্ঞতা মানুষের জীবনের জন্য। ওই অভিজ্ঞতাগুলোকে ভিত্তি করে মানুষ আস্তে আস্তে অন্য জিনিসগুলোকে উন্মোচিত করে বা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। প্রকৃত অর্থে পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের পরিচয় শৈশব থেকে শুরু হয়। তাই শৈশবটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন : কত সময় নিয়ে ‘নদী নিরবধি’ লিখেছেন? রিজিয়া রহমান : ২০০৪ থেকে লেখা শুরু করেছিলাম। বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তারপর ঐতিহ্য প্রথম বইটি করল। আবার সবাই তাগাদা দেয়া শুরু করল। এবারেরটা ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। বাকিটা লেখা শুরু করেছি। ‘কালি ও কলমে’ কিছু ছাপাও হয়েছে।

প্রশ্ন : জীবনের যেসব প্রসঙ্গ বলতে চেয়েছেন সব কি বলতে পেরেছেন বইটিতে?

রিজিয়া রহমান : পৃথিবীটা তো অনেক বড়। যদিও গ্রহ-নক্ষত্র, সৌরমণ্ডলী থেকে পৃথিবী খুবই ছোট, তবে পৃথিবীটা মানুষের জন্য অনেক বড়। অনেক মানুষ, অনেক জীবন, অনেক কিছু এখানে। এখন মনে হয় যে, শৈশব থেকে শুরু করে মানুষের জীবনটা এত বড় যে, সব তো বলে শেষ করা যাচ্ছে না, আরো বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখানে একটু সংক্ষিপ্ত করে বলছি। না হলে ওই একই সময়ের কথা, পরিবেশ আর এত ঘটনা বলতে বলতেই জীবন শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং সব কথা কি সব সময় বলা যায়? কিছু তো থেকেই যায়।

প্রশ্ন : আপনি মূলত ঔপন্যাসিক। উপন্যাস না লিখে স্মৃতিকথা রচনায় উদ্বুদ্ধ হলেন যে? রিজিয়া রহমান : না, আমাকে যেভাবে ঔপন্যাসিক হিসেবে ট্রেডমার্ক করা হয়েছে, আমি তা কিন্তু না। আমি প্রথমে কবিতা দিয়েই শুরু করেছিলাম, তারপর অনেকগুলো ছোটগল্প বেরুনোর পরেই উপন্যাস লেখা শুরু করেছি। স্মৃতিকথা লেখার জন্য কেন উদ্বুদ্ধ হয়েছি তা বলেছি আমার ‘অভিবাসী আমি’ বইটির ভূমিকায়। আমি মনে করি, আমার সময়ে যারা জন্মেছেন- যেমন আমি, হাসান আজিজুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আমরা কাছাকাছি সময়ের। ওই সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমি দেখেছি। তখন আমি খুবই ছোট। তারপর দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, ভারত-পাকিস্তানের বিভক্তি, রাজনৈতিক টানাপড়েন, রাজনৈতিক পরিবর্তন- এ যে অস্থিরতার সময়টা, এ সময়টা আমি দেখেছি। ওই সময়টা আমাদের রাজনীতি, সাহিত্য, সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি ও আমার সমসাময়িক যারা তাদের স্মৃতিকথায় এ কথাগুলোই বলেছেন। আমার তখন যে বয়স সেই বয়সটাতে এসব ঘটনা মনের ওপর ছাপ ফেলে। তাই স্মৃতিকথা রচনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া। এ ছাড়া তখনকার সমাজ, পরিবেশের মধ্যে এখনকার ব্যবধান বেড়েই চলেছে। সুতরাং ওই সময়টাকে ধরে রাখার জন্যই লেখা। এগুলো তো ভুলে যাই। যদি লিখে রাখি তাহলে বই উল্টিয়ে দেখে নিতে পারি যে, এ সময়টায় ওই ঘটনা ঘটেছিল। প্রশ্ন : একজন সৃজনশীল লেখক স্মৃতিকথা লিখতে গেলে তার মৌলিক