×

সাময়িকী

‘মন বাড়িয়ে ছুঁই’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০১৯, ০৭:০৩ পিএম

‘মন বাড়িয়ে ছুঁই’

ব্যক্তি রিজিয়া রহমানকে আমি দেখিনি কখনো, ব্যক্তিগত পরিচয়ও ছিল না। তবে তাকে আমি আবিষ্কার করেছি। আমি ওনার লেখা পড়েই নিজেকে জানিয়েছিলাম মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকলেও অসুবিধা নেই। কিছু কিছু মানুষ থাকে যাদের যে কোনো দূরত্ব থেকেই ভালোবাসা যায়, তারা কেমন কেমন করে যেন ‘আমার’ হয়ে ওঠেন। রিজিয়া রহমান সে রকমই। নিজের মতো। খ্যাতির হাহাকার নেই। মিডিয়া পরিচিতি নিয়ে তিনি বিচলিত ছিলেন না। প্রকাশকদেরও তিনি মাথাব্যথা করেননি। পাঠকের মননের সুড়সুড়ি কিংবা জনপ্রিয়তার কাঙ্গালিপনা কোনটির দিকে তিনি মনোযোগ দেননি।

কিন্তু তার ধারালো মনোযোগ ছিল অন্য জায়গায়। সমাজে যেসব অলিগলিতে সাধারণত মানুষের চোখ পড়ে না, সেখানে তিনি ফেলেছেন দৃষ্টি। এই জন্যই তিনি আলাদা। এই জন্যই তাঁকে চিনে নিতে হয় ‘রক্তের অক্ষর’-এ। তিনিই পাঠকদের বুঝিয়েছেন দেখে তাঁকে চেনা যাবে না, তিনি সহজে শারীরিকভাবে ধরা দেবেন না। তাঁকে চিনবে বইয়ের পাতায় মন দিয়ে, হৃদয় গুঁজে। তাঁর হাত দিয়েই পাঠকের মনে ঘোরাঘুরি করে ইয়াসমীন। সেই সত্তরের দশকে যখন এ দেশে যৌন কর্মীদের নিয়ে সমাজ ততটা মানবিক হয়ে ওঠেনি তখনই রিজিয়া রহমানের কলমে মুক্তির স্লোগান তোলে যৌনকর্মী ইয়াসমীন। আশি পৃষ্ঠায় বন্দি এই উপন্যাসে পাঠকের সামনে ভেসে ওঠে যৌনকর্মীদের জীবন, দুঃখ-বেদনা, অনিশ্চয়তা, হতাশা আর মুক্তির স্বপ্ন। তাঁর গাঁথুনি মেকি নয় বরং তাতে আছে জীবনের সতেজতা, মনে হবে তিনি যেন সেই যৌন পল্লী থেকেই চরিত্রগুলোর সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। পাঠক আস্তে আস্তে সেই গলিতে ঢুকছেন আর জানছেন সমাজে জারি থাকা বৈপরীত্যকে, মানুষের রঙিন মুখোশের চরিত্রকে। তাঁর লেখায় শরীর ক্রয়-বিক্রয়ের পাল্লায় মানিবকতার শ্রুতি আছে যেমন তেমনি আছে শরীর-মনের দ্বন্দ্বের ধুকধুকানি, তার সঙ্গে পাশাপাশি পায়চারী করে হৃদয়।

আলো এবং অন্ধকারের আলাদা রূপ নেই তাঁর কাছে। দুটোই মানবিকতার আব্রুতে মোড়ানো। তাই সমাজ যখন ‘অন্ধকার জগৎ’ বলে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সেখানে তিনি মানবিকতার গল্প দিয়ে পাঠককে সেখানে ঘুরিয়ে আনেন, আগ্রহ তৈরি করান। সমাজের থুথুর দলা মাড়িয়ে মানবিক ইয়াসমীনকে পাঠক গ্রহণ করে তার প্রতিবাদের আদর্শ হিসেবে। শুধু তাই নয়, ইয়াসমীনকে সঙ্গে নিয়ে পাঠক মনে মনে সমাজ বদলের শপথ করে এবং বিড়বিড় করে সব সময় যেন বলতে থাকে, ‘ইয়াসমীনদের হত্যা করা যায় না’। আর এভাবেই রিজিয়া রহমান সামাজিক নিগৃহীতাকে কাছে টেনেছেন, আলিঙ্গন করেছেন, পাঠকের কাছে হাজির করেছেন। আর তিনি পার্থক্যের রেখা টেনেছেন ‘ভদ্র সমাজের’ বনেদি চোখের সঙ্গে। রিজিয়া রহমানের তৈরি ইয়াসমীনের মাধ্যমে বাংলাদেশে যৌন পল্লীর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। পরবর্তী সময়ে নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে যখন আমি এই বিষয়ে পড়ালেখা করছিলাম, তখনো ‘রক্তের অক্ষর’ আমার মধ্যে প্রবাহিত।

তাহলে বলেই নিই, পাঠক হিসেবে কীভাবে রিজিয়া রহমান আমার প্রথম আগ্রহে খোঁচাখুঁচি বাড়িয়ে ছিলেন। তিনি অমরত্বের সুধা পান করতে চাননি। তিনি নিজেকে মিডিয়া থেকে বরাবরই রেখেছেন আড়ালে। প্রচারমুখিতার বিপরীতে হেঁটেছেন। কিন্তু কী অবিশ্বাস্য তাড়নায় তিনি ব্রত নিয়েছিলেন পাঠকের দুনিয়াকে পাল্টানোর। ব্যক্তিকে না চিনে তার লেখার প্রতি আগ্রহী করার এক ঈর্ষণীয় আহ্বান পাঠকের মনে তিনি বুনে দেন। তাই রিজিয়া রহমানের ব্যক্তিসত্তা থেকে জোরালো থাকে তার ব্যক্তিত্বের অনুভূতি, আবেগ আর যাপিত জীবনের বিভিন্ন দিককে নানা ঢংয়ে হাজির করার মনস্কতা। এই মুক্তির চোখ আসলেই মিলে না।

রিজিয়া রহমান কেন নিম্নবর্গের সাহিত্যে মনোযোগী ছিলেন? কেনইবা তার উপন্যাসে বারবার উঠে এসেছে সমাজের জীবন সংগ্রামী মানুষেরা। কেনইবা তিনি তাঁর অনেক লেখার খুঁটি গেড়েছেন অন্ত্যজ শ্রেণির আঙিনায়? তাঁর ‘ঘর ভাঙ্গা ঘর’ থেকে নদী ভাঙনের আওয়াজ শোনে পাঠক। আর একইভাবে খুঁজতে থাকে ঢাকা শহরের বস্তির ইতিহাসকে। সেই ইতিহাস একমুখী নয়, সেখানেও আছে ভাঙা-গড়া, স্বপ্ন-বঞ্চনার তরঙ্গ। সেই মানুষদের গল্প তিনি শুনেছেন আর সেটি অন্য মানুষদের শোনানোর প্রয়োজনটিও তাঁকে মনে প্রাণে খুঁচিয়েছে। আর এই মানবিক দায়িত্বে তিনি বদ্ধ ছিলেন, ঔপন্যাসিক হিসেবে সেখানেই তাঁর অনবদ্য মুন্সিয়ানা। এই ক্ষেপাটেপনা সবাই দেখাতে পারে না। কারণ কম-বেশি সবাই জনপ্রিয়তার কাঙাল, পুরস্কারের আর্জি মনে পুষে লেখেন, নিজেকে নানাভাবে চেনাতে চান। কিন্তু তিনি সেই কসরতে অলস, বেশ পিছিয়ে। সব বিষয়ে দৌড়াতে তিনি জানতেন না। তাই তো হয়তো এই প্রজন্মের অনেকেই চিনেন না জীবন চেনানো এক দাপুটে লেখককে।

সুখ-স্বপ্নের মানচিত্র তাঁর কাছে সব সময়ই ছোট। এখানে তিনি সতর্কভাবেই মেদহীন।

তাঁর ‘একাল-চিরকাল’ হাজির হয়েছে মানুষের পেট ভরে ভাত খাওয়ার সংগ্রামের চিত্র নিয়ে। আর তিনি এভাবেই সাহিত্য আর সমাজ বিজ্ঞানের যৌথ হাঁটাচলার রাস্তাটিকে মসৃণ করেছেন, মানবিক জীবনের দাবি হাঁকিয়েছেন আর একই সঙ্গে ব্যক্তিসত্তার পরিমিতিবোধ এবং উজ্জ্বলতাকে অনেকটাই একক রেখেছেন। তাই তো তিনিই পেরেছিলেন স্বপ্ন বোনা এবং স্বপ্ন ভাঙার আড়মোড়া ভেঙে উনিশ বছরের হালিমনের চাওয়াকে বা সুখকে বিছিয়ে দিতে একটু ডালমাখা ভাতের মধ্যে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App