লেখা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না? রিজিয়া রহমান : না, আমার তো তা হয়নি। তার কারণ, আমার যখন যেটা লিখতে ভালো লাগে সেটা আমি লেখি। আমাকে যে সারাক্ষণ উপন্যাস আটকে রাখবে সেটা আমি মানতে রাজি নই। প্রশ্ন : ‘আজব ঘড়ির দেশে’ উপন্যাসটি কিছুটা ব্যতিক্রম বলেছিলেন? কেন ব্যতিক্রম? শিশুদের কোন বিষয়টা এখানে গুরুত্ব পেয়েছে? রিজিয়া রহমান : এটা আসলে সায়েন্স ফিকশন। পৃথিবীর জন্ম বা উৎপত্তি থেকে পৃথিবী কত স্তর পরিবর্তন করে, কীভাবে আবহাওয়া, প্রাণীর বিবর্তন হতে হতে আধুনিক পৃথিবী পর্যন্ত মানুষ এল, সেই পর্যন্ত সময়টাকে আমি এটার মধ্যে ধরতে চেষ্টা করেছি। খুব উপভোগ্য করে কিশোর উপন্যাসের ধারায় আমি এগুলো উপস্থাপন করেছি। বাংলাদেশের কিশোরদের জন্য এটা খুবই শিক্ষামূলক একটা বই। এটা তারা উপভোগ করবে এবং অনেক কিছু শিখতে পারবে। প্রশ্ন : বাংলাদেশের সমকালীন শিশু সাহিত্য সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? রিজিয়া রহমান : ভালো হচ্ছে। তবে একটা জিনিস, শিশুদের জন্য কিন্তু আলাদা একটা ভাষা আছে। শিশুদের জন্য ভাষা আলাদা, কিশোরদের জন্য আলাদা আবার বড়দের জন্য আলাদা। অনেকে ভাষার এ পার্থক্যটা ধরতে পারেন না। যার ফলে ছোটদের জন্য বড়দের ভাষা ব্যবহার করেন। অনেকে ভালো লিখছেন। জাফর ইকবাল তো খুব ভালো কাজ করেছেন। অনেকে আছেন আরো। সবার নাম করতে চাই না এখানে।

প্রশ্ন : প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে শিশুরা আদৌ কি সাহিত্য পড়ছে? রিজিয়া রহমান : প্রযুক্তির উৎকর্ষ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অগ্রগতি। অগ্রগতি বন্ধ তো হয়নি। এক সময় রেডিও-টেলিভিশন ছিল না। বই ছিল আমাদের বিনোদন। এখনকার ছেলেমেয়েদের অনেকে টেলিভিশনেই সবকিছু দেখে। অনেকে একেবারেই পড়ে না। টিভি সিরিয়ালে বা কম্পিউটারে অনেক কিছু পেয়ে যায়। শিশুদের জন্য বই পড়ার অভ্যাসটা করে দেয়া নির্ভর করে তার মা-বাবার ওপর। আমার ছেলেকে ছোটকাল থেকে আমি গল্প বলতাম, গল্প পড়ে শোনাতাম। তাতে তার এমন নেশা হয়েছে যে, বই ফুরিয়ে গেলে বই কিনে দিতে হতো। নইলে কান্নাকাটি করত। তো আস্তে আস্তে যদি বইয়ের অভ্যাস হয়ে যায় তবে আর কোনো সমস্যা থাকে না। সে বই পড়বেই।

আজকাল টেলিভিশনে ভুল বানান, ভুল শব্দ, ভুল বাক্য ব্যবহার হয়। এত পুরনো একটা ভাষা, যতই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হোক, বাক্য তো আমি ভুল লিখতে পারি না। অবশ্যই সেটা শুদ্ধ হতে হবে। মুখে আমি যাই বলি না কেন, লেখার ভাষায় অবশ্যই একটা মান থাকতে হবে। তার মানে এ নয় যে, অলংকারবহুল জবরজং একটা ভাষা আমাকে লিখতে হবে। আমি লিখব স্ট্যান্ডার্ড, পরিচ্ছন্ন এবং একটা শুদ্ধ ভাষা।

প্রশ্ন : বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উপন্যাস চর্চার অবস্থা সম্পর্কে যদি বলেন। রিজিয়া রহমান : সবার উপন্যাস তো আমি পড়ার সুযোগ পাই না। এটা তাই বলাও মুশকিল। তবে এখন নতুনরা নতুনভাবে চিন্তা করছে। তাদের ভাষা অন্য, তাদের চিন্তা, প্রকাশভঙ্গি অন্য। আরো কিছু দিন না গেলে এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়। প্রশ্ন : প্রায়ই বলা হয়ে থাকে, উপন্যাস চর্চায় একটা বন্ধ্যাকাল চলছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো ঔপন্যাসিক বেরিয়ে আসছে না। এটা কেন? রিজিয়া রহমান : না, সবাইকেই যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস হতে হবে এমন তো কথা নেই। আমাদের দেশে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরেও কিন্তু অনেক বড় বড় লেখক এসেছেন। যেমন শহীদুল্লাহ কায়সার, শামসুদ্দিন আবুল কালাম, আবু জাফর শামসুদ্দিন। এরা নিঃসন্দেহে ক্ল্যাসিক লেখক। তারা তাদের সময়কে ধরতে পেরেছেন। এখনকার ছেলেমেয়েরা পড়ে খুব কম। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো একজন ঔপন্যাসিক হতে গেলে একটা ধারাবাহিকতা লাগে। বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম উপন্যাস এনেছেন বাংলা সাহিত্যে। তারপর শরৎচন্দ্র। তারপর আধুনিক উপন্যাস কিছু লেখা হয়েছে। আধুনিক উপন্যাস প্রবর্তন করলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর যে ধারাটা এলো, কাউকে পথ বেঁধে দিতে হয়নি, আস্তে আস্তে উঠে এসেছে। তো দুশ বছরের যে ধারা সেটা এখানে পঞ্চাশ-ষাট বছরে তুলনা করাটা মনে হয় ঠিক হবে না। প্রশ্ন : বাংলাদেশের উপন্যাসের ভবিষ্যৎ কী? রিজিয়া রহমান : মানুষ যদি উপন্যাস পড়ে তাহলে ভবিষ্যৎ ভালো, না পড়লে খারাপ এ আরকি। প্রশ্ন : জনপ্রিয় উপন্যাস ও মূলধারার উপন্যাস সম্পর্কে আপনি কী বলবেন? রিজিয়া রহমান : জনপ্রিয় উপন্যাস বা মূলধারার উপন্যাস কথাটির মধ্যে আমার আপত্তি আছে। উপন্যাস সবই উপন্যাস। একজন লেখকের একটা উপন্যাস খুবই জনপ্রিয় হতে পারে, আরেকটা হয়তো ভারী, তথ্যভিত্তিক, সেটা খ্যাতি পেতে সময় লাগে। তাই আমি আলাদা করতে রাজি না। তবে কিছু আছে চটুল উপন্যাস। অনেক ভালো উপন্যাসও অনেক জনপ্রিয় হতে পারে। শেষের কবিতা অত্যন্ত ভালো উপন্যাস, কিন্তু অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাই আমি বিভক্ত করতে রাজি না। কিছু চটুল, অগভীর উপন্যাস আছে। যেগুলো ছেলেমেয়েরা পড়লে তাদের সময় কাটে, তারা উপভোগ করে। জীবনের গভীরতাহীন এবং বাস্তব থেকে একটু দূরে। এ ধরনের উপন্যাস খুব বেশি তো আমাদের দেশে লেখা হয় না। প্রশ্ন : শিল্পচর্চার জন্য কি জনপ্রিয়তা ক্ষতিকর? রিজিয়া রহমান : অনেক সময় ক্ষতিকর, অনেক সময় ক্ষতিকর না। অনেক সময় উদ্বুদ্ধ করে, অনেক সময় ক্ষতি করে। ক্ষতি করে এভাবে, যদি লেখক অত্যন্ত আত্মতৃপ্ত হয়ে যান, বা চান যে পাঠকরা আমাকে এভাবে ভালোবাসুক। পাঠক কী কী পছন্দ করে লেখককে তাই লিখতে হবে কেন? একজন লেখক তো সেটা করতে পারেন না। তিনি কি দেবেন সেটাই পাঠক গ্রহণ করবে এটা হওয়া উচিত। এটা ক্ষতিকর। আবার ভালো করে এ কারণে যে, একজন লেখক জনপ্রিয় যদি হন তার লেখা পাঠকরা বেশি পছন্দ করে। কোন বয়সী পাঠক, গভীর পাঠক না অগভীর পাঠক সেটা আমি এ মুহূর্তে বিশ্লেষণে যাচ্ছি না। জনপ্রিয়তা অনেক সময় লেখককে উন্নতও করে। সুতরাং জনপ্রিয়তাকে আমি দোষের কিছু মনে করি না। প্রশ্ন : উপন্যাসের ভাষা কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন? রিজিয়া রহমান : ২০১১ সালে বসে তো আমি নিশ্চয়ই বঙ্কিমের ভাষা বা প্যারিচাঁদ মিত্রের ভাষা কি তার পরবর্তী ঔপন্যাসিকদের ভাষা ব্যবহার করব না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার পরিবর্তন হবে, উপন্যাসের ভাষারও পরিবর্তন হবে। আমরা যেমনভাবে কথা বলি, যেমনভাবে চিন্তা করি উপন্যাসের ভাষা তেমনই হবে। তার মানে এটা নয় যে, একটা নিম্নমানের বাংলা, একটা অশুদ্ধ বাংলা দিয়ে লিখব। লেখার ভাষাটা উন্নত হতে হবে। প্রশ্ন : বাংলা ভাষা নিয়ে তো একটা নৈরাজ্য চলছে, এ বিষয়ে আপনার অভিমত? রিজিয়া রহমান : হ্যাঁ, নৈরাজ্য তো দেখতে পাচ্ছি। আমি স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় ‘ভুল’ বানান ভুল লিখেছিলাম। আমার ক্লাস টিচার যিনি বাংলা পড়াতেন তিনি আমাকে ‘ভুল’ শব্দটা পঁচিশ বার লিখিয়েছিলেন। আমি জীবনে আর ‘ভুল’ বানান ভুল করিনি। বাংলা বানান নিয়ে একটা উদ্ভট নিয়ম চলছে। আমরা যেরকম বানান শিখেছি তার কিছু বানান বাংলা একাডেমি বদলে প্রমিত বানান করে দিয়েছে। হয়তো একটা পত্রিকায় আমি লেখা দিলাম, প্রুফ রিডার সব ঈ-কারকে ই-কার করে দিল, আবার সব ই-কারকে ঈ-কার করে দিল। প্রুফ রিডাররা এখন বড় বানান বিশারদ। তারা শ, স, ন, ণ-এর প্রয়োগ বোঝে না। তারা ভাবে, লেখকরা বোধহয় বানান জানেন না, তাই ঠিক করে দেয়। তাই আমার মনে হয় একটা নির্দিষ্ট বানান হওয়া উচিত। আজকাল টেলিভিশনে ভুল বানান, ভুল শব্দ, ভুল বাক্য ব্যবহার হয়। এত পুরনো একটা ভাষা, যতই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হোক, বাক্য তো আমি ভুল লিখতে পারি না। অবশ্যই সেটা শুদ্ধ হতে হবে। মুখে আমি যাই বলি না কেন, লেখার ভাষায় অবশ্যই একটা মান থাকতে হবে। তার মানে এ নয় যে, অলংকারবহুল জবরজং একটা ভাষা আমাকে লিখতে হবে। আমি লিখব স্ট্যান্ডার্ড, পরিচ্ছন্ন এবং একটা শুদ্ধ ভাষা। প্রশ্ন : মানসম্পন্ন বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশকদের কী কী পদক্ষেপ নেয়া দরকার বলে মনে করেন? রিজিয়া রহমান : আমি প্রথমেই বলেছি যে, এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমির একটা ভূমিকা থাকা উচিত। স্ট্রংলি এটাকে কন্ট্রোল করা উচিত। প্রকাশকদের নিয়ে একটা কমিটি করতে হবে। সুপ্রিম পাওয়ার থাকবে বাংলা একাডেমির। যেহেতু তারা বাংলা একাডেমি। শুধু মেলা করাই তাদের দায়িত্ব নয়, তাদের আরো দায়িত্ব আছে। বইমেলা তারা করছেন, কিন্তু সেই মেলায় কি হচ্ছে না হচ্ছে সেটাও দেখা উচিত। বাংলা একাডেমিতে অনেক যোগ্য লোক আছেন, এ ব্যাপারে তাদের চিন্তা করতে হবে। প্রতি মেলায় এত বই প্রকাশিত হয়, কিন্তু এরপরও বাংলা সাহিত্য উন্নত হয় না। লিখলেই যে একটা বই প্রকাশ করা যায় তা আমরা জানতাম না। আমাদের সময় এত পুরস্কারও ছিল না। চেষ্টা ছিল ভালো লেখার। এখন তো স্টান্ট বা চমকের যুগ। সাহিত্য ক্ষেত্রে তো বটেই, দেশের সব ক্ষেত্রেই এখন গভীরতাহীন চমক দেখা যায়। বাজার অর্থনীতিতে যেটা হয় আরকি। আমি আশা করি, আমাদের সাহিত্যিকরা এ চমকের বাইরে আসবেন। নিশ্চয়ই এ অর্থনীতি দীর্ঘস্থায়ী থাকবে না, বদলে যাবে। কিন্তু লেখার মান তো অনেক নেমে গেল, লেখকের মান তো অনেক নেমে গেল। সুতরাং লেখকের একটা দায়িত্ব আছে এখানে। তিনি ঔপন্যাসিক হোন, ছোট গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ছড়াকার বা কবি- যা-ই হোন না কেন। সেই কমিটমেন্ট ও দায়িত্বটা হচ্ছে সাহিত্যের প্রতি, বাংলা ভাষার প্রতি এবং বাংলাদেশের মানুষের প্রতি। এ তিনটি জিনিস আমাদের মনে রাখা উচিত। এটা আমি সহজভাবে বুঝি। প্রশ্ন : লেখকরা প্রায়ই অভিযোগ করেন প্রকশকরা লেখকদের ঠিকমতো রয়্যালিটি দেন না। ব্যাপারটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? রিজিয়া রহমান : আগে ধরাবাঁধা একটা নিয়ম ছিল এ ব্যাপারে। যেমন আমার বইগুলো মুক্তধারা করেছে প্রথম অবস্থায়। তখন তো লেখকদের সম্মান ছিল। লেখক রয়্যালিটি চাইতেন। কত পার্সেন্ট দেবেন প্রকাশক তা বলতেন। প্রকাশক রাজি হলে কন্ট্রাক্ট সাইন করে, সাক্ষী রেখে লেখককে অগ্রিম দিয়ে তারপর পাণ্ডুলিপি নিতেন। প্রতি বছর বৈশাখ মাস এলে কত কপি বই বিক্রি হয়েছে, কত কপি ছাপিয়েছে তার হিসাব দিত এবং রয়্যালিটি পাঠিয়ে দিত। তার মানে তখন একটা কমিটমেন্ট ছিল। এখন দেখছি অনেক প্রকাশকই লেখকদের সঙ্গে কোনো চুক্তিপত্রই করেন না। এটা লেখকের জন্য যেমন ক্ষতিকর, প্রকাশকের জন্যও ক্ষতিকর। লেখক যে কোনো সময় তার বই তুলে নিয়ে যেতে পারেন। অনেক প্রকাশক আছে বই নিয়ে তিন চার বছর ফেলে রাখেন। নিয়ম হচ্ছে যে এত বছরের মধ্যে না ছাপলে সে ছাপতে পারবে না। বাংলাদেশের কপিরাইট আইন যারা দেখেন তাদের উচিত এটা দেখা যে, লেখকরা ঠিকমতো রয়্যালিটি পাচ্ছেন কিনা। প্রশ্ন : বাংলাদেশের গল্প চর্চার সাম্প্রতিক অবস্থা সম্পর্কে যদি বলেন। রিজিয়া রহমান : আমরা যারা সিনিয়র, বা আমার চেয়ে যারা সিনিয়র আছেন, আমার মনে হয় এখন গল্প তরুণদের হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত। আমি বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে প্রতিষ্ঠিতদের চাইতে অনেক তরুণের ভালো লেখা দেখি। সেগুলো অনেক সুন্দর। তারা লিটল ম্যাগে লেখেন। তাদের বড় পত্রিকায় খুঁজে পাই না। ঈদ সংখ্যা বা বিশেষ সংখ্যায় তাদের লেখা দেখি না। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতা যারা দেখেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাহিত্যের মান নির্ণয় করার ক্ষমতা তাদের কিছুটা কম। তারা সেটাকে একটা রাজত্ব বলে মনে করেন। যাকে পছন্দ করেন তার লেখা ছাপেন। দৈনিকগুলো প্রতিষ্ঠিতদের লেখা ছাপে। একটা মেয়ে ভালো লেখে, তার একটা লেখা ছাপানোর জন্য এক পত্রিকায় আমি পাঠালাম। আমাকে বলা হলো যে, আমরা তো নামকরা লেখকদের লেখা ছাড়া নিই না। এটা দুঃখজনক। ঈদ সংখ্যাগুলো একটা বাণিজ্যিক ব্যাপার হয়ে গেছে। লেখকদের নাম বিক্রি করে স্পন্সর নেয়। সুতরাং কোনো তরুণ লেখক উঠে এল কি এল না তাতে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তরুণদের নিলে তো স্পন্সর পাওয়া যাবে না। এটা মোটেই উচিত না। সম্পাদকরা এ ক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলা করছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App